মেয়েরা মুখ খুললেই ‘ষড়যন্ত্র’? কীসের ষড়যন্ত্র?

জহুরা আকসা:

বলতে বাধ্য হলাম, আপনারা যারা যৌন নিপীড়কের পক্ষে তেলবাজি করে যাচ্ছেন তাদের আসলে নিজের যোগ্যতা দিয়ে, কাজ করে, কোনো কিছু করার ক্ষমতা নেই। আপনাদের টিকে থাকার একমাত্র উপায়ই এই তেলবাজি। অথবা আপনারা মনে করেন, পুরুষ মানুষ ভালোবাসার নামে, হাসি তামাশার ছলে, ইচ্ছে হলে মেয়েদের শরীরে হাত দিতে পারে। এতে কোনো অন্যায় নেই। তা সেই নিজের মেয়ে হোক, কিংবা প্রেমিকার মেয়ে হোক, তাতে কী আসে যায়! – কি তাই না?

হয়তো আপনারাই অনেকে নিজেদের প্রয়োজনে কখনো কখনো এই সুযোগ করে দিয়েছিলেন। আর তাই এই ধরনের কদর্য আচরণ আপনাদের কাছে বৈধ বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু সব মেয়েরা তো আর আপনাদের মতো না। অনেকের কাছে এই ধরনের অশ্লীল আচরণ অপছন্দের। যখন তাদের সাথে এমন আচরণ কেউ করেছে, তখন তাদের খারাপ লেগেছে, তারা কষ্ট পেয়েছে। কিন্তু সমাজের ভয়ে তখন তারা কিছু বলতে পারেনি।

আজ যখন বিশ্ব জুড়ে #মিটু মুভমেন্ট চলছে, গতবছর থেকে শুরু হওয়া যে মুভমেন্টকে কেন্দ্র করে মেয়েরা নিজেদের সাথে ঘটে যাওয়া যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে, ঠিক তখন অনেকের মতো সীমন্তির মনে হয়েছে তারও উচিৎ মুখ খোলা। আর তাই সে তার ফেসবুকে কৈশোরে ঘটে যাওয়া যৌন নিপীড়নের কথা বলেছে। আর আপনারা এখন তার বিপরীতে সেই অভিযুক্তের পক্ষে সাফাই গাইছেন! আপনাদের মনে হচ্ছে এসব মিথ্যা! এসব ষড়যন্ত্র!

তা আপনাদের সেই লোকটি, মানে যার নামে সীমন্তি অভিযোগ তুলেছে, তিনি কী এমন কোনো বিখ্যাত ব্যক্তি যে তার বিরুদ্ধে ১১ বছর পরে মিথ্যা অভিযোগ তুলে ষড়যন্ত্র করতে হবে? নাকি তিনি আমেরিকার জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট যে উনার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে জনপ্রিয়তা নষ্ট করতে হবে? বা ক্ষমতাচ্যুত করতে হবে অভিশংসনের মাধ্যমে? তাও এমন বিষয়ে, যেসব বিষয়ে আমাদের মেয়েদের কথা বলা নিষেধ। আমরাও তো জানতে চাই কী সেই ষড়যন্ত্র? আর কার কিসের স্বার্থ?

আপনারা যারা এসাইলামের ধুয়ো তুলছেন, তারা হয়তো জানেন না যে, সুপ্রীতি ধর একটা সম্মানজনক অবস্থান নিয়েই বর্তমানে বিদেশে আছেন। আজ এই দেশ, কাল এই দেশ করে বেড়াচ্ছেন আর তার সন্তানতুল্য উইমেন চ্যাপ্টারকে তুলে ধরছেন। ইউনিভার্সিটিতে পড়ছেন আবারও। তিনি কোনো উদ্বাস্তু না। এবং তার মেয়ে সীমন্তিও নিজ যোগ্যতায় স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশে একটা শক্ত অবস্থানে আছে। এমন অবস্থায় তাদের কোনো প্রয়োজন নেই যে তারা বাংলাদেশের মতো দেশে, সরকারি মদদপুষ্ট কোনো টিভি চ্যানেলের এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ তুলবে, তাও আবার ১১ বছর পরে! এতো বছর পর অভিযোগ তোলায় যারা ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাচ্ছেন, তারা ওরকম টাট্টিখানার গন্ধেই বসবাস করেন প্রতিনিয়ত।

শোনেন, কেউ শখ করে নিজের যৌন নিপীড়নের কথা বলে না। কারণ আমাদের সমাজে এমন কথা বলতে মানা। এসব কথা শুনলে সমাজ উল্টো মেয়েদের দোষারোপ করে। তাদের চরিত্রহীন প্রমাণ করে।

জহুরা আকসা

কিন্তু সীমন্তি তো এখন আর বাংলাদেশে থাকে না, তাই তার একটু সাহস হয়েছে। সে আর চুপ থাকেনি। সকল চক্ষুলজ্জা উপেক্ষা করে, অনেক সাহস সঞ্চয় করে সে মুখ খুলেছে। হয়তো বাংলাদেশে থাকলে সে কোনো দিন তার এই বেদনার কথা আমাদের বলতেই পারতো না।

আসলে #মিটু বলতে পারা একটা সাহসের ব্যাপার। এই সাহসী কাজটি যারা করতে পেরেছে তাদেরকে স্যালুট। আর যারা #মিটু নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন, তাদের বলি; ‘বাবা সমতুল্য হোক কিংবা অন্য কেউ হোক, কারোর স্পর্শ যদি আমার কাছে খারাপ লাগে, অশোভনীয়, নোংরা, কুৎসিত মনে হয়, তাহলে অবশ্যই সেটা যৌন হয়রানি। এমন আচরণ আমি নিজের জন্য, নিজের মা, বোন, মেয়ে কারোর জন্য কামনা করবো না’। অথচ এমনই এক নোংরা স্পর্শের ক্ষত বেড়াচ্ছিল সীমন্তি! অথচ উল্টো আপনারা এখন তার ও তার মায়ের চরিত্র নিয়ে বিশ্লেষণ শুরু করেছেন!

আজ ১১ বছর পরে কেন মেয়েটি মুখ খুলতে পেরেছে জানেন? কারণ সে এখন নিজের যোগ্যতায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে। এখন তার পায়ের তলার মাটিটা অনেক শক্ত। বিদেশে থেকে সে বুঝতে পেরেছে একজন মানুষ হিসেবে তার কী কী অধিকার আছে? সে কী কী করতে পারে! সে তার স্বাধীনতা খুঁজে পেয়েছে! তাই সে নিজের ভিতরে চেপে রাখা কষ্টের কথাগুলো বলতে পেরেছে। বলেছে তার ১১ বছর ধরে লুকিয়ে রাখা যৌন নিপীড়নের কথা।

না, কোনো লোভে পড়ে নয়, নয় কোনো মিথ্যে বানোয়াট গল্প শুনিয়ে আপনাদের কাছে ফায়দা নেওয়ার জন্য। আসলে সে একটু চিৎকার করে কাঁদতে চেয়েছিল। আমাদের সবাইকে বলতে চেয়েছিল, তার #মিটু কথা!

সীমন্তি চেয়েছিল আমরা সবাই যেন একটু সচেতন হই। সে ভেবেছিল এমন অপ্রীতিকর ঘটনার বাবা মায়েরা জানলে নিজেদের সন্তানের প্রতি একটু সচেতন হবে, সন্তানদের প্রতি লক্ষ্য রাখবেন। সে চেয়েছে যাতে অন্য কারো সাথে এমন অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে। আর সেজন্যেই সে তার ফেসবুকে কৈশোরে ঘটে যাওয়া যৌন হেনস্থার ঘটনাটি বলেছিল। সে তার মিটু বলেছে। যা আমরা অনেকেই এখনো বলতে সাহস করিনি। তাই বলে এই নয় যে আমাদের সাথে কখনো এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি।

#মিটু, মানে আমিও!
হ্যাঁ আমিও, আমি আমরা আমরা অনেকেই শৈশবে-কৈশোরে-যৌবনে যৌন নিপীড়নের শিকার! ঘরে বাহিরে স্কুল কলেজে বাসে ট্রেনে অফিসে কোথায় নেই এই নোংরা কুৎসিত কদর্য স্পর্শ? কখনো বাসের ভিড়ে, কখনও পথে চলতে গিয়ে, কখনো বা বিয়ে বাড়ির হাসি তামাশার ছলে, ছুঁয়ে গেছে আমাদেরও সেই নোংরা কদর্য স্পর্শ! কোনো মেয়ে কি জোর গলায় বলতে পারবে সে জীবনে একবারো এমন নোংরা কুৎসিত স্পর্শ পায়নি?

#মিটু তে শুধু সীমন্তি নয়, #মিটু তে আমি, আমরা প্রতিটা মেয়েই শামিল।

#MeTooBangladesh

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.