লতিফা আখতার:
“যে নারীর পাশে শক্ত পুরুষ থাকে, সমাজে তাঁর ততো শক্ত অবস্থান, এ সমাজ তাঁকে কিছু বলার আগে শতবার চিন্তা করে”- আমার রুমমেট মিলির এই কথাটা চরম সত্য মনে হয়।
পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজ ব্যবস্থায় সর্বক্ষেত্রে এই কথাটা প্রযোজ্য। যে নারীর স্বামী কম আয় করে, কিংবা যাঁর স্বামী মানসিকভাবে একটু দুর্বল, সেই মহিলার জগত সংসারে তাঁর প্রাপ্য সম্মান, সম্পত্তির অধিকার আদায়ে জীবনভর মানসিক সংগ্রাম করে যেতে হয়।
আর্থিক এবং মানসিকভাবে সক্ষম পিতার কন্যার জীবন যতো মসৃণভাবে যায়, ততো মসৃণতার সাথে সক্ষম মায়ের সন্তানের মানে সিঙ্গেল মায়ের সন্তানের যায় না। অভিভাবকহীন (???) ঐ পরিবারে হাজারও অভিভাবক, হাজারও মতামতের মারামারি।

শক্ত পায়ে বোনের পাশে দাঁড়ানোর উপযুক্ত ভাই থাকলে সে মেয়ের শৈশব, কৈশোর, যৌবন উটকো ঝামেলাবিহীন হয় এবং সর্বোপরি শ্বশুরালয়ও তাঁকে কিছুটা ছাড়ই দেয়।
যে মায়ের পুত্র সন্তান বৃদ্ধ বয়সে মায়ের পাশে আছি বলে কঠিনভাবে জানান দেয়- সে মায়ের না খেয়ে থাকতে হয় না কিংবা বৃদ্ধাশ্রমে বসে চোখের জলে ভাসতে হয় না।
ভালো একজন ছেলে বন্ধু যতো সহজে যত্ন করে নোট রেডি করে দিয়ে যায়, তা আর কেউ দেয় না। আর মেয়েটি তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনে যে ভরসা ছেলে বন্ধুটির উপর করতে পারে তা আর কারো উপর করতে পারে না।
অফিসের কাজেও এর ব্যতিক্রম হয় না। যে নারীকে পুরুষ কলিগ বেশি স্নেহ করে তাঁর অবস্থান ততোধিক মজবুত। কেননা একজন নারী যতো বড় কর্মকর্তা বা যতো দক্ষ কর্মীই হোক না কেন, দিনশেষে সে একজন নারী। ছুটিছাটাসহ নিজেকে প্রমাণ করতেই নাভিশ্বাস। আর একজনের অবস্থানে ভূমিকা থাকলে তা খুব একটা নজরে আসে না। কিন্তু পুরুষ কলিগের স্নেহে আশীর্বাদ পুষ্ট নারী ছুটিছাটা ভোগা, কম কাজ, কম টেনশনে যে আয়েশী জীবন কাটায়, তা তাঁর চলন বলনের ছটায়ই প্রকাশ পায়।
পুরুষতান্ত্রিকত সমাজ ব্যবস্থায় একজন নারী নিজেও এই বিষয়ে ভালো জানে, বোঝে। নারী শিক্ষিত হয়েছে, হচ্ছে। বড় বড় পদে কর্মরত। দিনশেষে নারী, এই অবস্থান হতে কতোজন বের হতে পেরেছে?? ব্যক্তি নারী যদিও বা নিজের অবস্থান তৈরি করতে পেরেছে, কিন্তু সামগ্রিক পরিবর্তন বা ক্ষমতায়নে তাঁর ভূমিকা খুব বেশিদূর যেতে পারেনি।
রোকেয়া হলের সামনে পুলিশ পাহারায়। পুরুষ পুলিশের সাথে নারী পুলিশও রয়েছে। সাথেই বললাম। কেননা তখনও নারী পুলিশের সংখ্যা এতোটা ছিলো না। একজন ফাজিল কিসিমের ছাত্র মহিলা পুলিশকে বিভিন্নভাবে বিরক্ত করছিলো। ভেবেছিলাম এই ছেলের তো খবর হয়ে যাবে। কিন্তু যা দেখলাম তাতে আমারই খবর হলো। ঐ নারী পুলিশ তাঁর পুরুষ সহকর্মীকে ডেকে এনেছিল। তখনও এবং এখনও আমরা অবস্থান তৈরিতে, অবস্থান অক্ষুণ্ণ রাখতে এবং সর্বোপরি মসৃণভাবে জীবন চালাতে পুরুষেরই দ্বারস্থ হই। তাকেই মানি।
এই দুই চারদিন ধরে অবস্থানের এই সাতকাহন আরও উপলব্ধি করেছি। বুঝতে পেরেছি।
প্রিয়াংকা চোপড়া অভিনীত “অ্যাতরাজ ” ভালো লাগার একটা সিনেমা। সেখানে এক নারী আর একটা নারীকে ভরা আদালতে নগ্ন করেছিলো (ভাবার্থে)। বলে কয়েই করে ছিলো। একজন নারী চাইলে আর একজন নারীকে যতোখানি নগ্ন করতে পারে, পুরুষও পারে না। কারণ নারীই ভালো জানে অন্য নারীর কোথায় আঘাত করতে হবে, কোন প্রসঙ্গ তুললে সে সবচাইতে বেশি কষ্ট পাবে।
যে সমাজ নারীর কষ্টে নারীকে পাশে দাঁড়ানোর সাহস দেয় না, পাশে না দাঁড়াতে পারলে বিপক্ষে বলতে হয় না, কিংবা এই শিক্ষা দেয় না যে মতের না মিললেও অন্তত চুপ থাকতে হয়- সে সমাজে নারী আন্দোলন শুধুই লোক দেখানো এক প্রচার বই আর কিছুই না। যে সমাজে ঘরদোর সামলে, রাজু চত্বরে দিনরাত আমার করা নারীদের ব্যানারে টিনএজ একটি মেয়ের অরক্ষিত ঘর উঠে আসে না, সে সমাজে এই আন্দোলন শুধুই সময় কাটানো ছাড়া আর কিছুই হয় না। নারী আন্দোলনে যতোভাগ নারীর মতামতের ক্ষেত্রে হতে পারে, ততোভাগ বাংলাদেশের রাজনীতিতেও হয় না।
সবশেষে একটা বিষয় শিখলাম- জামাই রাজা- বউ রানী। পুরুষ কলিগ আমাকে যতো সুবিধা দিতে পারে, তা আর কারোর পক্ষে সম্ভব নয়। যতো সুবিধা ভাইয়ের পক্ষে থাকলে বোনের ক্ষেত্রে ততো নয়। যতো সুন্দর ছবি একজন পুরুষ ফটোগ্রাফার তুলতে পারে সে রকম ছবি তোলার নারী ফটোগ্রাফার কোথায়?? আর শৈশব থেকে ফ্যামিলি গ্রুপিং এ বাবা কেই বেশি সাপোর্ট দিয়ে এসেছি।
একজন নারী কখনও সাহস করে যদিও বা প্রতিবাদী হয়, তাঁর পোস্টমর্টেম সবচাইতে নারীরাই বেশি করে। এতে দোষের কিছু নাই। হাজার বছরের ধামাধরা সমাজ ব্যবস্থার ফলাফল। শৈশবে আমাদের সাথে অস্বস্তিকর ঘটে যাওয়া ঘটনা প্রকাশ করতে গেলে প্রথম চুপটা মায়ের কাছ থেকেই শুনেছি। তাঁর কাছ থেকেই শুনেছি ঘটে যাওয়া ঘটনার জন্য আমিই দায়ী। অন্যদের সাথে তো ঘটে না। তুমিই খারাপ।
তো সময় বদলেছে। আমি ও বড় হয়েছি। শিক্ষিত এই আমার মধ্যে মা বসবাস করে- আমার জীবনের প্রথম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। একবিংশ শতাব্দীতে দাড়িয়ে আমি আমার সেই মায়ের ভূমিকায় অবতীর্ণ হই।
টিকে থাকার জন্য সব সহ্য করা আর তেলাপোকার জীবন তো এক অর্থে একই।
যাদের প্রিয়ভাজন হয়ে পুরুষতান্ত্রিকতার ছত্রছায়ায় যে জীবন যাপন- ব্যতিক্রম হলে আপনাকেও নর্দমায় ছুঁড়ে ফেলতে সময় নেবে না।