সুচিত্রা সরকার:
একথা অনেক বছর আগের। ‘মিটু’ আন্দোলনের জন্ম হয়নি তখনও। অনার্স প্রথম বর্ষ বা দ্বিতীয়তে পড়ি। সে সময় ‘অমুক’ পত্রিকায় ‘তমুক’ বলে একটা বিভাগ ছিলো। আমার জীবনে ঘটে যাওয়া যৌন নিপীড়নের দুটো ঘটনা লিখেছিলাম বিভাগটির জন্য। বিভাগীয় সম্পাদক দেখে বলেছিলেন, লেখার হাত ভালো তোমার, তবে লেখাটা বেশি প্রতিবাদী। আরেকটু নরম করে যদি লিখতে!
তাঁর ভঙ্গিটা আমাকে বেশ হতাশ করেছিলো। নিজের নিপীড়নের ঘটনা নরম করে কীভাবে লিখতে হয়, শিখিনি যে!
লেখাটা ছাপা হয়ে গেল। কারণ বোধহয়, আমি যাদের জন্য নিপীড়নের শিকার, তারা ‘ম্যাঙ্গো পিপল’। তাই ‘তাহারা’ পাশে ছিল লেখার। পাঠক নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন না, ‘তাহারা’ কাহারা?
খানিক ধৈর্য!
তার আগে ‘মিটু’ আন্দোলনের সুবাদে আমার একখান অভিজ্ঞতার সারথি হোন!
পাড়ায় একটা হোমিওপ্যাথি দোকান ছিল। জনতা ফার্মেসি। ডাক্তার আঙ্কেল, আমার বাবার পরিচিত ছিলেন। বাবা মারা যাবার পর পেটের ব্যামো, মাথা ব্যথা, ছাপোষা রোগে- সেই আঙ্কেলই ভরসা। যতদিন শৈশবকাল- যতদিন তার ‘অসুর’ রূপ ধরা দেয়নি আমার কাছে।
একদিন বুকে প্রচণ্ড ব্যথা। মা নিয়ে গেলেন ডাক্তার আঙ্কেলের কাছে। তিনি হার্ট দেখার নাম করে যা করলেন- তাতে হৃদয়ে যতোটা ব্যথা লাগলো, শরীরে ততোটাই। মাকে তিনি বললেন, আপনার মেয়েটি বড্ড ভালো।
বাড়ি ফেরার পর মাকে সবিস্তারে বর্ণনা। মা তখন সংসারের কাণ্ডারি। কী এক অগ্নিমূর্তি তার সব শুনে!
গেলেন জনতা ফার্মেসিতে। তিনিও ফিরে এলেন কাঁদতে কাঁদতে। মা, ভ-টাকে এসব অভিযোগ করতেই আশপাশের ‘তাহারা’ এসে পড়েছিল। ‘তাহারা’ নিপীড়নের কথা আমলে না নিয়ে মাকেই উল্টে অপমান।
তারপর থেকে সে দোকানের পাশ দিয়ে গেলেই রাস্তার বিপরীত পাশ দিয়ে যেতাম। লোকটার দিকে তাকাতে পারতাম না। ঘেন্না লাগতো। তারপর দীর্ঘ অনেক বছর অপেক্ষা।

একদিন দেখলাম, ভণ্ডটা তার স্ত্রী-মেয়ের সঙ্গে। মুখগুলো চিনে রাখলাম। তার কয়েকদিন বাদে, পেয়ে গেলাম মা-মেয়েকে। মেয়েটিকে বললাম, তোমার বাবা এরকম খারাপ। মেয়ের মা-ভণ্ড লোকটার স্ত্রী ‘তাহারা’ সেজে গেল। বিশ্বাস তো করলোই না। আমিই ভিলেন হয়ে গেলাম। তার পরের ঘটনা এই- সুইপার কলোনির এক লোককে ঠিক করেছিলাম। প্রতিশোধ নিতে। সে আমলের পাঁচশো টাকার ‘ইয়ে’ ঢালা হবে, সিদ্ধান্ত হলো। জনতা ফার্মেসির বন্ধ শাটারের সামনে ভোর বেলায় সেসবের সদ্ব্যবহার করা হয়েছিল।
এসব পূঁতিগন্ধ ছড়ানোর কারণ- ‘তাহারা’ আমার পাশে ছিল না।
বয়ঃসন্ধি কাল থেকে আজ অবধি জেনে বসে আছি, এসব ঘটনায় ‘তাহারা’ কখনোই ভিকটিমের পাশে থাকে না। ‘তাহারা’ আশ্চর্যজনকভাবে নিপীড়কের দোসর বনে যায়। নির্দ্বিধায়, নির্লজ্জ আর অসভ্যের মতো।
তাই আজ যখন ‘তাহারা’ সীমন্তিদের পাশে নেই, আমি অবাক নই। সীমন্তির লেখাটা পড়ার পরই, আমার মন বলছিলো, নতুন কিছু হবার নেই। সেই তো রাজা- রানী। সেই পক্ষীরাজের ঘোড়া। এরা পাল্টাবে কেন?
তাই ‘তাহারা’ প্রথমে ঘটনার প্রমাণ চাইলো। দ্বিতীয়ত, লোকটা কে, কী, কেন, কখন- এই ধরনের খোশগল্পে মেতে উঠলো। তৃতীয়ত, সীমন্তিদের দমিয়ে দিতে, চক্রব্যুহ নির্মাণ-কাজ শুরু করলো। ভাবলো, অভিমন্যু যেমন হেরেছে, চক্রব্যুহের চক্রান্তে- সীমন্তিরাও হারবেই।
সে অমুক, তার মা তমুক- ইত্যাকার নানা গল্প-গাঁথা ডালপালা মেলে এখন আমাজনের গভীর জঙ্গলসম!
‘প’ বর্গীয় গালি আমার বেশ পছন্দের। রেগে গেলেই বেরিয়ে যায়। এদের জন্য এখন সেটাও আসছে না। কারণ এবারের ‘তাহারা’ এক্কেবারেই আন স্মার্ট।
পৃথিবীর সব মেয়েই কি তার নিপীড়নের গল্প করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে? করে না। তাই এ সমাজে একটা মেয়ে যখন, তার এরকম ঘটনার উল্লেখ করে, তার বেশকিছু প্রস্তুতি নিতে হয়। যেমন, তাকে পরবর্তী সারাজীবন, মানুষের সাথে দেখা হলেই এই বিষয়টি স্মরণ করবে। তার সামাজিক যে মান (এসব ছাতা কেয়ার করার কিছু নাই) আছে, তা ক্ষুন্ন হবার আশংকা থাকে। তার পরিবার বর্গকে ‘আচ্ছাসে’ ধোলাই দিতে পারে সমাজ (এখন সীমন্তির পরিবারকে যেসব কুটচালে কাবু করার চেষ্টা হচ্ছে)। এরকম আরও বহু প্রস্তুতি মেয়েটির লাগে।
তাই একটা মেয়ে যখন নিপীড়নের ঘটনা বলে, সেসব আমলে নিতে হয়। বিজ্ঞজনরা নেয়। নেয় না শুধু ‘তাহারা’। এজেন্টওয়ালারা। আর তাদের দোসররা।
তবে ‘তাহারা’ ও তাহাদের আত্মীয় পরিজন শুনে রাখুন। দিন বদলেছে। যুগও। মানুষও। এ যুগের অভিমন্যু চক্রান্তে মরে না-দমে না।
জেনে রাখুন, এই যুগের সীমন্তিরা হারে না। পরাভবে ডরে না। তারা স্থির, শান্ত। তারা দারুণ ঝড়েও নির্ভীক-অটল। তাই তারা আছে সংগ্রামে- নিপীড়কের বিনাশ-যজ্ঞে।
আমি যাচ্ছি সীমন্তির সঙ্গে যুদ্ধে, আপনি যাচ্ছেন তো? এখনও সময় ফুরায়নি বন্ধু!
৫. ১১. ২০১৮
রাত ১০.৩০ মিনিট
লালবাগ, ঢাকা