জেসিকা জেসি:
আমি ভাঙ্গিনি, তবে মচকেছি বহুবার। শপথ করেছি, চলার পথে আর হার না মানার।
নারী অধিকার ও নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে দেশ যতোই আইন করুক, নারীকেই রুখে দাঁড়াতে হবে পরিবারের বিরুদ্ধে। অনুন্নত বা উন্নয়নশীল কোনো দেশে নারীর সংগ্রামে কেউ পাশে থাকে না, না পরিবার, না বন্ধু। নিজেকেই নিজের সাথী করে, শক্তি যুগিয়ে চলতে হয় নারীকে।
এখানে নারীর ভালো কাজের মূল্যায়ন হয় না। আর সাহসিকতার অপর নাম বেহায়াপনা। নারীর মুখ খোলা মানে বেয়াদব, আর ধর্ম ত্যাগ মানে বেশ্যাবৃত্তি।
এখানে নারীকে তার কাজের জন্য যা দেয়া হয়- তা হলো শুধুই নিন্দা।
যেসকল নারী পুরুষের যাবতীয় অন্যায়, অত্যাচার, নির্যাতন, নিপীড়ন মুখ বুঁজে মেনে নিচ্ছে, তারা পুরুষতান্ত্রিক বাহবা পাচ্ছে, হাততালি পাচ্ছে। আর তারাই হলো ভালো মেয়ে।
এমন অসভ্য নোংরা দৃষ্টি এড়িয়ে, ছোটবেলা থেকে স্বপ্ন দেখেছি একটা স্বাধীন, স্বাবলম্বী জীবনের। যেখানে কোন পুরুষের চোখ রাঙ্গানি থাকবে না। যা স্বপ্ন দেখেছি তা সবাইকে বলেও বেড়িয়েছি। এমন একটা জীবন চাই যেখানে কারো হুকুমের গোলাম হতে হবে না। বরাবরের মতই যাযাবর টাইপের ছিলাম। তার জন্য কম কষ্ট সইতে হয়নি। কানে তুলিনি শত কথা। সবাই বলতো আমি বেশ্যা, খানকি, উগ্র, বেপরোয়া, বেয়াদব, বেক্কেল, বুদ্ধিহীন।
বড়ভাই সবসময় ধর্ষণের ভয় দেখাতো, বিভিন্ন গল্প শোনাতো ধর্ষিতার লোমহর্ষক করুণ গল্প। তার পরিবর্তে ধর্ষকের কী হলো তা বলতো না। একটা গল্প মনে আছে, এক মেডিকেল নার্সের সাথে ডাক্তারের প্রেম হয়েছিল। মেডিকেলের অন্য স্টাফরাও তাকে প্রেমের অফার দেয়, তারা বলে ডাক্তারের সাথে পারলে তাদের সাথে কেন পারবে না? তারা সবাই মিলে এমনভাবে ধর্ষণ করেছে মেয়েটা পাগল হয়ে গিয়েছে। ছেলেটা পরে অন্য মেয়েকে বিয়ে করে সংসারী হয়েছে।
অর্থাৎ নারীটা স্বাবলম্বী হতে গিয়ে পরাজিত। সে/তারা আমাকে এটাই শিক্ষা দিয়েছে যে, একমাত্র স্বামীর ঘরই নারীর উপযুক্ত স্থান, চাকরিজীবী বা স্বাবলম্বী নারীর জন্য নয়।
ছোটবেলা থেকে এটুকু বুঝতে পারতাম যে আমাকে যা বলা হচ্ছে তা আসলে ভুল। আমাকে দমানোর জন্যই বলা হচ্ছে। আমি তো আগাবোই। ভাই বলতো শাস্ত্রে আছে নারী কখনোই স্বাধীন হতে পারে না। সে অধীনই থাকতে চায়, থাকেও। সমাজ/পরিবার আমায় বলেছে, পরের ঘরে গিয়ে স্বামীর লাথি খেলে সব ঠিক হয়ে যাবে, তখন দেখবো কোথায় থাকে এতো সাহস আর স্বাধীনচেতা স্বভাব।
আমি জানি সংসার জীবন নারীর জন্য কতটা সংকীর্ণ। তাই নিজেকে মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে,স্বাবলম্বী হতে আমাকে বিয়ে ঠেকাতে হবে। তাই বিয়েকে ঠেকিয়েছি ছলে-বলে কলে-কৌশলে।বয়স তখন কত জানিনা, একটু বেশি ফর্সা আর মোটাতাজা, মাংস ভরা শরীরের জন্য ক্লাস সিক্স থেকে বিয়ের জন্য প্রপোজাল আসতো। আর আমার নারীদেহ লোভী ভাই, যে নিজের জিএফকে প্রেমের নামে ফাঁসিয়ে ধর্ষণ করেছে, তার কারি কারি ডিগ্রীতে থুথু ছিটাই। সে বলতো মেয়েদের অত পড়াশোনায় কী হবে? বিয়ে দিয়ে দাও।
সেই ক্লাস সিক্স থেকে বিয়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছি। বারবার ওরা থামিয়ে দিয়েছে আমার পড়াশোনা। একজন পুরুষ কখনো কখনো সহায় ছিল, আবার কখনো কখনো সবার মতই বিহেভ করেছে। সে হলো আমার মায়ের দেহ কেনা খদ্দের/স্বামী/মালিক। সামাজিক সম্পর্ক মতে সে আমার বাবা।
মা, ভাই, ভাবী সবাই শুনিয়ে দিয়েছে, একলা নারী চলতে পারে না। আরে নারী একলা থাকবে কেনো? পুরুষের উরুর নিচে ছাড়া কি নারীকে মানায়? পুরুষের নিচেই নারীর স্থান। আজ আমরা বলছি বিয়ে করছে না, বিয়ে কি করতে হবে না? দেখবো কে দেয় বিয়ে, কী করে কাটে জীবন?
আজ আমি তাই যা হতে চেয়েছি, হাজার ঝড় বাঁধা বিঘ্ন ঠেলে একা চলতে শিখে গেছি। আমার কোন পিছুটান নেই। আমি সুখী আজ, স্বপ্নময় জীবন আমার। ছোটবেলায় যে জীবনের স্বপ্নে ঘুম আসতো না, আজ সে জীবন নিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমাই। নিজের মত খাই, পরি, কেউ বলার নেই। নারী হয়ে ওদের মতে, বেশ্যার মতো চলছি। আমি জানি মানুষের মতো বেঁচে আছি। বাকি জীবন এভাবেই কাটাতে চাই।
আমার এক ক্লোজ বন্ধু বলেছিল, আমি পুরুষ,আমরা তো মুক্ত বিহঙ্গ, যেভাবে মন চায় লাইফলিড করতে পারি, তুই তো নারী পরজীবী হয়েই থাকবি। এতো সাহস দেখাস না। কাল তাকে ফোন দিয়ে বলেছিলাম, দোস্ত মুক্ত বিহঙ্গ তুই হতে পারিসনি, আমি পেরেছি। সে বলেছে, তুই আর চেঞ্জ হলিনারে!