সমালোচনার আগে একবার ভাববেন তো!

আবদুল্লাহ আল মাসুদ:

সীমন্তি তার পিতৃতুল্য (যদিও সে এখন কীটপতঙ্গের তুল্য) একজন মানুষ পিএস এর বিরুদ্ধে যে অভিযোগ করেছেন সেটা নিয়ে পানীয় জল কম ঘোলা হচ্ছে না। অনেকে প্রশ্ন তুলছেন, সুপ্রীতি দিদির মতো একজন নারীবাদীর ঘরের ভেতরের এই চিত্র কেন? তিনি কেন তার মেয়ের কাছ থেকে এটা শোনার পরেও কিছু করেননি? কিংবা কেন তার মেয়ে তার মাকে নির্যাতনের কথা বলতে পারেনি?

আমি যতটুকু জানি ঘটনাটা ১১ বছর আগের। একজন নারী তিনি যত বড় নারীবাদীই হোন না কেন, বাংলাদেশের মত জায়গায় বেড়ে ওঠার পর মুখ খুলতে কতটা বুকের পাটা লাগে তা বোধহয় খোলাসা করে আপনাদেরকে বলতে হবে না। আপনাদের কি মনে হয়, বাংলাদেশের সুপ্রতিষ্ঠিত নারী যারা আছে; হোক না সেটা মিডিয়ায়, রাজনীতিতে কিংবা বড় বড় চাকরি ও ব্যবসায়, তারা কেউই কি যৌন হয়রানির শিকার হয়নি? শুধুমাত্র সীমন্তি আর প্রিয়তী বাদে আর কয়জন মুখ খুলেছে? তারপরেও প্রশ্ন হচ্ছে, সীমন্তি এবং প্রিয়তি কিন্তু বাংলাদেশে বসে মুখ খোলেনি, বরং উভয়জনই দেশের বাইরে আছে। তাহলে কি বোঝা গেল? একটা মেয়ের জন্য বাংলাদেশে থেকে তার নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা এবং নির্যাতনের কথা বর্ণনা করা কি এতোটা সহজ? তসলিমা নাসরিন ছাড়া আর কেউ কি আছে, যে কোন রাখঢাক না রেখে সোজাভাবে নিজের জীবনের নির্যাতিত হওয়ার ঘটনা বর্ণনা করার সাহস দেখিয়েছেন?

আবদুল্লাহ আল মাসুদ

নিজের জীবনের তিক্ততা লেখার পর কী পরিণতি ভোগ করতে হয়েছে তসলিমার, সেটা নিশ্চয়ই আপনাদেরকে দেখিয়ে দেয়ার জন্য ম্যাগনিফাইং গ্লাস সরবরাহ করতে হবে না? এরকম একটা দেশে বসে সুপ্রীতি ধরের মেয়ে হলেই যে তাৎক্ষণিক মুখ খুলে হরহর করে নিজের যৌন নিগৃহীত হওয়ার কথা বলতে পারবে, সম্ভবত অতটা ভালো সমাজ আমরা এখনো দেশবাসীকে উপহার দিতে পারি নি! বরং আমরা যেটা পেরেছি তা হচ্ছে, যে কোন বিষয়ে হেতুক কিংবা অহেতুক বিতর্ক সৃষ্টি করতে। পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে যখন কারো যখন সাহায্যের প্রয়োজন হয় তখন তার হাতটা ছেড়ে দিতে পেরেছি অামরা। সুপ্রীতি ধরের মেয়েও কেন চুপ ছিল সে প্রশ্ন আমাদেরকে তাড়া করে ফিরছে; কিন্তু মেয়েটি কতটা কষ্টে আছে, কী দুঃসহ স্মৃতি তাকে তাড়া করে ফিরছে এবং তার মা এ ঘটনার পরে কতটা যন্ত্রণায় দগ্ধ হচ্ছেন সে প্রশ্নটা আমাদেরকে যেন স্পর্শই করছে না !
আমাদের কলম দিয়ে, আমাদের জিভ দিয়ে এবং আমাদের মস্তিষ্ক থেকে এটাই প্রসূত হয়েছে যে, কেন অাগে বলা হয়নি? এতদিন পরে কেন?

আসলে সময়ের বিচারে অবান্তর এসব প্রশ্ন করার মাধ্যমে আমরা কি প্রকারান্তরে পিএস এবং রফিকদেরই প্রতিনিধিত্ব করছি না? আমাদের অবচেতন মনের ঘুমন্ত পুরুষতান্ত্রিকতাকে কি টেনেটুনে জ্বাগিয়ে তুলছি না? আমি নারীবাদীদের কথা বলছি। নারীবাদীরা কি কেউ কেউ -অবশ্যই সবাই নয়- এমন হয়ে যাচ্ছি না? হয়তো আমাদের এই আচরণের কারণে পিএস, রফিক কিংবা এই জাতীয় পুরুষেরা খুশি হয়ে তাদের কোম্পানির তরফ থেকে কিছুটা টাকা-পয়সা সুবিধা দিতে পারে, সে লোভেই কি আমরা সীমন্তি বা তার মায়ের বিপক্ষে কথা বলছি?

দেশের ক্ষমতা, টাকা ও তথাকথিত সম্মানের বিচারে এখনো পুরুষরা নারীর চেয়ে বহুগুণ এগিয়ে। এজন্যই বোধহয় নারীতান্ত্রিকতার জন্য হম্বিতম্বি করা মানুষটাও শেষ পর্যন্ত পুরুষতান্ত্রিকতার কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ করে ফেলে।
বাংলাদেশের মত জায়গায় বসে একটা মেয়ের পক্ষে তার নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া তিক্ততার বর্ণনা করা কতোটা কষ্টসাধ্য এবং কতোটা ঝুঁকিপূর্ণ!
তা নিশ্চয়ই আমাদের কারো অজানা নয়। সুস্থ প্রেম যথেষ্ট অপরাধ বলে বিবেচিত হয় কুলাঙ্গার অধ্যুষিত এই দেশে, আর অসুস্থ ও বিকৃত যৌনতা তথা ধর্ষণ প্রশংসিত হয় কুলাঙ্গার অধ্যুষিত এই দেশে। সেখানে নির্যাতিতা মুখ খুললে তাকে বলা হয় নির্লজ্জ, বেহায়া, বেশ্যা, মাগী ইত্যাদি; আর নির্যাতক মুখ খুললে হয় ব্যাঘ্রশাবক!

সুতরাং সীমন্তি তখন কেন মুখ খোলেনি, এ প্রশ্নের জবাব পেতে আমাদের অবশ্যই সাইকোলজির অধ্যাপক হতে হবে না। প্রিয়তী কেন তখনই মুখ খোলেনি তা বোঝার জন্যও আমাদেরকে পিএইচডি গবেষক হতে হবে না। সীমন্তির মা তখন ডাকসাইটে নারীবাদী ছিলেন না। উইমেন চ্যাপ্টারের সম্পাদকও ছিলেন না। আজকের নারীবাদ নিয়ে তার যে অবস্থান সে অবস্থান বা সেই ভাবনার জায়গাটা হয়তো তখনও তার এখনকার মতো বিকশিত ছিল না। সীমন্তির মায়ের সাথে তখন পিএসের ছিল সমাজস্বীকৃত সম্পর্ক। সীমন্তির মা নিজেও যে একই ব্যক্তির দ্বারা প্রতারিত, সে কথাটা মিডিয়া পাড়ার সবাই জানে। এই ভাবনাটাও অবান্তর নয় যে, সীমন্তি তখন তার মায়ের সাথে ওই ব্যক্তিকে দেখে তার মাকেও মনের দুঃখের কথা না বলে বরং ঘৃণা করে চলছিল, যা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে টিন এজারদের মধ্যে খুবই দৃশ্যমান। হয়তোবা বয়স বাড়ার সাথে সাথে বাস্তবতা উপলব্ধি করতে শিখেছে সীমন্তি, এবং সত্য কথা লুকিয়ে না রেখে প্রকাশ করার সাহসও অর্জন করেছে।

দুঃখের বিষয়, পিএস এর নষ্টামি আজ যতোটা আলোচিত তার সমপরিমাণ আলোচিত হচ্ছে পিএসদের তৈরিকৃত কতিপয় পুরুষতান্ত্রিক তথা ধর্ষণের বৈধতাতান্ত্রিক প্রশ্ন। সীমন্তির মায়ের সাথে যখন পিএসের ছাড়াছাড়ি কিংবা দূরত্ব তৈরি হয়, তখন সাধারণ পুরুষতান্ত্রিকতার মগজ থেকে তৈরি হওয়া সকল আখ্যা এবং ব্যাখ্যা দিয়েছিল এইসব মানুষ। অর্থাৎ ছাড়াছাড়ি হওয়ার দায়ভার সুপ্রীতিরই, পিএস এখানে ধোয়া কদমপাতা।

অভিযুক্ত ব্যক্তির অপরাধের দায়ভার মোটেই সুপ্রীতি দিদির ওপর বর্তায় না, কারণ তার সাথে অভিযুক্ত ব্যক্তির কোন সম্পর্ক এখন নেই৷ বহু বছর আগেই শেষ হয়েছে সেই সম্পর্ক। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, অভিযুক্ত ব্যক্তির সাথে তখনকার সময়ে সুপ্রীতির সম্পর্কটা ছিল ভালোবাসা এবং ভালোলাগার। সুপ্রীতি নিশ্চয়ই অন্তর্যামী কেউ নন যে, অন্তরের সব খবর খুব দ্রুত পড়তে পারেন। আমরা সবাই যদি ভালো-মন্দ সব মানুষকে মেপে নিতে পারতাম তাহলে কেউই কখনো প্রতারিত হতাম না। তবে প্রেমের মুগ্ধতা আমাদেরকে এ কাজের বৈধতা দেয় না যে, আমার সন্তান কারো দ্বারা যৌন নিগ্রহের শিকার হচ্ছে কিনা সে ব্যাপারে আমি উদাসীন থাকবো।

ভুলভাল মানুষের সাথে সম্পর্ক হলেও ভুল মানুষের ভুলটা এক সময় ধরা পড়ে যায়। সুপ্রীতি দিদির বেলায়ও এর ব্যতিক্রম হয়নি। ভুল মানুষকে চিনতে পেরেই তিনি তার কাছ থেকে সরে গিয়েছিলেন।

সর্বোপরি একটা কথা না বললেই নয়, এদেশে কি শুধু দু-চারজন মানুষই যৌন নিগ্রহের শিকার হয়েছেন? #MeToo এর ঢেউয়ে শুধুমাত্র দু-চারজন মানুষই মুখ খুলেছে কেন? বাকিরা কোথায়? কেন প্রকাশিত হচ্ছে না আমাদের অতিপরিচিত হাজার হাজার ধর্ষক পুরুষদের চরিত্র? কেন উন্মোচিত হচ্ছে না ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, সেলিব্রেটি, পাড়ার বড়ভাই ও দলীয় ক্যাডারদের আসল চরিত্র? কেন উন্মোচিত হচ্ছে না, হঠাৎ অতিরিক্ত ধার্মিক বনে যাওয়া কতিপয় গডফাদারদের ধর্ষক চেহারা?

ধর্ষকদের চেহারা এবং আচরণ দেখলে আমরা বুঝতে পারি সে ধর্ষক, কিন্তু আমি পুরুষ কি তার ধর্ষণ-কাহিনী তুলে ধরবো? আমি পুরুষ, আমি কি বলব অমুক লোকটা আমাকে ধর্ষণ করেছে? যে তার দ্বারা ধর্ষিতা হয়েছে কিংবা যৌন হেনস্তা হয়েছে তারই কি উচিত নয় মুখ খোলা? ক’জন মুখ খুলেছে? লব্ধপ্রতিষ্ঠ এবং আর্থিকভাবে স্বচ্ছল নারীরাও কি সাহস পেয়েছে মুখ খোলার? সাহস পাবেই বা কীভাবে?

সাহসী মানুষদেরকে আমাদের সমাজের ভদ্রতার মুখোশ পরা ব্যক্তিরা সুযোগ পেয়েই অত্যন্ত জঘন্য এবং নোংরা আক্রমণ করেছে বারবার। তারা তাদের তথাকথিত ভাষাগত ভদ্রতার অজুহাত দেখিয়ে, অশ্লীলতার ধুয়া তুলে বারবার ক্ষতবিক্ষত করেছে সাহসী মানুষদেরকে। যে তসলিমা নাসরিনকে এক সময়ে ভারতের বুদ্ধিজীবীরা স্বাগত জানিয়েছিল, সেই বুদ্ধিজীবীদেরই একাংশের মধ্যে জেগে উঠেছিল নিষ্ঠুর পুরুষতান্ত্রিকতা। তারাও তাদের মনের সকল মাধুরী দিয়ে, মসলা মাখিয়ে তসলিমার চরিত্র হননে আদাজল খেয়ে নেমে পড়েছিল! এ সকল বুদ্ধিজীবীদের দেখাদেখি আমাদের মধ্যের অনেক মানুষই তাদের ভেতরের সেই সুপ্ত পুরুষতান্ত্রিকতাকে পুনরায় জাগ্রত করেছিল।

পুরুষতন্ত্রের সবচেয়ে বড় অস্ত্র হচ্ছে ত্যানা প্যাঁচানো, ঠিক ধার্মিকদের মতোই। ধার্মিকরা যেমন বিভিন্নভাবে ত্যানা পেচিয়ে তাদের ধর্মকে সায়েন্টিফিক, মানবতাবাদি, নারীবান্ধব প্রমাণ করতে সচেষ্ট হয়, ঠিক তেমনি পুরুষতান্ত্রিকরাও কোন না কোনভাবে তাদের পুরুষতান্ত্রিকতাকে নারীতান্ত্রিক, নারী-বান্ধব ও নারীর জন্য কল্যাণকর প্রমাণ করতে মরিয়া হয়ে যায়।
আমরা বুঝে অথবা না বুঝে, ব্যক্তিগত আক্রোশে কিংবা পরশ্রীকাতরতায় ভুগে নিগৃহীত এবং হেনস্থার শিকার হওয়া মানুষের বিপক্ষেও দাঁড়িয়ে যাই। আর এভাবেই অনেক সময়ই নারীবাদও হয়ে যায় পুরুষতান্ত্রিকতার রক্ষক এবং নারীবাদ এর হন্তারক।

এই যে কোনো না কোনোভাবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিগৃহীত নারীর বিরুদ্ধেই আমরা তোপটা দেগে দিই, এটা কি মনের ভেতরের ঘুমন্ত পুরুষতান্ত্রিকতাকে জাগিয়ে তোলা নয়? আমাদের কোনটা উচিত ছিল আগে, সিমন্তি কিংবা তার মাকে দোষারোপ করা নাকি চরিত্রহীন ধর্ষকের দোষারোপ করা?
আমরা কি প্রতিটা অন্যায়, অবিচার এবং বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে বেশি আগ্রহী নাকি প্রতিবাদী মানুষদের খুঁত খুঁজে বেড়াতে বেশি আগ্রহী?
প্রশ্নটা কি কখনো নিজের বিবেককে করেছেন?

সীমন্তি কিংবা প্রিয়তীর কথা সত্য কি মিথ্যা সেটা একটা প্রশ্ন, কারণ কোনো একটা মেয়ে সব সময় যে সত্য কথা বলে এমনটা অবধারিত নয়। পুরুষও যে সব সময় সত্য কথা বলে এমনটাও অবধারিত নয়। কিন্তু আপনি কি নিজের বিবেককে প্রশ্ন করে দেখেছেন, এই সমাজে আপনার শৈশব থেকে আপনি যে যৌন হেনস্তা দেখেছেন তাতে আপনার ধারণা মতে শতকরা কত ভাগ নারী এবং শিশু তাদের কৈশোর এবং শৈশবে যৌন নিগ্রহের শিকার হয়েছে? সংখ্যাটা কি 10%, 20%, 50% অথবা 90% নাকি তার চেয়েও বেশি বলে আপনি মনে করেন? যে চিত্র সমাজের সবখানে দৃশ্যমান সেটা যদি বিবৃত হয় তাহলে তা অবিশ্বাস করার যৌক্তিকতা অনেকাংশেই কমে যায়।

এই মুহূর্তে যিনি আমার লেখা পড়ছেন তিনি যদি নারী হোন এবং বাংলাদেশের নাগরিক হোন, তাহলে তাকেই প্রশ্ন করি – অাপনিই বলুন না অাপনি কি কোনদিন যৌন হেনস্তার শিকার হননি?
আপনাকে আবারো প্রশ্ন করছি, আপনি কি আপনার শৈশব কৈশোর কিংবা পরিণত বয়সে যৌন নিগৃহীত হওয়ার কথা বলার মতো হিম্মত অর্জন করেছেন?

নাকি আপনার মধ্যে এখনো সেই চিন্তা ভর করে রয়েছে যে, মুখ খুলবো কী করে? মুখ খুললে সমাজে মুখ দেখাবো কী করে? পুরুষদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করবো কীভাবে? কপালে বর জুটবে কীভাবে? কি পারবেন, আপনার নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া দুঃসহ স্মৃতির কথা বলতে? নাকি ‘কীভাবে’র’ তাণ্ডবে পণ্ড হয়ে যাবে আপনার সব সাহসিকতা?

শেয়ার করুন: