সারা বুশরা দ্যুতি:
শোন রে বোকা মেয়ে, সারা মাস কষ্ট করে চাকরি করে নির্দিষ্ট কিছু টাকা পাওয়ার চেয়ে নিজের সংসারের জামাইয়ের অঢেল টাকা খরচ করা অনেক আরামের, অনেক শান্তির। বুঝলি? তোকে যে আমি কতটা হিংসা করি তা যদি জানতি! এতো বড় বাড়ি, এতো টাকা পয়সা, এতো সুখ সাচ্ছন্দ্য উফফ! তার উপর এরকম লাভিং একটা হাসব্যান্ড, তোকে তো পুরাই চোখে হারায়। চাওয়ার আগেই সব হাজির করে তোর কাছে।
তাই বুঝি? নেহার গলায় ব্যঙ্গ।
তাই-ই তো! মুখটা অমন করে ফেললি কেন আমার কথা শুনে? কীসের এতো অসন্তোষ তোর? এই সব দুঃখ বিলাস বাদ দে, জানিস কত মেয়ে তোর মতো এরকম একটা দারুণ জীবন কামনা করে, সাধনা করে, তবু পায় না। আর তুই, এতো কিছু পেয়েও অবহেলা করিস।
নেহা জানে, তন্বী কখনোই বিনা কারণে কিছু বলে না। তবু নিজের ঘাড়ে এই দোষ সে নিতে পারলো না। এক হতাশ ক্ষোভে উত্তর দিলো, সব জেনেও তুই এটা বলতে পারলি তন্বী? আমার যে এতো বছরের কষ্টের পড়াশুনা, সেগুলো কোনো কাজে লাগলো না, সেটা কি তোর কষ্টের মনে হয় না? নিজে রোজগার করার আনন্দ কোনোদিন বুঝলাম না….আমার সার্টিফিকেটগুলো অকেজো হয়ে আলমারির এক কোণায় পড়ে রইলো, এটা কি হাসিমুখে মেনে নেয়ার মতোন ব্যাপার বলে তোর মনে হয়?
শোন নেহা, কিছু পেতে গেলে কিছু ছাড় তো দিতেই হয় রে… একটা মেয়ে আমাকে দেখা যে নিজের জীবন নিয়ে হান্ড্রেড পার্সেন্ট হ্যাপি? আমার মতো যারা ঘরে বাইরে দু জায়গায়ই দিনরাত খেটে মরছি, তারা কি নিজেদের নিয়ে খুব সন্তুষ্ট? আর তাছাড়া তোর তো কোনোকিছু করতে মানা নেই… আমি নিশ্চিত তুই বাইরে কাজ করতে চাইলে তোর স্বামী বাধা দিবে না।
তোর ধারণা ভুল। ও আমাকে সবসময় বলে, আমার সব টাকা তোমার। তুমি যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে খরচ করো… তোমার বাইরে কাজ করার কোনো দরকার নেই… যেদিন আমি কিছুর অভাব রাখবো, সেদিন যেও রোজগার করতে। যতদিন আমি তোমার সব চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম, ততদিন তোমার নিজের রোজগার করতে হবে না।
এতোক্ষণ দুই বান্ধবী নিত্যকার ঢঙে গল্প করলেও এবার তন্বী উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলো ,ইশ কী ভালো রে তোর জামাই। আমার জামাই যদি এমন হতো, তাহলে সব কিছু বাদ দিয়ে শাবানার মতো পতিসেবা করতাম রে!
নেহা ভ্রূকুটি করে উত্তর দেয়, কী যে বলিস? ভাইয়া তো কতো ভাল…।
হাহাহাহা, দূর থেকে সর্ষে বাড়ি ঘনই লাগে। যে ঘর করে সেই শুধু জানে তার আসল চেহারা।
কেন? উনিও তো তোকে চোখে হারায়, সব শখ আহ্লাদ পুরা করতে চেষ্টা করে।
তন্বী বিরস মুখে বলে, কী করে বুঝলি? নাহ…তুই সত্যি বোকা। ফেসবুকে ছবি দেখে ধরে নিলি আমরা কত সুখে আছি! আরে, ফেসবুকের মতো ফেক জিনিস দুনিয়াতে নাই…যা দেখা যায় সবই ধোঁকা। এখানে আমরা শুধু ভালো জিনিসগুলা শো করি… ভেতরের অন্ধকার কেউই কাউকে দেখায় না….যাকে দেখে মনে হয় পারফেক্ট লাইফ, তার লাইফই সবচেয়ে ইম্পারফেক্ট ভেবে নিবি।
যাহ, কী বলিস? নেহার চোখে মুখে অবিশ্বাস!
ঠিকই বলি…আমারটাই ধর না কেন? আমার জামাইকে তোর মহান মনে হয়…কারণ সে আমাকে কোনো অত্যাচার করে না, গায়ে হাত তুলে না, মধ্যবিত্ত হওয়া সত্ত্বেও মোটামুটি চেষ্টা করে আমার টুকটাক শখ পূরণ করতে, তার মদ গাঁজা জুয়া এসব কোনো বাজে অভ্যাস নেই। কিন্তু তুই কি জানিস, সে নারী জাতিকে সমাজের থার্ড ক্লাস সিটিজেন মনে করে? মেয়ে মানুষ মানেই অল্পবুদ্ধি এটা ভাবে? দুনিয়াকে দেখায় সে খুব ব্রড মাইন্ডেড, কারো মুখাপেক্ষি না… অথচ মনে মনে চায়, আমি তাকে অনেক টাকা রোজগার করে এনে দিবো।
কী যে বলিস তন্বী তুই! তোর জামাই এতো শিক্ষিত, এতো ভদ্র মানুষ, উনি কেন তোর ইনকামের দিকে তাকিয়ে থাকবেন?
সেটা তো আমারও কথা রে নেহু মনি, একজন সত্যিকারের যোগ্য পুরুষের কেমন হওয়া উচিত বল? যে বলবে, ‘আমার টাকায় সংসার চলবে, আর তোমার টাকা তুমি যা ইচ্ছা তাই করো, হয় জমাও, না হলে নিজের মা বাবাকে দাও…আমাকে কিছু হিসেবে দিতে হবে না, আমি জানতে চাই না, তোমার টাকা শুধুই তোমার।’ ওরকম বললেই না সেই স্বামীর প্রতি শ্রদ্ধা আসবে। তখন তো আমি নিজে থেকেই বলবো যে, না সংসার যখন দুজনের, তখন আমিও সংসারে কন্ট্রিবিউট করতে চাই… তোমার লাগুক কি না লাগুক, আমি নিজে থেকে দিবো।”
কিন্তু আমি কোনোদিন ওরকম বলার সুযোগই পেলাম না…কারণ আমার সাথে কোনোদিন এমন হয়নি। উল্টা সে আমাকে যখন তখন প্রেশার দিয়ে বলে আমি আরও বেশি টাকা কেন সংসারে দিচ্ছি না? একদিকে তুমি নারীদের তুচ্ছ ভাববে, তাদেরকে সম্মান করবে না, নারীকে তোমার অধীনস্থ মনে করবে, আবার আরেকদিকে সেই নারীর কামাই করা অর্থের দিকে তাকিয়ে থাকবে, সেটা নিতে তোমার পৌরুষে লাগবে না, বরং আরো বেশি বেশি চাইবে। এ কেমন চরিত্র? শুধু মদ খেলে আর পরনারীতে আসক্ত হলেই মানুষ খারাপ হয় না, এরকম নিচুশ্রেণির মানসিকতার লোকও খারাপ রে।
আফসোস, এই সমাজ এদেরকে খারাপ হিসেবে অভিহিত করে না!
তন্বীর কথা শুনে অনেকক্ষণ চুপ করে রইলো নেহা। তারপর আস্তে বললো, কারণ সমাজ মনে করে যে পুরুষ বৌ ছেড়ে আরেকদিকে পা বাড়ায়নি, সে শুদ্ধ পুরুষ। তার বাকি সব মাফ।
সেটাই দুঃখ, সেটাই আক্ষেপ। স্বামী-স্ত্রী একটা সময় পরে দুজন দুজনের অভ্যাসে পরিণত হয়… যেটাকে কেউ বলে মায়া আর কেউ ভালবাসা। কিন্তু এই বন্ধনের মধ্যে শ্রদ্ধাটাও তো থাকতে হবে…সেটা না থাকলে সম্পর্ক যে কতটা ভারী হয়ে যায়, তা ভুক্তভোগিরাই শুধু বুঝবে। শারীরিক, মানসিক, অর্থনৈতিক সব রকমভাবেই তো সংসারের জন্য করলাম! ষোলো আনা করার পরও আমার সম্মান নেই। আমার মতামতের কোনো দাম নেই, ভাল মন্দ কিছু বলার কোনো অধিকার নেই। সমাজের চোখে আমি স্বাবলম্বী, কিন্তু নিজের ঘরে আমার কোনো পজিশন নেই। এ কারণেই তোর জীবনটাকে আমি ভালো বলি রে, তোর স্বামী না হয় রোজগার করতে বারণ করেছে, কিন্তু সে তোকে কখনো অসম্মান অন্তত করেনি।
ওরকম মনে হয়, অতোটাও সুখের নয় রে তন্বী। একটা গিফট কিনতে গেলেও মনে হয় ওর টাকা দিয়ে ওকেই গিফট দিচ্ছি? খুব অস্বস্তি লাগে। তারপর আম্মু আব্বুকে মন খুলে কিছু দিতে পারি না। তারাও নিতে চান না জামাইয়ের টাকা। আজ এটা যদি আমার নিজের ইনকাম এর টাকা হতো, তাহলে আমি জোর করে, বকে, অধিকার নিয়ে আম্মু আব্বুকে দিতে পারতাম! এগুলা হয়তো ছোট ছোট ব্যাপার। কিন্তু কষ্ট ঠিকই দেয়।
এবার বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তন্বী বলে, জানি না রে…আসলে ব্যাপারটা ঠিক নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিঃশ্বাস এর মতো। আর সত্যি বলতে কার লাইফটা বেটার, আর কারটা বেশি যন্ত্রণার, সেটা আমরা পরিমাপ করতেও পারবো না। কেউ কেউ আমার মতো নিজের আইডেন্টিটি থাকার পরও আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে ভুগে। আবার কেউ কেউ তোর মতো সবকিছু থাকার পরও নিজের একটা আলাদা আইডেন্টিটির জন্য ছটফট করে নেহু।
অদ্ভুত এক কলম দিয়ে বিধাতা আমাদের ভাগ্য গুলো লিখেন। তাই দুঃখ কষ্ট হাসি কান্না কোনো কিছুই কোনো নির্দিষ্ট ছকে ফেলা যায় না! শুধু দিন রাত্রি মাস ও বছরগুলো আমাদের দীর্ঘশ্বাসের সাক্ষী রয়ে যায়।
বেডফোর্ড, যুক্তরাজ্য।