ব্রিটেন কিংবা বাংলাদেশ, পাল্টাবো কবে?

শাফিনেওয়াজ শিপু:

যেদিন থেকে জিমে যাওয়া শুরু হলো সেদিন থেকে অনেক মানুষের সাথে পরিচিত হচ্ছি, তবে সেখানে বাঙালিদের সংখ্যা সেই তুলনায় অনেক কম।
কিছুদিন আগে এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে গেল, যা কিনা ঘড়ির কাঁটার মতো সারাক্ষণ নক করছে। আমরা নারীরা দেশে যেমন সম্মান পাই না ঠিক প্রবাসেও একই অবস্থা। যতই পড়াশুনা বা ডিগ্রী অর্জন করি না কেন দিন শেষে আমাদের অবস্থান যে রান্নাঘরে সেটা সব জায়গায় প্রমাণ পাচ্ছি।

সেইদিন পরিচয় হলো এক বাঙালী নারীর সাথে, যার বয়স ৪৬ বছর। যেহেতু বাঙালী পেয়েছি সেহেতু মনের ভিতরে অনেক আনন্দ ও আগ্রহ কাজ করছিলো। মনে মনে তো খুবই খুশি এই ভেবে যে, অবশেষে জিমে একজন বাঙালী সঙ্গী পেলাম। এরপর কথা কথা বলতে বলতে দুইজন দুইজনের সম্বন্ধে অনেক কিছু জানলাম। সাথে তখন এক ইন্ডিয়ান নারীও ছিলো। আবার এই ইন্ডিয়ান ও বাঙালী নারী দুইজন আগের থেকে পরিচিত। এমনিতেই এই দেশে আসার পর থেকে একের পর এক শিক্ষা নিচ্ছি, যা হয়তো একেবারে হজম করাটা অনেক কষ্টের। তারপরও মাঝে মাঝে অনেক কথা গায়ে ঘেষঁতে দেই না কারণ আমরা জানি এক বাঙালীর সুখ আরেক বাঙালী সহ্য করতে পারে না। আর যেহেতু সম্মান প্রসঙ্গ নিয়ে কথা হচ্ছে, তাহলে আর কিছু নাই বলি।

এবার আসা যাক আসল কথায়। কথা প্রসঙ্গে সেই বাঙালী নারীটি বললো, তোমার কথাবার্তা আমার খুব পছন্দ হয়েছে, যদি কিছু মনে না করো তাহলে আমার বাসায় একজন মেয়ে দরকার যে কিনা বাসার সবকিছু দেখভাল করে রাখবে। সাথে সাথে আমিও বললাম, “দু:খিত, আমি আপনার কথা বুঝতে পারিনি। আবার বলুন।” খুব অবাক হলাম মহিলাটি আমার সম্পর্কে সবকিছু জানার পরও সে এই প্রস্তাবটি দিলো। বলতে গেলে এক কথায় তার কাজের মেয়ে দরকার সেই হিসেবে তিনি আমাকে প্রস্তাব দিলেন এবং সেই সাথে ব্রিটিশ পাসপোর্টের লোভও দেখালেন।

শাফিনেওয়াজ শিপু

আমার চেহারা দেখে মহিলাটি বললো, “এতো অবাক হওয়ার কী আছে, তোমাদের মতো শিক্ষিত মেয়েরা বিশেষ করে যারা ঢাকা থেকে আসে, তারাও এই ধরনের জব করে এবং পাসপোর্টের জন্য তারা যেকোনো জব করতে প্রস্তুত।”

ঠিক ঐ সময় ইন্ডিয়ান মহিলাটি বলে উঠলো, “তুমি এই মেয়েকে কেনো এই অফার দিচ্ছো? একটা শিক্ষিত ভালো পরিবার থেকে আসা এই মেয়েকে তুমি এই জবটি কেন অফার করলে? হয়তো মেয়েটির পাসপোর্ট নেই, তাই বলে তুমি তাকে এইভাবে বলবা? দয়া করে নিজের দেশের মানুষকে কদর বা সম্মান করতে শিখো, আর সম্মান করলে তোমার ব্যক্তিত্ব কমে যাবে না। বুঝলে!!!

যখন দেখলাম এই ইন্ডিয়ান মহিলাটি বাঙালী মহিলাকে বকা দিচ্ছে তখন আমার খুব খারাপ লাগছিলো এবং সাথে সাথে বলে আমিও বলে উঠলাম, “আসলে ওনার কোনো দোষ নেই। আজকে এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী আমরা বাঙালীরাই। শিক্ষাকে তো মূল্য দেই না, সাথে স্টুডেন্ট ভিসায় এই দেশে আসলে মনে করে গরীব পরিবার থেকে আসা এবং টাকার জন্য এই দেশে পড়ে থাকা। আর এইটা আমরা বাঙ্গালীরা খুব ভালোভাবেই প্রতিষ্ঠিত করেছি। এমনকি কাজের ক্ষেত্রেও আমরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছি, আমাদের নিজের দ্বারাই। সুতরাং এখন আর এগুলোতে মন খারাপ করি না। প্রথমদিকে অনেক কষ্ট হতো, তবে এখন নিজেকে মানিয়ে নিয়েছি, এবং সেই সাথে আর বুঝতে বাকি নেই যে, পাসপোর্টের ওজন ভারি সবকিছুর তুলনায়।”

ইন্ডিয়ান মহিলাটি বললো, “তুমি কিন্তু কষ্ট পেও না ওর কথায়। জানো আমরা কখনো আমাদের ইন্ডিয়ানদের সাথে এইভাবে কথা বলতে পারতাম না। কারণ আমরা বুঝি পড়াশুনার মূল্য কতোটুকু, আর এই দেশে স্টুডেন্ট ভিসায় আসা চারটে-খানেক কথা নহে। আর তাছাড়া আমাদের সময় হয়তো শিক্ষিত মানুষ কম এসেছিলো, কিন্তু এখন তো যুগ পরিবর্তন হয়েছে। তবে যাই বলি না কেন কখনো কাউকে এইভাবে নিচু করে দেখা উচিত নয়।”

তখন আমিও চিন্তা করছিলাম এজন্যই আজকে পুরো পৃথিবীতে ইন্ডিয়ানরা এতো এগিয়ে আছে সব দিক দিয়ে। আর আমরা সেই তুলনায় অনেক পিছিয়ে আছি শুধুমাত্র এই ধরনের মনমানসিকতার জন্য। শিক্ষা থেকে শুরু করে সবদিক দিয়ে সবাই অনেক উন্নতি করছে আমাদের তুলনায় আর আমরা এখনো পড়ে আছি পুরনো বেড়াজালে, যেখানে মানুষ অন্ধকারের মধ্যে জীবনযাপন করছে, হোক না সেটা ব্রিটেন কিংবা বাংলাদেশ।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.