শান্তা তাওহিদা:
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের ৩য় বর্ষের শিক্ষার্থীদের সমাজ ভাষাবিজ্ঞান পড়াতাম বছর তিনেক আগে। সেখানের একটা বিশাল অংশ ছিল ভাষার সাথে জেন্ডার সম্পর্ক। পড়াতে গিয়ে বাংলা ভাষার ব্যাকরণ, প্রবাদ প্রবচনে জেন্ডার বৈষম্য তীব্রভাবে অনুভব করেছি। কেবল ভাষা দিয়ে পুরুষতান্ত্রিক সমাজকাঠামো নারীকে কতখানি নিম্নতর অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত করেছে, তা ভাবলে যে কারোরই আমাদের পূর্বপুরুষদের রুচিবোধ নিয়ে প্রশ্ন জাগবে।
যদিও আমরা ব্যাপক সফলতার সাথে আদিম যুগ, মধ্য যুগ আর বেগম রোকেয়া যুগ পেরিয়ে আজ আধুনিক সভ্য যুগে এসে পৌঁছেছি। কিন্তু সত্যিকার অর্থেই কি পুরুষতান্ত্রিকতার বুননে নির্মিত সমাজের কোন গুণগত পরিবর্তন হয়েছে? উত্তরটি আমাদের সবার জানা। আমরা কেবল পোশাকে সুসভ্য হয়েছি, মননে নয়।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এর কল্যাণে দূরত্বতা তেমন অনুভব করি না। ৭ হাজার ৫০০ মাইল দূরে থাকলেও আমার বুকের মধ্যে বাংলাদেশটাকে লালন করি পরম আদরে। নিজের নামের পাশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থেকে শিক্ষক পরিচয়টি যুক্ত হয়েছে বছর ছয়েক হলো। তবু নিজেকে এখনও শিক্ষার্থী ভাবতেই ভাল লাগে। প্রায় চার বছর পড়িয়েছি ভাষাবিজ্ঞান বিভাগ ও যোগাযোগ বৈকল্য বিভাগে। কেমন পড়াই সেটা আমার শিক্ষার্থীরাই বলতে পারবে। নবীন শিক্ষক হিসেবে শিক্ষার্থীদের সাথে পড়েছি ও পড়িয়েছি।
নিজের সম্পর্কে এ কথাগুলো বলার পেছনে একটি উদ্দেশ্য তো অবশ্যই আছে। আমি যে ব্যাচের শিক্ষার্থীদের সমাজভাষাবিজ্ঞান পড়াতাম, তারা এ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫১ তম সমাবর্তনে অংশগ্রহণ করেছে। শিক্ষকতাকে পেশা নয়, বরং নেশা হিসেবে দেখা একজন নবীন শিক্ষক এর জন্য এটি অসম্ভব আনন্দের। ফেসবুকের পাতায় তাদের গর্বিত গ্রাজুয়েট, প্রজাপতি গ্রাজুয়েট, ভাবুক গ্রাজুয়েট এর মতো নানান শিরোনামসহ ছবিগুলো মন ভরিয়ে দিচ্ছিল গত কয়েকটা দিন। তার সাথে আমার প্রিয় শিক্ষার্থীদের মন খারাপের ইমো দেয়া ইনবক্সগুলো খুব কষ্ট দিচ্ছিল। গ্রাজুয়েশনের গাউন পরে আমার সাথে তাদের ছবি তুলতে না পারার কষ্ট আমাকে খুব ভাবিয়েছে। শিক্ষকতা জীবনের এই ছোট ছোট পাওয়াগুলো ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়।
এবার বরং মূল প্রসঙ্গদের অবতারণা করি, যে কারণে এই লেখাটি লিখতে বসা। সন্ধ্যার দিকে টুক করে একটা নোটিফিকেশন আসলো মোবাইল এ। অসম্ভব ভাললাগার অনুভূতি নিয়ে সমাবর্তনে যাওয়া একজন শিক্ষার্থীর ক্ষুদে বার্তাটি আমাকে খুব নাড়া দিল। সম্মানিত রাষ্ট্রপতিকে টিভির পর্দা ছাপিয়ে চোখের সামনে দেখতে আসার সুযোগটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষার্থীদের জন্য আনন্দের। কিন্তু সে আনন্দ এক লহমায় ম্লান হয়ে যায় মহামান্য রাষ্ট্রপতির একটি তুলনায়। শিক্ষার্থীর ক্ষুদে বার্তাটি পেয়ে ফেসবুকে ও ইউটিউবে মহামান্য রাষ্ট্রপতির বক্তব্যটি শুনি। কিছুক্ষণ পর দেশের একটি প্রধান দৈনিক পত্রিকায় সেই সস্তা বাজে তুলনাটিকে শিরোনাম করে করা নিউজটি পড়ি। যার হুবহু নিচে কোট করলাম-
(রাজনীতিও হয়ে গেছে গরিবের বউয়ের মতো -রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ
সরকারি ও রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের বড় পদে চাকরি শেষে রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার প্রবণতার কঠোর সমালোচনা করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। তাঁর মতে, এখন রাজনীতি হয়ে গেছে গ্রামের ‘গরিবের বউয়ের মতো’। এখানে কোনো নিয়মনীতি নেই। যার যখন, যেভাবে ইচ্ছা রাজনীতিতে ঢুকছে। রাজনীতির গুণগত পরিবর্তনের ক্ষেত্রে এটি অন্যতম বাধা। এ বিষয়ে সব রাজনৈতিক দলের চিন্তাভাবনা করা উচিত।
আজ শনিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫১তম সমাবর্তনে বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ এসব কথা বলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে অনুষ্ঠিত হয় সমাবর্তন।
স্বভাবসুলভ রসবোধ আর কিশোরগঞ্জের আঞ্চলিক ভাষার মিশ্রণে রাষ্ট্রপতি তাঁর বক্তব্যে কটাক্ষ করেছেন পেশাজীবী ও ব্যবসায়ীদের রাজনীতিবিদ বনে যাওয়ার প্রবণতাকে। আবদুল হামিদ বলেন, ‘আমাদের গ্রামে একটা প্রবাদ আছে, গরিবের বউ নাকি সবারই ভাউজ। অহনে যারা শহরে থাকেন, তাঁরা তো ভাউজ চিনবেন না, ভাউজ হইলো ভাবী। ভাইয়ের বউকে ভাবি ডাকি আমরা, গ্রামে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভাবীদের ভাউজ ডাকা হয়। আর গরিবের বউ হলে মোটামুটি পাড়া বা গ্রামের সবাই আইস্যা ভাউজ ডাকে। এহন রাজনীতি হয়ে গেছে গরিবের বউয়ের মতো। এখানে যে কেউ, যেকোনো সময় ঢুকে পড়তে পারে। কোনো বাধা বিঘ্ন নাই।’ )
… আমি বুঝতে পারলাম আমার শিক্ষার্থীর মনোবেদনার কারণ কী। কিন্তু নিজেই এতো বিব্রত হলাম যে, তার ক্ষুদে বার্তার আর উত্তর দেয়ার মুখ আর রইলো না। মহামান্য রাষ্ট্রপতি একজন খুব সাদামাটা সরল মনের মানুষ। সকলেই তাঁকে সেভাবেই চেনেন, সম্মান করেন। তার বক্তব্যে কোন কৃত্রিমতা নেই। এমনকি নিজের আঞ্চলিক ভাষাকে ঘঁষে মেজে তিনি প্রমিত বলেন না। ভাষাবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী হিসেবে ভাষার আঞ্চলিকতা আমি দেখি ভাষার বৈচিত্র্য হিসেবে। একই গোলাপের নানান রঙয়ের মতো আমাদের বাংলা ভাষা। আমার মা মহামান্য রাষ্ট্রপতির এলাকার মেয়ে। ছোটবেলা থেকে মাকে এভাবেই কথা বলতে শুনেছি। তাই ভাষার আঞ্চলিকতা নিয়ে আমার কোন বিরাগ নেই। মায়ের কাছে শুনেছি কিশোরগঞ্জ জেলার মানুষগুলো খুব সহজ সরল মনের হয়। এটুকু পর্যন্ত মেনে নেয়া যায়। সরল মনের মানুষ মহামান্য রাষ্ট্রপতি কোন ভণিতা না করেই যা মনে আসে তাই বলতে ভালবাসেন। এমনকি নির্ধারিত লেখা বক্তব্য খুলেও দেখেন না।
আমি ব্যক্তিগতভাবে তাঁকে অসম্ভব শ্রদ্ধা করি। সেই শ্রদ্ধাবোধটির জায়গাটিতে ভীষণভাবে আঘাত হেনেছে তাঁর উদ্ধৃত প্রবাদ, গরিবের বউ নাকি সবারই ভাউজ। আমি মানছি, তিনি রাজনীতির বর্তমান পরিস্থিতিকে বোঝাতে এই রুপকের ব্যবহার করেছেন। কিন্তু এখানে আর্থ সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে একজন নারীকে কতখানি নিচে নামানো হয়েছে তা এসএসসি পাশ করা একজন শিক্ষার্থীর পক্ষেও না বোঝার কথা নয়। আর এই আয়োজনটি ছিল ২১ হাজার স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাশ করা শিক্ষার্থীদের। যার অর্ধেক অংশ ছিল নারী শিক্ষার্থী। একজন নারীর স্বামীর অর্থনৈতিক মানদণ্ডে নারীকে সহজলভ্য করে দেয়ার এই সস্তা-বাজে প্রবাদ আবারও প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেল যেন।
সমাজে নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক প্রবাদ প্রবচনগুলো আমার ধারণা ছিল হারিয়ে গেছে। ৫১তম সমাবর্তনে নারীকে সহপাঠী হিসেবে সমমর্যাদায় পৃথিবী গড়ার স্বপ্ন দেখতে ২১ হাজার কারিগর আপনার কাছে এই তুলনা আশা করিনি মাননীয় রাষ্ট্রপতি মহোদয়।
আমাকে ক্ষমা করবেন হে পরম হিতৈষী। আপনার সরলতা, হাস্যরস ছাপিয়ে আজ মরমে বিঁধেছে এই এক তুলনা। হে পরম হিতৈষী, আপনি এই রুপে, এই ভাষায় বড় বেশি বেমানান।
আমাকে ক্ষমা করবেন হে পরম হিতৈষী।
সহকারি অধ্যাপক, যোগাযোগ বৈকল্য বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
৭ অক্টোবর, জার্মানি