ধর্ম যার যার, সহমর্মিতাও সবার

রনিয়া রহিম:

মুসলমানেরা যদি পূজোর সময়ে লাড্ডু খায়, তবে কেন ঈদের দিনে আমার হিন্দু বন্ধুকে আমি গরুর মাংস খাওয়াতে পারবো না, – সেই প্রসঙ্গে এই লেখা।

তার আগে, – একটি গল্প।

আমার এই (আমেরিকান) অফিসে একটি পলিসি আছে, যেটা ঠিকমতো মানা হয় না, আমাদেরই যেচে পড়ে কর্তৃপক্ষকে মনে করাতে হয়। তা হলো, প্রত্যেক তিন মাস পর পর প্রত্যেক ডিপার্টমেন্টের জন্য কিছু টাকা বরাদ্দ থাকে, তা দিয়ে আমরা ‘টিম বিল্ডিং’ ধাঁচের যে কোনো কিছু করতে পারি। মূলত কাজের সময়ে কিন্তু সরাসরি কাজের বাইরে কলিগদের নিয়ে কিছু করা, – বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই টাকাগুলো যায় একটু ভালো কোন রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ খাওয়ার ক্ষেত্রে। কিন্তু ঐ যে বললাম, এই ব্যাপারে আমাদের বসদের মাথাব্যথা কম, আমাদেরই মনে করে দিন-ক্ষণ-স্থান ঠিক করতে হয়, তাও দেখা যায় মিস হয়ে যায়।

সবচেয়ে শেষবার যখন হলো, তখন কোনো প্ল্যান ছাড়াই হলো। আমাদের ডিপার্টমেন্টের একটা সিস্টেম ক্র্যাশ করলো, যেটা ছাড়া আমরা বিকল, তাও করলো লাঞ্চের পর পর, – পুরো অর্ধেকদিন বাকি তখনও বাড়ি ফেরার আগে। এক দু ঘন্টার মধ্যেও যখন ঠিক হলো না, কোন একজনের মাথায় এলো, – আরেহ, এবারের কোয়ার্টারলি টিম বিল্ডিং তো করা হলো না, চলো, কোথাও যাই! লাঞ্চ খাওয়া শেষ, তাহলে খাওয়াদাওয়ার ক্ষেত্রে বাকি থাকে “হ্যাপি আওয়ার”। এই টার্মটা আমি আমেরিকান কর্মজীবনে শিখেছি, – অফিস টাইমের পরপরই ড্রিংক করতে যাওয়া, সচরাচর কলিগদেরই সাথে। আমাদের ডিপার্টমেন্টের বাকি সবাই ড্রিংক করে, ওরা সবাই যখন উৎসাহ নিয়ে আলাপ করছে আশপাশে কোথায় কী ভালো, একজন আমার দিকে ফিরে বললো, রনিয়া, তুমি কোথায় যেতে চাও?

প্রায় বেশিরভাগ রেস্টুরেন্টেই এলকোহল সার্ভ করা হয়, সব সুপারমার্কেটে বিক্রি করা হয়, – আমি নিজে পান করি না, আর অন্যরা করলেও আমার মাথাব্যথা হয় না। আমি সেটাই বললাম, – এমন কোনো জায়গা ঠিক করো যেখানে আমি জুস্ বা আইসক্রিম বা কোন স্ন্যাক্স খেতে পারি, তাহলেই আমি ঠিক আছি। সেই কলিগ খুব জোর গলায় বললো, না না, তুমি চাইলে এমন কোনো জায়গাই ঠিক হবে যেখানে আমরা কেউ কোনো এলকোহল খেতে পারবো না, – তুমিও আমাদের টিমের অংশ, তোমার কোন কিছুতে অস্বস্তি থাকলে আমরাও সেসবে যাবো না। – এই কলিগ খুব বোঝে কোন ড্রিঙ্কস কোন ব্র্যান্ড কোনটা ভালো, সে কিছুক্ষণ আগেই সবাইকে বোঝাচ্ছিলো কোন রেস্টুরেন্টে গেলে কার কোন পানীয়টা ভালো লাগবে, – তারই হঠাৎ খেয়াল হলো, আরেহ, আমাদের ডিপার্টমেন্টের আরেকজনও তো আছে, যে চুপচাপ আমাদের আলোচনা শুনছে, যে নিজে এসবের ধারে নেই, – আমাদের “টিম বিল্ডিং”-এ তো টিমের এই মেয়েটিকেও চাই!

আমরা সেবার একটি রেস্টুরেন্টে গিয়েছিলাম, যেখানে বিভিন্ন বোর্ড গেমও আছে। বাকিরা যে যার মতো পানীয় অর্ডার দিলো, আমি খেলাম দুই দুই বিশাল স্কুপের আইসক্রিম, আর ভীষণ হাসাহাসির মাঝে মজার মজার সব খেলা চললো। মনে হচ্ছিলো সেদিন অফিসের কলিগদের সাথে নয়, স্কুলের বন্ধুদের সাথে হাহাহিহি করতে এসেছি।

কিন্তু শুধু মজার খেলা বা আইসক্রিম নয়, আমার বিশ্বাসের প্রতি আমার বাকি কলিগদের শ্রদ্ধা আর সংবেদনশীলতা কি সেই আনন্দের অন্যতম উৎস ছিলো না? মনে করুন যদি উল্টোটা হতো, ওরা আমাকে জোর করে নিয়ে গেলো সেখানে, অথবা, যাওয়ার পর আমার উপর জোর করতে থাকলো, “একদিন খেলে কিছু হয় না, খাও খাও!” তখন আমার কেমন বোধ হতো? কর্পোরেট আমেরিকায় এমনিতেও এই কাজটি বেআইনি হতো, কিন্তু তাদের কথা ও কাজে কি আমার সেদিন শান্তি বোধ হয়নি, যে কেবল আইনের কথা ভেবে নয়, আমার মনের আনন্দের কথা চিন্তা করেও আমার জন্য কোন বিরূপ পরিস্থিতি তারা সেদিন সৃষ্টি করেনি? (- এই বেলা বলে রাখি আমেরিকানরাও মানুষ, ফেরেস্তা নয়, অর্থাৎ, এখানেও ভালোমন্দ আছে, গোঁড়ামি ও ভাঁড়ামি আছে, – এমন জোরজবরদস্তির গল্পও এখানে কম নেই। সেদিন আমার সাথে চমৎকারটাই ঘটেছে, গল্পটা তাই সেটি নিয়েই।-)

এই গল্পটারই সূত্র ধরে বলি, – মনে করুন, আমি নিজে খেতে চাইলাম, তখন সেটির দায়ভার কি তাদের উপর? না, – ওরা যদি জোর করতো, তবেই দায় তাদের। আমি যদি খুশিমনে নিজ থেকেই চাখতাম, তবে সেটি আমার নিজস্ব হিসেব। আমার কলিগদের এইটুকু ধারণা আছে আমার ধর্ম এই ব্যাপারে কি বলে, তাই তারা সংবেদনশীলতা থেকেই নিজ থেকে খাওয়াতে চাইবে না। যদি কোন কারণে না জেনে করে থাকে, তবে আমি একবার বলার পরে করলে তখন ফের দায়ভার তাদের উপর বর্তাবে।

ঠিক তেমনই, – আমরা কমবেশি সবাই জানি, আমাদের হিন্দু বন্ধু, সহপাঠী বা কলিগ তাঁদের ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে গরুর মাংস খাবেন না। আমরা যদি “কিছু মুসলমান পূজোয় ওদের মিষ্টি খায়” অজুহাতে আমাদের কোরবানির মাংস তাঁদের খাইয়ে দেই, বা অতদূর না গেলেও, খাওয়ানোর ইচ্ছেটুকু পর্যন্ত প্রকাশ করি, – তবে কী দাঁড়ায় বলুন তো?

তবে দায়ভার আপনার এই মুসলমান কাঁধেই এসে যে পড়ে! এমন মুসলমান যেমন আছেন যারা এলকোহলিক পানীয় বা শুকরের মাংস খেয়েছেন কখনও, হয় নিয়মিত কিংবা একবার কখনও কৌতূহলের বশে, এমন হিন্দুও নিশ্চয়ই আছেন যিনি গো-মাংস মুখে তুলেছেন। কিন্তু সে হিসেবটা একান্তই তাঁর নিজস্ব; – আপনি ভিন্নধর্মের হয়ে আপনার ধর্মের অনুমোদিত কর্মগুলো কেন অন্যের উপরে আরোপ করতে যাবেন? এতে কি আপনার বন্ধু, সহপাঠী বা কলিগের মনব্যথার কারণ ঘটে না, মনের শান্তির ব্যাঘাত ঘটে না, তিনি কি বিরক্ত বা বিব্রত বোধ করেন না? নিশ্চয়ই করেন! আপনি যখন খুব সহজেই তাই আলাপে কিংবা স্ট্যাটাসে এই অমর বাণী কপচান, – “মুসলমানেরা যদি পূজোর সময়ে লাড্ডু খায়, তবে কেন ঈদের দিনে আমার হিন্দু বন্ধুকে আমি গরুর মাংস খাওয়াতে পারবো না?” – সেটি তবে কার জন্য ভালো? আদৌ কি কারো?

আপনার ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে আপনি সবিনয়ে পূজোর প্রসাদ খাওয়া থেকে বিরত থাকতেই পারেন, আপনার মুসলিম বন্ধুটি যদি খুশিমনে খেয়ে থাকে তো আপনি তার প্রতিও শ্রদ্ধা রেখে তার সাথে অংশ নাও নিতে পারেন, – কিন্তু আপনি কি তাই বলে আপনাদের হিন্দু সুহৃদদের এমন করে খোঁচাতে পারেন?

ধর্ম যার যার, উৎসবও মতবিরোধে যার যার কিংবা সবার, – কিন্তু শ্রদ্ধা, সংবেদনশীলতা, সহমর্মিতা, এইগুলো কি নির্বিশেষে আমরা প্রত্যেকটি মানুষ সচেতনে আয়ত্বে আনতে পারি না?

#ধর্ম_যার_যার_সহমর্মিতা_সবার

শেয়ার করুন: