সুপ্রীতিদের বন্ধু হয় না, প্রণবদের আগলে রাখে মিডিয়া

শামীমা জামান:

সম্প্রতি মি টু আন্দোলন মুম্বাইয়ে বেশ হই চই ফেলে দিয়েছে। বাংলাদেশে মি টু সম্ভব কিনা এ নিয়ে কানাঘুষা চলতে চলতেই প্রথম বোমাটি আসে মিস আয়ারল্যান্ড এবং পেশায় পাইলট মাকসুদা আকতার প্রিয়তির কাছ থেকে। রংধনু গ্রুপের চেয়ারম্যান সম্পর্কে প্রিয়তির কষ্টনি:সৃত রগরগে বর্ণনা খুব একটা সহানুভূতি পায়নি। বরং প্রিয়তির পোশাক, চরিত্রের পোস্টমর্টেমই শুরু হয়েছে।

প্রিয়তির ঘটনা আলোড়ন তোলার আগেই দ্বিতীয় মি টু বোমা এসেছে উইমেন চ্যাপ্টার ইংলিশ এর সম্পাদক এবং নেদারল্যান্ডসে মাস্টার্সের শিক্ষার্থী শুচিস্মিতা সীমন্তির ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে। প্রায় এক যুগ আগের কিশোরী সীমন্তির সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনার নায়ক প্রখ্যাত সাংবাদিক প্রণব সাহা! যিনি কিনা ঐ সময়ে সীমন্তির মায়ের সাথে সম্পর্কে আবদ্ধ ছিলেন! সীমন্তির মা উইমেন চ্যাপ্টার সম্পাদক বর্তমানে সুইডেন প্রবাসী সুপ্রীতি ধর সঙ্গীর এই ভয়ংকর গোপন কথা আগে জানতে পারেননি। গত বছর মেয়ে একটু আভাস দিয়েছিল, কিন্তু (উনার ভাষায়) ডিটেইলস জানার সাহস পাননি।

বহু বছর আগে বুদ্ধদেব গুহর ‘মাধুকরী’ পড়েছিলাম। সেখানে রুশার সাথে সম্পর্কে আবদ্ধ ইদুরকার রুশার কন্যা মিলির সাথে গোপন সম্পর্ক গড়ে তোলে। সেখানে অবশ্য কন্যা মিলি ইদুরকার এর প্রতি দুর্বল ছিল। সীমন্তির ক্ষেত্রে বিষয়টি ছিল কুৎসিত নিপীড়ন। ভাবতে কষ্ট লাগছে, একটা কিশোরী মেয়ে যখন তার শারীরিক মানসিক পরিবর্তনের সন্ধিক্ষণে এমনিতেই অবসাদগ্রস্ত হয়, সেই সময়ে এমন একটা দুর্বিষহ নিপীড়ন যতটা না শারীরিক, তার চেয়ে অনেক বেশি মানসিক কষ্টের বিষয়। সেই সময়ে সে কারো কাছে বিষয়টি শেয়ার করতে পারেনি। এমনকি তার নারীবাদী মায়ের কাছেও না।

সীমন্তির জন্য বিষয়টি দ্বিগুণ কষ্টের ছিল, কারণ সে তার যৌন হয়রানিকারীকে তার মায়ের সঙ্গী হিসেবে কিম্বা মায়ের সঙ্গীকে সে তার নিপীড়নকারী হিসেবে পেয়েছে। লোকটি সমাজে সম্মানিত। একই ছাদের নিচে তাদের যাতায়াত। সুপ্রীতি যাকে কন্যার অভিভাবক হিসেবে স্বপ্ন দেখতে থাকেন, তলে তলে সেই ছিল কন্যার নিপীড়ক। সত্যি এ যেন গল্প উপন্যাসের কাহিনি।

বিষয়টি প্রকাশের পর এ নিয়ে মিডিয়া পাড়ায় গুজগুজ ফিসফিস ভালোই চলছে। প্রণব বান্ধবেরা ইতিমধ্যেই সুপ্রীতির চরিত্রের পোস্টমর্টেম শুরু করে মুল অপরাধীর অপরাধকে হালকা করতে ব্যস্ত হয়েছেন।

প্রণবের সাথে সম্পর্ক চলাকালীন (যখন তারা একসাথে প্রথম আলোয় ছিলেন) বিভিন্ন রসালো গল্প আরও রংচং লাগিয়ে সিরিয়াল কাহিনী আকারে এখন উঠে আসছে অপরাধীর উপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে দেওয়ার জন্য। হাজার হোক তিনি একটি নিউজ চ্যানেলের সম্মানীয় সম্পাদক। এই সব টোটকা ফোটকা ইয়ের কাহিনী সব পুরুষের জীবনেই থাকে। কদিন গেলে নতুন ইস্যুতে ধামাচাপা হয়ে যাবে এসবই। এ শহরে কত-শত ধর্ষক সম্মানের সাথেই আছে দুঃসময় কাটিয়ে উঠে। আর এতো বছর পর মিটু’র এই সত্য প্রকাশ কি আসলে শুধু মি টু? নাকি সুপ্রীতির হিংসাত্মক মনের কারসাজি মেয়েকে লেলিয়ে দিয়ে! প্রণব তো তাই দাবি করেছেন।

আসলে একজন নারী যত বড় যোগ্যতার অধিকারীই হোন না কেন, তার দাম্পত্য জীবন যদি সফল না হয়, প্রথম বিয়ে যদি কোনভাবেই টিকিয়ে রাখতে না পারেন সে হয় কুলটা। অসতী। খারাপ নারী। সুপ্রীতি প্রথম বিয়ে বা দ্বিতীয় পুরুষ কাউকেই নিজের করে রাখতে পারেননি সে দোষে দোষী সাব্যস্ত করতে তার শত্রু বন্ধুর অভাব নেই। স্বামীর টাকার মদে চুমুক দিয়ে সুপ্রীতির নিঃসঙ্গতাকে উপহাস করে আসর জমানো মানুষেরাই হয়ে ওঠে ডাকসাইটে বিশাল বড় নারীবাদী।

এখানে নারীবাদ আসলে স্রেফ আইডেন্টিটি। প্রকৃতার্থেই যা ভিক্টিমের পাশে দাঁড়ানোর চেয়ে সুবিধার বাতাস যেদিকে বয় সেদিকেই দাঁড়ায় অথবা ঘাপটি মেরে পপকর্ন নিয়ে সিনেমা দেখতে বসে। এইভাবে যদি ভিক্টিমের চরিত্রের মল্মুত্র ঘাঁটা সংস্কৃতিকে উস্কানো হয়, ভবিষ্যতে মি টু নিয়ে কেউ মুখ খুলবে না। অথচ বাংলাদেশের কর্পোরেট কী মিডিয়া প্রতিটি প্রেক্ষাপটে মি টু জারি থাকা খুব প্রয়োজন ছিল।

লোকে মিডিয়ার মেয়েগুলোকে চোখ বন্ধ করে চরিত্রহীন আখ্যা দেয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তা সত্যি। কিন্তু সেই সত্যিটা কোন মেয়েই স্বেচ্ছায় গ্রহণ করে না। কাজের পরিবেশটাই এমন। লক্ষ্যে পৌঁছাতে বেশিরভাগ মেয়েই আপোষ করে। কই একটা পুরুষ আর্টিস্টকে তো এই আপোষে যেতে হয় না! কর্পোরেট ক্ষেত্রের অবস্থা আরও ভয়াবহ। মি টু আন্দোলন অভিজাত পুরুষের এই সহজাত প্রবৃত্তিতে একটু হলেও নাড়া দিতো। অফিসের সহকর্মী নারীটির উপর ঘরের গৃহিণীর মতোই অধিকার ফলানোর আগে দু বার চিন্তা করতো।

এখন সুপ্রীতি ধর এর চরিত্র নিয়ে যখন এতো জলঘোলা হচ্ছে, একটা কথা না বলে পারছি না। একদিন কথায় কথায় মিডিয়ার দু’একজন নারীর চারিত্রিক অধ:পতন বা অভ্যাসের কথা উঠে আসলে সুপ্রীতি আমায় বিস্মিত কন্ঠে বলেন, ‘কীভাবে পারে এরা? ছি: আমি তো ঘরের একটা পর্দা চেঞ্জ করেই অনেক শান্তি পাই … হাজবেন্ড নেই বলে অবৈধ পথে যেতে হবে’? এই কথাগুলোর মধ্যেই আমি সুপ্রীতিকে বুঝতে চেষ্টা করি।

আমার মনে হয় সময় এসেছে মি টু আন্দোলনকে বেগবান করতে একটু হিংসা, সুবিধা, ব্যক্তিগত ঝামেলা পিছনে ফেলে এগিয়ে চলার। নয়তো প্রণব সাহারা এইভাবেই সিংহ হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে আপনার আমার কন্যার উপর।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.