নারীর শরীর, ইচ্ছা/অধিকার বনাম জবরদস্তি

ঈশিতা বিনতে শিরিন নজরুল:

পাবলিক হেলথ নিয়ে একটি গবেষণার কাজে কোনো একটি সরকারি হাসপাতালের ওটির সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ভেতর থেকে দু’ধরনের চিৎকার ভেসে অাসছিল। ‘রোগী‘র আর ডাক্তারের। আশেপাশের সবাই মুখ পাংশু করে দাঁড়িয়ে ছিল। তাদেরও সিরিয়াল রয়েছে।

‘হারামজাদী পেট বাঁধাবি, আবার চিৎকারও করবি!! খবরদার একটা শব্দ যেন না শুনি। পেট বাঁধানোর সময় তোদের মনে থাকে না?’ এই বলে আরও নানারকম গালির শব্দ ভেসে অাসতে থাকলো। খানিকক্ষণ পরেই ক্লান্ত, বিধ্বস্ত একটি মেয়েকে ধরে হাঁটিয়ে ওটি থেকে বের করে পাশের ঘরে শুইয়ে দেয়া হলো।

এই ঘটনা শুনে এখনই ছি: ছি: চিৎকার করতে বসবেন না, ধর্ম নিয়েও আলোচনায় বসবেন না দয়া করে। যাদের এসব বিষয়ে সুড়সুড়ানি রয়েছে, তাদের অবগতির জন্য জানাচ্ছি, সেই মেয়েটি ছিল বিবাহিত। এমনকি এধরনের বেশিরভাগ কেসেই তুলনামূলকভাবে বিবাহিতদের সংখ্যা বেশি থাকে। এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, তারা কেউই নিজের ইচ্ছায় গর্ভপাত করাতে আসেন না! কারও স্বামী বা শ্বশুরবাড়ির মানুষের প্ররোচনায়, কেউ বা অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে কিংবা মরতে মরতে বেঁচে গিয়ে গর্ভপাত করাতে আসে।

মরতে মরতে বেঁচে গিয়ে কী রকম? একজনের স্বামী বললো, বাচ্চা নষ্ট করে ফেলো, স্ত্রী বাচ্চা নষ্ট করতে চায় না। অনেক মারধরের পরেও যখন ‘পেটের মাল খালাস’ করতে রাজি করানো যায়নি, তখন শাশুড়ি কী এক শিকড় খাইয়ে দিয়েছে! তারপর থেকেই মুখ দিয়ে ফেনা বের হচ্ছে, রক্তে ভেসে যাচ্ছে! পড়িমরি করে হাসপাতালে এনে তুলেছে! স্বামী নবাবজাদা আসেনি, আর শ্বশুরবাড়ির মানুষের ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছিল তারাও কেটে পড়ার তাল করছে। আমি হতভম্ভ হয়ে তাদের কার্যকলাপ দেখছিলাম।

এটি প্রতিদিনের ঘটনা।  এর পোশাকি নামও রয়েছে, ফোর্সড অ্যাবরশন।

ঈশিতা বিনতে শিরিন নজরুল

অনিরাপদ গর্ভপাতজনিত মাতৃমৃত্যু কমানোর জন্য বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৪ সালে “ মাসিক নিয়মিত করণ” – (Menstrual Regulation) সংক্ষেপে যা এম. আর. নামে পরিচিত, এই পদ্ধতি চালু করে। মায়ের জীবন রক্ষা ছাড়া অন্য যেকোনো কারণে স্বপ্রণোদিত গর্ভপাতকে অবৈধ করা হয়েছিল।

বাংলাদেশে সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী কেবলমাত্র এম. আর. প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ডাক্তার মাসিক বন্ধের ১০ সপ্তাহ পর্যন্ত এবং প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা মাসিক বন্ধের আট (৮) সপ্তাহ পর্যন্ত মাসিক নিয়মিত করণ “( Menstrual Regulation) সেবা দিতে পারবেন। এই সেবাটি অনুমোদিত।

কিন্তু, ঘটনা অন্যরকম। এই সেবাটি এখন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গর্ভপাত করানোর সেবার সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে। নানারকম ক্লিনিকে এম আর সেবার নামের ছায়ায় ডাক্তার থেকে শুরু করে অনভিজ্ঞ আয়াও এই কাজ করে নারী শরীর এবং ভবিষ্যত মাতৃত্বকে হুমকির মুখে ফেলছে। যখন কোনো ক্লিনিক বা হাসপাতালে সম্ভব হয় না, তখন স্থানীয় পদ্ধতি ব্যবহার করতে পিছপা হয় না।

এই মেয়েটিই পরে যখন মা হতে পারবে না, তখন এই স্বামীটিই তাকে তাড়িয়ে ‘বংশের বাতি‘র খোঁজে আরেকটি বিয়ে করবে। আর সেই মেয়েটির পরিচয় হবে ‘বাজা’! সমাজের কী নিষ্ঠুর খেয়াল!  একজন ক্যারিয়ার যিনি কিনা গর্ভধারণ করছেন, তার শরীরের ওপর তার কোনো হক নেই! তিনি সন্তান চান কী না চান, সেই ইচ্ছার কোনো মূল্য নেই!

আমি সবচেয়ে অবাক হই যখন একজন মা হয়ে আরেকজন মায়ের মাতৃত্বের মর্যাদা দিতে পারে না। পিল খাও, কপারটি নাও, যত যত কষ্টকর পদ্ধতি আছে, সব তোমার নারী শরীরটার জন্য। আর কনডমটি আপনি শিশুদের দিয়ে দিতে পারেন, তারা সেটি ফুলিয়ে বেলুন বানিয়ে খেলুক!

একজন নারী, তিনি নির্বাচন করবেন যে, তিনি কোনটি চান। সন্তানটি চান নাকি চান না। হ্যাঁ, অবশ্যই স্বামীর সাথে মিলে পরামর্শ করতে পারেন, যদি আদতেও সেই পরিবেশ থাকে। তবে সিদ্ধান্তটি নারীরই নেয়া উচিৎ নয় কি? এমনকি যার স্বামী চলে গিয়েছে, অথবা সে যদি বিবাহিত নাও হয়, সেক্ষেত্রের কিন্তু পরিবারের সকলে মিলেই জবরদস্তি করে অনিরাপদ গর্ভপাতের দিকে যেতে থাকেন। কারণ কী? মানুষ নানা কথা বলবে! তবে যার শরীর তার, সিদ্ধান্তগ্রহণের অধিকার, ইচ্ছার অধিকারও এতো ঠুনকো?

এভাবেই প্রতিদিন শতশত মাতৃত্বের অপমৃত্যু ঘটে, ইচ্ছার অপমৃত্যু ঘটে। একটি ছোট্ট প্রাণ শুরুর আগেই থেমে যায়।

একজন সন্তানকে আপনি কেমন পৃথিবীতে আনতে চান সেটি কিন্তু অাপনার হাতে। গর্ভপাত যেমন কাম্য নয়। তেমনি সঠিক পরিবেশে সন্তানকে আপনি মানুষ করতে পারবেন না, সেটিও কিন্তু কাম্য নয়। অাপনি বলবেন, কারও স্বামী চলে গেলে বা একজন অবিবাহিত মেয়ে গর্ভধারণ করলে উপায় কী? সেটি তার ওপর ছাড়ুন না কেন? সে কি পারবে এই দায়িত্ব নিতে, সেটি তাকে নির্বাচন করতে দিন! তিনি যদি বিশ্বাস করেন যে, কঠিন সমাজ ব্যবস্থার মাঝে থেকেও তিনি একা এই লড়াই লড়তে পারবেন, তবে আমি বা আপনি কেউ না তাকে বাঁধা দেয়ার।

শরীরটা তার, তাই তাকেই নাহয় সিদ্ধান্ত নেবার স্বাধীনতা ও অধিকারটুকু দিন।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.