শাহরিয়া খান দিনা:
টেলিভিশন টক শো’তে একজন নারী বক্তার প্রশ্নের উত্তরে ক্ষেপে গিয়ে দেশের একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি বলছেন, ‘চরিত্রহীন’! প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ব্যক্তিগত এই আক্রমণ কতোটা ভদ্রতার পর্যায়ে পড়ে, বা তার শিক্ষাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে কিনা সেটা গুণীজনরা নিশ্চয়ই বলতে পারবেন।
ঘটনা হচ্ছে, একাত্তর টিভির টকশোতে ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেনকে প্রশ্ন করেছিলেন সাংবাদিক, লেখক মাসুদা ভাট্টি। প্রশ্নটি ছিল, জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ায় মঈনুল হোসেন জামায়াতের প্রতিনিধিত্ব করছেন কি না?
প্রশ্ন শুনেই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেছেন মঈনুল সাহেব। এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি রেগে গিয়ে যা বলেছেন, তা এরকম- আপনাকে আমি একজন চরিত্রহীন বলেই মনে করি। আপনার প্রশ্নের উত্তর দিতে চাচ্ছি না।
এক পর্যায়ে ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেন মাসুদা ভাট্টিকে একজন ‘শিক্ষিত ভদ্রমহিলা’ হিসেবে প্রশ্ন করতে বলেছেন। অর্থাৎ উনার কাছে একজন সাংবাদিক, লেখক পরিচয়ের চেয়ে তার ‘মহিলা’ পরিচয়টাই বেশ স্পষ্ট হয়েছে। আর ‘শিক্ষিত ভদ্রমহিলা’ বলতে উনি কী বুঝাতে চেয়েছেন তা উনিই হয়তো ভালো জানেন। তার মানে মাসুদা ভাট্টির প্রশ্নটা ‘অশিক্ষিত অ-ভদ্রমহিলা’র মতোন মনে হয়েছিল?
তো যেটা বলতে চাচ্ছি, যুগ যুগ ধরে নারীকে চুপ করানোর মোক্ষম হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছে এই ‘চরিত্রহীন’ শব্দটা। নারী তার প্রাপ্য অধিকার চাইছে? সম্মান আদায় করে নিতে চাইছে? যা ইচ্ছে চাপিয়ে দাও মেনে নিচ্ছে না? মুখের উপর সত্যিটা বলছে? ব্যাপার না! প্রচার করে দাও সে চরিত্রহীন নারী। তবেই তুমি হবে সহীহ্। একজন পুরুষ হিসেবে তথাকথিত ‘শিক্ষিত’ মঈনুল সাহেবের মাথাতেও একই জিনিস বিরাজমান!
এই ধারণাটা সমাজের এতো উঁচু পর্যায়ের ব্যক্তিদের মানসিকতায় গেঁথে থাকাটা সত্যিই দুঃখজনক। যারা দেশের গণতন্ত্র, ঐক্য, অধিকার নিয়ে কথা বলেন, তারা যদি একজন নারীকে প্রকাশ্যে এভাবেই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেন তো তাদের ভেতরটা সহজেই অনুমেয়। তাদের নীতিকথাও যে ফাঁকা বুলি না তা বিশ্বাস করাটা কঠিন।
অনুষ্ঠানটি যারা দেখেছেন খেয়াল করেছেন ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেনের বডি ল্যাংগুয়েজ! চোখ নাক মুখ দিয়ে অভদ্রতা ছিটকে বের হচ্ছিল। কেমন মারমুখী! ন্যুনতম সম্মানবোধ ছিল না তার কথায়। উনি অন্যকিছু বলতে পারতেন, কিন্তু প্রশ্নকর্তা নারী বলেই হয়ত খুব সহজেই উনি বলে দিয়েছেন, ‘আপনি চরিত্রহীন।’ আচ্ছা, মাসুদা ভাট্টি’র স্থানে একজন পুরুষ সাংবাদিক হলে উনি কি এভাবে বলতে পারতেন? একই শব্দ চয়ন করতেন?
আরেক বার প্রমাণ হলো, হাজার বছর ধরে নারীকে হেয় করার, পথ রুদ্ধ করার, আবদ্ধ করার এই যে এক প্রাচীন কৌশল, তার থেকে বেরোতে পারেননি আমাদের তথাকথিত এলিট সোসাইটির সুধীজনেরাও। আধুনিকতার মোড়কে যতই ঢাকা হোক, কখনো কখনো মুখোশটা খুলে পরে আসল চেহারাটা বেরিয়ে আসে ঠিকই।
সমাজের একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তির কাছ থেকে এমন অশোভন বক্তব্য কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। প্রশ্নটা যদি তার পছন্দ না হতো তবে তিনি অন্যভাবে বলতে পারতেন কিংবা উত্তর নাও দিতে পারতেন। কিন্তু একজন নারী সাংবাদিকের সাথে তার এমন অশোভন ব্যবহার সমাজকে কী বার্তা দিচ্ছে!
কোনো নারী ‘চরিত্রহীন’ শুনলেই তার সমাজ বন্ধ হয়ে যাবে সেই সময়টা পালটেছে কিছুটা হলেও নিশ্চয়ই। অনেকেই জেনে গেছে এখন, পুরুষের যখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায়, অক্ষমতা পেয়ে বসে তখনই সে নারীর গায়ে চরিত্রহীনের তকমা লাগাতে ব্যাকুল হয়ে যায়।
সমাজের মুষ্টিমেয় কতিপয় নষ্ট মানুষ কর্তৃক ‘চরিত্রহীন’ ট্যাগ পাওয়া কন্যারাই আসল সাহসিকা। দ্বিধাহীন সম্মান তাদেরই প্রাপ্য।