প্রসংগ: ভালো মেয়ে, খারাপ মেয়ে

তানিয়া কামরুন নাহার:

পৃথিবীতে সম্ভবত বাংলাদেশই একমাত্র দেশ, যেখানে একজন নারীকে দেখা মাত্রই সবাই তাদের জাবেদাখাতা আর ক্যালকুলেটর নিয়ে হিসেব কষতে বসে যায়। মেয়েটি ভালো নাকি খারাপ? তার চরিত্র কেমন? মেয়েটির ভাইটাল স্ট্যাট, ভারজিনিটি, পোশাক পরিচ্ছদ, চেহারা, গায়ের রঙ, রাতের বেলা বাইরে বের হয় কি না, মোটকথা পায়ের বুড়ো আংগুলের নখ থেকে শুরু করে মাথার চুলের ডগা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে তার চরিত্র বিশ্লেষণ করে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিরা খুব সহজেই ফলাফল বলে দিতে পারেন, মেয়েটি ভালো, নাকি খারাপ!

এই বিশ্লেষণে প্রায় সবাই একেকজন বিশেষ জ্ঞানে বিশেষজ্ঞ! এমনকি সম্পূর্ণ অচেনা অজানা অপরিচিত নারীর মুখ দেখেই অতীত বর্তমান ভবিষ্যত সব বলে দেবার মতো বিশেষজ্ঞ একেকজন!

এই যে নারীকে “ভালো” কিংবা “খারাপ” বিশেষণে বিশেষিত করে বিভাজন/বৈষম্য সৃষ্টি করার সংস্কৃতি তা একেবারেই পুরুষতান্ত্রিক। এবং একজন নারীকে পুরুষতন্ত্রের চোখে অবশ্যই ভালো হতে হবে। নারীরাও সমাজের সেই কথাকথিত “ভালো মেয়ে”র স্বীকৃতি পাবার জন্য নিজের আত্নসম্মান বিকিয়ে দেবার জন্য প্রস্তুত।

ভালো মেয়ে মানে বলতে বোঝায়, শত অন্যায়, শত অত্যাচার যে মুখ বুঁজে চুপ করে সহ্য করতে পারে। নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা যত কম থাকবে, সে তত ভালো মেয়ে। ভালো মেয়েরা হয় পরনির্ভরশীল, তাদের কাজ অন্যের দাসীর কাজ। শুধু লাথি খেয়ে যাওয়া তাদের কাজ। আত্মসম্মান তাদের থাকতে নেই। বাংলা সিনেমার সবার প্রিয় অভিনেত্রী শাবানা “ভালো মেয়ে” চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে সবচেয়ে পারঙ্গম ছিলেন।

সমাজ এই রকম ভালো মেয়ে চায়। সমাজের চোখে কোন মেয়ে যদি *ভালো* না হয়, তবে শ্রদ্ধা সম্মান তো দূরের কথা, সামান্য মানবিক সাহায্যও কেউ করবে না। এমন কি রাস্তায় দাঁড়িয়ে বা বাসে উঠে যে অথর্ব ভিক্ষুক ভিক্ষা করে, সেও নারীর চেয়ে শক্তিমান। কারণ, ভিক্ষা করার সময় সে বলে, “যে মেয়ের মাথায় কাপড় নেই, তাকে বাসে কেউ সিট দেবেন না। বাসে উঠতে দেবেন না। যে মেয়ের মাথায় কাপড় আছে, তাকে বসতে দেবেন।” মানুষ-ও তাকে প্রচুর ভিক্ষা দেয় অর্থাৎ তার কথা সমর্থন করে।

আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নাগরিকের নিরাপত্তাদানের কথা ভুলে গিয়ে নারীটিকে হয়রানি করে ভালো না খারাপ সেই বিশ্লেষণ করে!

সুস্পষ্ট প্রমাণ ছাড়া শুধুমাত্র অনুমানের ভিত্তিতে কাউকে একবাক্যে ‘ভালো’ বা ‘খারাপ’ আপনি বলতে পারেন না, পারেন না, পারেন না! যদি এমন মানসিকতা থেকে থাকে তবে আপনি জাজমেন্টাল (এই শব্দের ভালো বাংলা আমার জানা নেই)। আর অযৌক্তিকভাবে খুব বেশি *জাজমেন্টাল* যদি হয়ে থাকেন, তবে শব্দটি থেকে জাজ বাদ দিলে যা থাকবে, আপনি এক সময় তা হয়ে যাবেন। অতিরিক্ত সন্দেহবাতিকতা, সুনির্দিষ্ট প্রমাণ ছাড়াই অনুমান নির্ভর সিদ্ধান্ত নেওয়া কোন সুস্থ মস্তিষ্কের কাজ নয়। মনোবিজ্ঞান-ও সে কথাই বলে।

এ সংক্রান্ত একটি হাদিস-ও রয়েছে, অনেকটা এমন, কারো সম্পর্কে না জেনে কোন কিছু অনুমান করে তাকে ঘৃণা করা বা তার প্রতি বিদ্বেষ সৃষ্টি করা যাবে না। কারণ, সেই অনুমান যদি সত্যি না হয়, তবে তা হবে সবচেয়ে বড় মিথ্যা। তাই কারো সম্পর্কে অহেতুক অনুমান করা যাবে না।

আপনি হয়তো জানেনই না আপাতদৃষ্টিতে বোরকা হিজাব পরা পর্দানশীন নারীটি হয়তো পকেটমার বা প্রতারক চক্রের সদস্য। হয়তোবা বহন করছে তাজা গ্রেনেড কিংবা নিষিদ্ধ ইয়াবা, হেরোইন। আবার জিন্স ফতুয়া পরা, উচ্চস্বরে প্রতিবাদ করা খারাপ মেয়েটি হয়তো প্রতিদিন পাঁচজন দুস্থ এতিম শিশুকে লাঞ্চ করায়, পড়ালেখা শেখায়। ঈদের সময় ওদেরকে জামা কাপড় কিনে দেয়।

তাহলে এতো দ্রুত ভালো/খারাপের হিসাবে আপনি যান কী করে?
আর কোন মানুষ কি ১০০% ভালো বা ১০০% খারাপ হতে পারে, বলুন?

সমাজে নারীদের মধ্যে এই যে ভালো বা খারাপের বিভাজন, আরো সুস্পষ্টভাবে বললে বলতে হয়, নারীর প্রতি বিদ্বেষী মনোভাব– যা আবার সম্পূর্ণ অনুমান নির্ভর, এই মানসিকতার আসলে কোথা থেকে শুরু হয় বলে আপনি মনে করেন?

এই রকম অনুমান সর্বস্ব নারীর “ভালো”, “খারাপ” হওয়া নিয়ে আপনার কী মত?

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.