মুখোশ- পর্ব ১

সাবরিনা স. সেঁজুতি:

সাইদুজ্জামান, সরকারি স্কুলের গণিত শিক্ষক। হাঁটছেন আর ভাবছেন এবার ঠিক কত টাকা দিলে ভালো দেখা যায়। কাউকে খুশি করার একটাই পথ জানা তার, তা হল টাকা দাও, না হয় উপহার দাও। তিনি ব্যস্ত মানুষ, কেনাকাটা করার সময় কম, তাই এবার টাকাই দেবেন বলে ঠিক করেছেন।

কিন্তু কত দেবেন! প্রতি মাসেই বাড়তি খরচ লেগেই আছে। দুই সন্তান আর বউ নিয়ে এই খরুচে ঢাকা শহরে কিভাবে তার সংসার চলে সেটা কেবল তিনি-ই জানেন । মেয়েটা তবু স্কুল কলেজ উৎরে গেছে, কিন্তু ছেলে এখনো ছোট, স্কুলে পড়ে। তার ওপরে ছেলের যা খরচের হাত! মেয়ের পর ছেলে বলে সবার অতিরিক্ত আহ্লাদে সে মাথায় উঠেছে। তাকে সামাল দিতে সাইদুজ্জামানের হিমশিম অবস্থা। এই যে সামনে নববর্ষ, দেখা যাবে কেনাকাটার এত্তো বড় এক লিস্ট নিয়ে হাজির হবে ছেলে।

সাইদুজ্জামান বুঝেই পান না, এই নববর্ষটা আবার কী? আর তা নিয়ে পোলাপানের কিসের এতো মাতামাতি? কই আরবী নববর্ষ তো কাউকে ধুমধাম করে পালন করতে দেখা যায় না। তাহলে বাংলা মাসের প্রথম দিন নিয়ে কিসের এতো আদিখ্যেতা?

সে যাই হোক, খুব বেশি ভাবনা চিন্তা করার সময় অবশ্য তার নাই। কারণ শুধু বউ বাচ্চার চাহিদাটা দেখলেই তার চলে না। চাহিদা মেটাবার জন্য উপার্জনের রাস্তাটাও ঠিক রাখতে হয়।

এই যেমন, প্রতি উৎসব পার্বণে, কারণে অকারণে তাকে আসতে হয় এই বাড়িতে। উপার্জনের রাস্তা ঠিক রাখার একটা ছোট্ট প্রয়াস বলতে পারেন। কখনো উপহার হাতে, কখনো ক্যাশ। কত যে ভনিতা আর নাটক করতে ও দেখতে হয় এখানে এসে, তা নিজের চোখে না দেখলে লোকে বিশ্বাস করবে না ।

সুমন সাহেবের বাড়ি। মস্ত বড় সরকারি অফিসার এই সুমন সাহেব। তার পরিবারকে খুশি করতেই তো সাইদুজ্জামান আসেন এ বাড়িতে। আজ সেরকমই একটি দিন। না, অন্যভাবে দেখার কিছু নেই। সাইদুজ্জামান সাধ্যের মধ্যে সামান্য কিছু উপহার অথবা টাকা দিয়েই খুশি রাখেন তাদের, এর বেশি কিছু নয়।

ঘটনাটা শুরু হয়েছিল দুই বছর আগে। সাইদুজ্জামান তার স্কুলে একটা বাজে রকমের ঝামেলায় পড়েছিলেন। এসএসসি টেস্ট পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস। যদিও সাইদুজ্জামান নিজ হাতে ছাত্রকে টাকার বিনিময়ে প্রশ্ন দিয়েছেন এমন কোন চাক্ষুষ প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবু শিক্ষকরা তার বিপক্ষে চলে গিয়েছিল। চাকরি যায় যায় অবস্থা। সেই দুঃসময়ে সুমন সাহেবের ক্ষমতাবলেই রক্ষা পেয়েছিলেন সাইদুজ্জামান।

সুমন সাহেবকে তিনি সরাসরি চেনেন না। কাজটা করিয়েছিলেন সুমন সাহেবের স্ত্রীর হাত ধরে। লোকমুখে প্রচলিত ছিল সুমন সাহেব সৎ অফিসার। তাই সাইদুজ্জামান বুঝতে পারছিলেন না কীভাবে অগ্রসর হবেন। তার পক্ষে এমন বিপদ থেকে উদ্ধার পাবার আর কোন পথও খোলা ছিল না। আল্লাহ রহমতে স্কুলের বাইরে কোচিং-এ ছাত্রছাত্রী পড়িয়ে মাসে তার ভালই রোজগার। তাই সুমন সাহেবকে মোটা দাগের উপহার দিতে তার আপত্তি ছিল না। সেই থেকে সুমন সাহেবের স্ত্রী-র সাথে সাইদুজ্জামানের ভাব।

গেটের সামনে এসে টোকা দিলেন তিনি। দারোয়ান এসে দরজা খুলে দিল। সরকারি বিশাল বাসা। পুরাতন, তবে সামনের বাগানসহ বড় জায়গা জুড়ে বাসা। লোকে বলে এ বাসা নাকি এককালে বিহারিদের ছিল। মুক্তিযুদ্ধের পর সব সরকারি সম্পত্তি হয়ে গেছে। দারোয়ান তাকে দেখে বিরক্তির চোখে তাকালেন। কয়েক পা এগোতেই সাইদুজ্জামান স্পষ্ট শুনতে পেলেন, দারোয়ান ফিস ফিস করে বলছে, আইসে আরেকজন, মাইনষের যে কতো পয়সা, আমগোরে কেউ কিসসু দেয় না। সাইদুজ্জামান শুনেও না শোনার ভান করে হেঁটে চললেন। ঘরে ঢুকার জন্য আরেকবার কলিং বেল দিতে হয়। বেল দিতেই এক লোক এসে দরজা খুলে দিয়ে বসতে দিল। সাইদুজ্জামান ভাবছেন, কত টাকা দিবেন, পকেটে পাঁচ হাজার আছে।

ঘরে ঢুকুলো সুমন সাহেবের স্ত্রী রক্সি। বাইরের মানুষের কাছে উনি রক্সি নামেই পরিচিত। তার আসল নাম কেউ জানে না, তিনিও কাউকে বলেন না, কারণ সেটা নাকি একটু সেঁকেলে। সরকারি চাকরি পাবার পর সুমন সাহেব নিজের গরজেই স্ত্রীর নাম বদলে দিয়েছিলেন। সুমন সাহেব মনে করেন, জাতে উঠতে হলে নামটা মানানসই হওয়া বাঞ্ছনীয়। ঘরে ঢুকেই রক্সি বললেন, আরে সাইদুজ্জামান ভাই দেখি, কী খবর, এতোদিন পর বুঝি বোনের কথা মনে পড়লো? রক্সি তাকে ভাই বলেই সম্বোধন করে, আর সাইদুজ্জামান রক্সি আপা। রক্সি ভালো করেই জানে মাসের শুরুতে এই স্কুল মাস্টার কেন তাদের বাসায় এসেছে, তাছাড়া সামনে নববর্ষ। খুশিতে রক্সির চেহারা ৪০০ ওয়াটের বাল্বের মতো জ্বলজ্বল করছে।

এদিকে সাইদুজ্জামানের আসার কথা শুনে সুমন সাহেবের মেয়ে তিন্নিও এসে হাজির, স্লামালাইকুম স্যার। কেমন আছেন? তিন্নি অল্প কিছুদিন তার কোচিং এ ক্লাস করেছিল, তারপর সাইদুজ্জামান নিজে বাড়ি এসে পড়িয়ে যেতেন, বিনা পয়সায়। তিন্নি এরকম বিনা পয়সায় অনেকের কাছেই পড়েছে। এর জন্য তিন্নির বেশ গর্ববোধ হয়। সে খুব মজা পেত দেখতে যখন তার বাবার পরিচয় দেবার পর স্কুল মাস্টারগুলোর চেহারার রঙ পাল্টে যেত। সাইদুজ্জামান স্যারের কথা অবশ্য এখন আলাদা। উনাকে দেখলে তিন্নির চেহারাই বদলে যায়, কারণ স্যার যেদিনই আসেন, সেদিনই তার বিশেষ অর্থ লাভের আশঙ্কা।

তিন্নি বললো, স্যার বলেন কী খাবেন, চা খাবেন। চা দিতে বলি?
সাইদুজ্জামান বেশি সময় নষ্ট করতে চান না। তাই বললেন, না না কিছু লাগবে না।
রক্সি বললেন, ওমা তাই হয় নাকি, বসুন, আমি আসছি। বলেই রক্সি কিচেনের দিকে এগিয়ে গেলেন।
সাইদুজ্জামান তিন্নিকে জিজ্ঞাসা করলেন, পহেলা বৈশাখে প্ল্যান কী গো ? এবার কোথায় যাবে? তিন্নি একটু মুখ কালো করে বললো, আর কোথায়, এখনও কোন প্ল্যান নাই, আম্মু টাকা দেয় নাই, কিচ্ছু কেনা হয় নাই। সাইদুজ্জামান মনে মনে ভাবলেন, মেয়ের ঢং কত! এই বয়সেই মায়ের মতো নাটক করা শিখে গেছে।

রক্সি ঘরে ঢুকলেন। সাইদুজ্জামান বললেন, আপা, এ কেমন কথা মেয়েকে নাকি বৈশাখে কিচ্ছু কিনে দেননি? রক্সি মুচকি হাসি দিলেন। তখনি সাইদুজ্জামান পকেট থেকে পুরো পাঁচ হাজার টাকা বের করে তিন্নির হাতে গুঁজে দিয়ে বললেন, এই নাও, এটা দিয়ে তুমি কিছু কিনে নিও। এটা আমার তরফ থেকে তোমার জন্য বৈশাখের উপহার। তিন্নি একটু ন্যাকামি করে বললো, আরে না স্যার, আপনি কী যে করেন, আমার কিচ্ছু লাগবে না। এই ন্যাকামিটা ওর মায়ের কাছ থেকে শেখা। মা শিখিয়েছেন, যখন কেউ কিছু দেয় তখন নাকি হাত পেতে সরাসরি নিতে হয় না, একটু না না করে নিলে ভালো দেখা যায়। সাইদুজ্জামান বললেন, আপা আপনিই কিছু বলেন, এটা আমার তরফ থেকে উপহার।

রক্সি বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে, রাখ তিন্নি, আমি তোর আব্বুকে বুঝিয়ে বলবো। আসলে হয়েছে কী ভাই, ওর বাবা কিন্তু একদম অন্যরকম। এসব উপহার টুপহার একদমই পছন্দ করেন না । তাই মেয়ে নিতে চায় না। তবে আপনার কথা আলাদা। আপনি তো ঘরের লোক, আমাকে বোন ডেকেছেন।
সাইদুজ্জামান হাসলেন, আর মনে মনে ভাবলেন উপহার টুপহার নেন না তাতেই এ অবস্থা, নিলে না জানি কী হতো তার!

এরই মধ্যে চা চলে এসেছে, সাইদুজ্জামানের কাজও শেষ। চা টা চট করে খেয়ে দু-একটা এদিক সেদিকের কথা বলে বের হয়ে গেলেন তিনি। বের হয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন আর ভাবলেন আগামী এক দুমাসের জন্য মুক্তি।
ফিরতি পথে গেটের কাছে সাইদুজ্জামানের দেখা হলো সুমন সাহেবের ছেলের সাথে। চাল-চলনে বোঝাই যায় না এই ছেলে এ-বাড়ির সদস্য। মাথায় আউলা চুল, ঢিলে জামা, ছেঁড়া জিন্স। মুখ থেকে ভক ভক করে সিগেরেটের গন্ধ আসছে। অবশ্য তা নিয়ে সাইদুজ্জামানের তেমন কোন মাথা ব্যাথা নেই। কারণ, এক মা আর মেয়ের পাল্লায় পড়েই তার যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে, নতুন করে আর কোন ঝামেলায় জড়াতে চান না।

ছেলেটা সাইদুজ্জামানকে দেখে টুক করে একটা সালাম দিয়ে হন হন করে বাড়ির দরজার দিকে এগিয়ে গেল।
সাইদুজ্জামান ভাবলেন, মা আর মেয়ের পুরা বিপরীত ছেলেটা। সত্যিই সুমন সাহেবের ছেলে নাকি কে জানে। ভাবতে ভাবতে রিক্সা ডাকলেন সাইদুজ্জামান।
(চলবে………)

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.