প্রতিমা দাস:
আমার মনে হয়, বাংলাদেশের হিন্দুদের মধ্যে ৯০ ভাগ হিন্দুই গরুর মাংস বিষয়ক সাম্প্রদায়িক হেনস্থার শিকার।
এইরকম আমার দুটো অভিজ্ঞতা শেয়ার করছি।
আমি তখন পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ি।
নোয়াখালী এক প্রত্যন্ত গ্রামে এক হিন্দু বাড়িতে আমরা সপরিবারে থাকতাম। সেখানে কারেন্ট, বিশুদ্ধ জল, পাকা রাস্তা মার্কেট ডাক্তার কিছুই নেই। তবে যে বাড়িতে ছিলাম তা এককথায় অমরাবতী। চারদিকে নানা জাতের ফলের ফুলের বাগানে ভরপুর। কতরকম ফল আম জাম নারিকেল বড়ই পেয়ারা তেঁতুল… আর কত জাতের যে ফুল আছে..!! গুণে শেষ হবে না।সেইসময় আমার একমাত্র কাজ ছিলো স্কুল শেষে ভরদুপুরের গাছের তলায় ফল কুড়ানো।
আজও চোখ বন্ধ করলে, সেই গ্রামটার ভালোলাগা সুন্দর স্মৃতি ভেসে আসে।
যাই হোক, আমার দেরবছরের ছোট ভাইয়ের তখন খুব ঘন ঘন অসুখ করতো, আজ এই অসুখ কাল ওই অসুখ গ্রামে কোন ডাক্তার নেই। ঔষধের দোকান নেই, বাবা সেখান থেকে অনেকটাই দূরে গিয়ে উপজেলাধীন একটি ঘর ভাড়া নেয়। প্রচণ্ড মন খারাপ নিয়ে সেখান থেকে চলে আসি, সেইদিন বাগানের গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে খুব কেঁদেছিলাম।
অচেনা জায়গা.. নতুন ভাড়াঘর, সবার ঘরে টিভি ফ্যান রাস্তার পাশে বড় বড় দালান কিছুটা শহুরে ভাব। বাবা সেখানকার প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। বন্ধুপ্রিয় আমি, যথারীতি আমার নতুন তিন বান্ধবীও জুটে গেলো। তবে এরা আমার সেই গ্রামের ফেলে আসা ময়লা ছেঁড়া জামা পরা বন্ধুদের মতো না। কিছুটা ধর্মান্ধ।
কোন কারণ ছাড়া, আমার নতুন স্কুলের বন্ধুরা ঠিক করলো আমাকে সিঙ্গারা খাওয়াবে, যদিওবা ওরা চকলেট কখনো আমার সাথে শেয়ার করেনি। একটু অবাকই হলাম।
স্কুলের পাশেই ছিলো ভাজাভুজির দোকান। সেখানে চারবন্ধু দলবেঁধে গেলাম। আমেনা নামে যে মেয়েটি বন্ধু ছিলো সে সবার হাতে সিঙ্গাড়া তুলে দিলো। সবাই সিঙ্গাড়া খাচ্ছি খেতে খেতে দেখলাম আমার সিঙ্গাড়ায় কালো এক টুকরো মাংস, বন্ধু রলিকে বললাম এই তোরটাতে কি মাংস আছে? সে মাংসটি দেখে বললো, কী জানি, আছে মনে হয়। আরে খেয়ে নে, এটা তো মুরগির মাংস।
খাবো কী খাবো না মন কিন্তু সায় দিচ্ছিল না। কারণ আমার বাবা মুরগি ছাড়া আর কোনো মাংস ঘরে আনতো না, আর মুরগির মাংস তো কখনো কালো রঙের হয় না, এইসব ভাবতে ভাবতে একটু মুখেও দিলাম, স্বাদটাও দেখি অন্যরকম, খেয়াল করলাম তারা তিনজন খাওয়া বাদ দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমার সন্দেহ হলো, কেন আমি জানি না আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বার বার বলছে এটা গরুর মাংস, খাস না।
কী মনে হল, আমি দৌড়ে স্কুলের কলে গিয়ে সমানে কুলি করতে লাগলাম মুখের ভিতর আঙুল দিয়ে বমি করে দিলাম হাতের কাছে সাবান থাকলে আরো ভালো হত এমন অবস্থা তখন। একদিকে ওয়াক ওয়াক করছি আবার কল ছাপছি আর সমানে কেঁদেই চলেছি হায়রে আমার ধর্ম তো শেষ..আমি ও শেষ। নরকেও জায়গা হবে না।
হঠাৎ হাততালির শব্দে পিছন পানে তাকিয়ে দেখি আমার তিন বন্ধু বলছে কীরে, গরুরমাংস খুব মজা, না? তুই আজ থেকে মুসলিম, এই বলে তারা সজোরে হাসতে লাগলো, আর আমি তখনো কেঁদেই যাচ্ছি। হায়রে.. কারো কাছে এই ব্যাপারগুলো মজা, আবার কারও কাছে সাজা (এখন ভাবলে অবাক লাগে কত ছোট বয়সে ওদের মস্তিষ্কে ধর্মের বিষ ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে)
টিফিন পিরিয়ড শেষ হবার পর কয়েকজন স্যার আমাকে বুঝাচ্ছে, ওরে বেকুব মাইয়া, মোরগে দুনিয়ার পায়খানা ময়লা সব খায়, আর গরু খায় পরিষ্কার ঘাস লতাপাতা পেনা। গরুর মাংস খাবি তাহলে ব্রেইন হইব, আর তোমার বাপেরে এইসব কিছু কইয়ো না। বুজ্জইনি।
ভেবেছিলাম স্যাররা এদের শাস্তি দিবে। তা না করে…এই আমাদের শিক্ষাগুরু…!!!
ঘরে গিয়ে পুরোদিন বোবার মতো হয়ে গেলাম, ঠাকুরের ছবির সামনে গিয়ে বারবার মাফ চাচ্ছি যেন আমিই বড় অপরাধী। ওই ছোট বয়সটাই যা মনে এসেছে আর কী! তারপর মাকে সব ঘটনা খুলে বললাম, মাও ক্ষেপে গিয়ে বাবাকে সব বললো।
এমনিতে আমার বাবার মাথা সবসময় গরম থাকে, সেদিন প্রচণ্ডমূর্তি হয়ে হেডমাষ্টারকে ইচ্ছে মতো কথা শুনালো।
আপনার স্কুলে ছাত্রীদের এই শিক্ষা দেন? এতো ছোট ছোট বাচ্চা মেয়ে কী করে এতো সাম্প্রদায়িক হয়! আপনি আমাকে চিনেন? দরকার হলে থানায় গিয়ে এই স্কুলের বিরুদ্ধে মামলা করবো?
হেডটিচার লজ্জায় বিনীত হয়ে বললো, আমি তো এইসব কিছুই জানি না দাদা, বাচ্চারা এই নোংরামি কেন করলো? বাবা আবারো চিৎকার করে বললো, আমি এতো কিছু বুঝি না? আপনি এই ঘটনার বিচার করবেন। ব্যাস
এই বলে বাবা বেড়িয়ে গেলো।
আসলেই তো আমাদের হেডস্যার এইসব কিছুই জানতো না। হাসিখুশী প্রান্তবন্ত মানুষ ছিলেন। খুব পান খেতো, উনার সামনে গেলেই সারা মুখ পানের পিকে ভরে যেতো।
হেড স্যার সাথে সাথে আমার তিন বান্ধবীকে তাঁর রুমে নিয়ে গেলো। অন্য শিক্ষকদের ডেকে অনেক নীতিকথা শুনালো, শেষে এইটাই বললো আমার বন্ধুদের, যে এই সাদাসিধে মেয়েটিকে মুসলিম বানিয়ে তোদের লাভ কী? তার চেয়ে বরং রাস্তাঘাটে হিন্দুর ছেলের খোঁজ নে, তাগোরে মুসলিম বানাই নিকা কর। ফাজিল মাইয়ারা! যা ভাগ..!
এখন মনে হয়, স্যার যদি তাদের বাবা মাকে ডেকে সন্তানের কীভাবে ভিন্নমতাবলম্বীদের সম্মান করতে হয় সেই সম্পর্কিত ধারণা দিতো, সেটাই ভালো হতো। একজন শিক্ষক যদি শ্রেণিকক্ষে অসাম্প্রদায়িকতা নিয়ে শিক্ষা দেন, তাহলে একটি অসাম্প্রদায়িক সমাজ তৈরি হতে বাধ্য।
জীবনে আরো এই পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিলাম কলেজে পড়াকালীন। এক বিকেলে বান্ধবীর বাসায় গেলাম, সেদিন বান্ধবীর মা” খালাম্মা” ঘরে ছিলো না। বান্ধবীর চাচী ছিলো। তিনি খুব যত্ন করে আমাদের খিচুড়ি খেতে দিলো, এক চামচ মুখে দিতে দেখলাম সেখানে ছোট ছোট প্রচুর মাংস দেয়া। চাচীকে জিজ্ঞেস করলাম, এটা কীসের মাংস? উনি খুব স্বাভাবিকভাবে বললো, এটা গরুর মাংস।
উনাকে বললাম, আপনি তো জানেন আমি হিন্দু..? আপনি এটা কেন দিলেন?
সাথে সাথে উনি বলে উঠলো… এখন তো প্রায় হিন্দুরা গরুর মাংস খায়, তাই দিলাম।
আমি বললাম… কে খায় না খায় আমার দরকার নেই। তবে আমি খাই না। আমার বান্ধবীও অনুতপ্ত ছিলো সে জানতোই না, চাচী যে খিচুড়ির সাথে গরুর মাংস দিয়েছে।
সেদিন আবার বাথরুমে গিয়ে বমি করলাম।
এখন ভাবলে অবাক হই, যে পাঁচ বছর অশিক্ষিত মূর্খ চাষাদের সন্তানদের সাথে পড়েছি, তারা কখনো এই বিকৃত আনন্দ নেয়নি, উল্টো নিঃস্বার্থ ভালোবাসা দিয়েছে। আর যখন শিক্ষিত সমাজের সাথে বন্ধুত্ব হলো তারাই বেশি সাম্প্রদায়িক হেনস্তা করেছে।
গরু মাংস খাইয়ে হয়তো পৈশাচিক আনন্দ পাওয়া যায় কিন্তু হিন্দুদের কি জাত মারা যায়? তবে যে এই অন্যায় কাজটা করে সে কতটা নীচ হীন হিন্দু বিদ্বেষী তার প্রমাণ পাওয়া যায়।