#MeToo মুভমেন্টে আমি একজন সার্ভাইভার

ইলা ফাহমি:

প্রিয় নারীগণ,

জীবনে বিভিন্ন প্রেক্ষিতে নির্যাতনের শিকার আমি একজন সার্ভাইভার। সার্ভাইভ করবার তাগিদে ভুলে যেতে হয়েছে অনেক ঘটনা৷ কেননা একটা সময় প্রচণ্ড ট্রমাটাইজ হয়ে পড়েছিলাম। ভুলে গিয়ে উঠে দাঁড়ানোটা জরুরি ছিলো। সর্বপ্রথম মেয়ে বলে ধাক্কা খেয়েছিলাম কবে? আমার বাবার কলিগ, জয়নাল নাম তার, যেদিন আদরের ছলে কোলে নিয়ে বুকে হাত চেপে চেপে আনন্দ নিচ্ছিলেন? বয়স কত আমার, নয় কী দশ৷ আম্মাকে বলতে পারিনি।

ছোটখালার বিয়ের কথাবার্তা চলছিলো, সেই লোক ছিলো এর মধ্যস্ততায়। দ্বিতীয়বার কাছে না গেলেও ছোটবোনটিকে একদিন একিভাবে কোলে নিতে দেখে ওকে নিয়ে আসি জোর করে। নিজের বেলায় চুপ থাকলেও ছোটটির প্রতি আচরণে আর চুপ না থেকে আম্মাকে বলেছিলাম। সামাজিক পরিস্থিতির চাপে আম্মা ব্যাপারটা চাপা দিয়ে যায়, কিন্তু সেই লোকের কাছে যেতে মানা করে, বাসায় আসলেও আম্মা কাছে যেতে দিতো না। সেই নয় বছর বয়সের স্পর্শ এতোটাই তীক্ষ্ণ হয়ে গিয়েছিলো যে আজ অবধি কেউ স্পর্শ করলে বুঝতে পারি স্পর্শের কারণ।

ইলা ফাহমি

এরপর? এরপর ঈদের মৌসুমে মার্কেটে গেছি, পথে ভিড়ে বাসে বুকে নিতম্বে হাত পড়েছে। এরকম পরিস্থিতিতে কিশোরীবেলায় চিৎকার করবার, প্রতিবাদ করবার, রুখে দাঁড়াবার শিক্ষাটা কেউ দেয়নি বলে চুপ থেকেছি।

সেই বয়সে প্রথম উপলব্ধি হয়েছিলো — এই সমাজে আমাকে এভাবে দেখে কেনো? আম্মার পেটে আবার ঢুকে যেতে ইচ্ছে করতো। আমাদের বাসার ছাদটা আরো দশটা বাড়ির ছাদের সাথে লাগোয়া ছিলো, এক ছাদ থেকে আরেক ছাদে টপকে যাওয়া যেত। দুই বাড়ি দূরের চাচাগোছের লোকটি দূর থেকেই দেখতো, হাত নাড়তো। দুপুরে স্কুল থেকে ফিরে ছাদে গিয়ে গাছে পানি দিতাম, কাপড় নেড়ে দিতাম। একদিন ভরদুপুরে চাচালোকটি ছাদ টপকে চলে এলো, কথা বলতে বলতে হাত ধরে টেনে নিয়েছিলো বুকের কাছে। পাঁচ কী ছয় সেকেন্ড ধস্তাধস্তি করে দৌড়ে বাসায় আসি, শুনেছি লোকটি মারা গেছে, নাম তার হাশেম, আমার বয়সী তার দুটো মেয়েও ছিলো। সে পিতা ছিলো তার সন্তানের কাছে, আমার কাছে সে নিপীড়ক।

এই সমাজব্যবস্থা কন্যাশিশুর জন্য দুর্গম, ভালোর চাদরে ঢেকে রাখা পুতিগন্ধময় ঘা। শুধু কন্যাশিশু নয়, বহু ছেলে শিশুর জীবনেও আছে করুণ ঘটনা। তবু কন্যাদের পাল্লাটা ভারী। এমন একটি কন্যা খুঁজে পাওয়া যাবে যে এক জীবনে একবারের জন্যও কোনো সহিংসতার শিকার হয়নি? একটি বারের জন্য কোন লোলুপ চাহনি তাকে বিব্রত করেনি? তবু কন্যারা মুখ লুকায় লজ্জার আবরণে। অথচ আবর্জনাদের নাম থেকে যায় আড়ালে।

হিসেব করে দেখেছি, জীবনে বিভিন্ন উপায়ে নির্যাতনের শিকার হয়েছি চল্লিশ বারের ওপর। তারপরেও যখন একজন পুরুষ বলেন,  ‘নারীর জন্য এ সমাজ অনেক কিছু করেছে, নারীরা সুবিধা পুরুষের চেয়ে বেশি পায়, চাকরিক্ষেত্রে নারীর ওপরে ওঠার থিওরি আমার জানা।’ তার এই বাক্যটুকু কতটা সেক্সিস্ট তিনি জানেন না, তিনি জেন্ডার নিয়ে কাজ করেন বটে। পেটের দায়ে কাজ করা আর মগজে বহন করে তার প্র‍্যাক্টিস করার মাঝে যোজন যোজন ফারাক। এই কথাগুলো বলা মানুষটিও মগজে নিয়ে ঘোরেন আদিম পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা।

#MeToo আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ুক, খুলে যাক নারীর না বলা কথার ঝুলি। শুধু এই প্লাটফর্মে না, যখন যেখানে সে নির্যাতনের শিকার হবে প্রতিবাদ করুক, বুকের ভেতর যন্ত্রণা জমিয়ে রেখে যৌনতার লজ্জার ট্যাগ গায়ে না মাখুক। প্রিয়তী, সীমন্তি কিংবা ইলা হয়তো একটি নাম, কিন্তু আমরা এই সমাজের সেই নারীদের প্রতিক যাদের গোপন যন্ত্রণা আছে। বিচার হয় না, হবে না হয়তো, সিস্টেম ঝাঁকুনি খাক। সিস্টেম পরিবর্তনশীল, সেই পরিবর্তনের দায়িত্ব মানুষেরই, নারীর দায়িত্ব বরং বেশী। যে শ্রেণী সুবিধা ভোগ করে সেই শ্রেণীকে পাশে পাব এটা আশা করা যায় কিন্তু আশা করে বসে থাকা যায় না।

নারী অবহেলিত, শোষিত সেহেতু নারীর সচেতনতা, নিজস্ব স্বর বেশি জরুরি। আজকের কন্যা সন্তানটি প্রতিবাদ করতে শিখুক, চিৎকার করতে শিখুক।

#MeToo

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.