গর্ভপাত নিয়ে আমার যতো ক্ষোভ

তামান্না ইসলাম:

কিছুদিন আগে ফেসবুকে একটা ছবি দেখলাম। ভয়ঙ্কর ছবি। কিছু ভ্রুণের ছবি। সাথে প্রশ্ন, আমরা কী অপরাধ করেছিলাম যে আমাদেরকে হত্যা করা হলো! অনেক ইমোশনাল কথাও ছিল সঙ্গে।

ব্যাপারটা আসলেই ইমোশনাল। মাতৃত্বের মতো মহান, আশ্চর্যজনক এবং অসাধারণ অভিজ্ঞতা আর আছে কিনা আমার জানা নেই। সন্তানের জন্য একজন মা যে ত্যাগ স্বীকার করে বা করতে পারে, সেটা অবিশ্বাস্য। মা-বাবার জীবনে সন্তান সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ। পৃথিবীতে এমন অনেক নিঃসন্তান দম্পতি আছে যারা শুধুমাত্র একটি সন্তানের জন্য যে কোনো কিছু ত্যাগ করতেও রাজি হবে। তারপরেও এই একই পৃথিবীতে অনেক মেয়ে বা দম্পতি গর্ভপাত না অ্যাবরশনও করে। কেন করে?

বুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই কিছু কিছু জিনিসকে খারাপ জেনে এসেছি। প্রধানত ধর্মীয় এবং দ্বিতীয়ত সামাজিক প্রভাবে। ছোটবেলা থেকে কখনোই এগুলো নিয়ে প্রশ্ন বা উল্টো যুক্তিও জাগেনি মনে। এর মধ্যে একটি হলো অ্যাবরশন। আবছাভাবে মনে পড়ে আজিমপুর কলোনির কিছু কিছু স্মৃতি। কোনো এক ডাস্টবিনে মরা বাচ্চা ফেলে কেউ চলে গেছে, সেই নিয়ে গোটা কলোনিতে হুলুস্থুল। শিশুমনেও তীব্র ঘৃণা বা অভিমান হতো, কারো মা কীভাবে এটা করতে পারে? সমাজের অনেক কদর্য দিকের সাথে তখনও পরিচয় হয়নি।

আস্তে আস্তে অনেক কিছুই জানলাম। আর সেই সাথে মনে জন্ম নেয়, যুক্তি আর উল্টো যুক্তি। মেয়েদের কী অ্যাবরশনের অধিকার থাকা উচিত নাকি উচিত না? এটা কি খারাপ কাজ নাকি খারাপ কাজ না? এ নিয়ে বহু বিতর্ক আছে। আছে অনেক আন্দোলন। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে যতটা জানি, এটা নিষিদ্ধ। তবে সম্ভবত কোথাও পড়েছিলাম ভ্রুণে হৃদস্পন্দন না আসা পর্যন্ত করা যায় (আমি নিশ্চিত না, উৎস মনে নাই। এ ব্যাপারে আমি আরও জানতে আগ্রহী)।

তবে ধর্মকে সরিয়ে যদি আলোচনা করি, তাহলে দুদিক থেকেই ভাবা যায়। ভ্রুণকে যদি একজন অনাগত প্রাণ ভাবি, তাহলে তাকে হত্যা করা আসলেই অমানবিক। কত মানুষ চেষ্টা করেও একটা সন্তানের মুখ দেখতে পারে না।
শুরুতে যেই ছবিগুলোর কথা বলছিলাম, সেগুলো দেখে আমার ভেতরে যে কষ্টটা হচ্ছিল, সেই কষ্টটা কিন্তু মিথ্যা না। ছোটবেলায় শোনা বা দেখা ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া শিশুটি মনে যে তীব্র আঁচড় কেটেছিল, সেই একই অনুভূতি ফিরে এসেছিল এই ছবিগুলো দেখে। প্রাণকে হত্যা করার অধিকার কি কারো থাকা উচিত? আর সেই হত্যাকারী যদি হয় সেই প্রাণের জন্মদাতা বা জন্মদাত্রী, সেটা তো ভীষণ অমানবিক।

কিন্তু আবার যদি ভাবি, একটা মেয়ে ধর্ষণের শিকার হয়ে গর্ভবতী হয়েছে, তার পক্ষে কি একটা সন্তানের জন্মাদান, সুষ্ঠু লালন পালন সম্ভব? প্রথমত ধর্ষণ ব্যাপারটাই তার উপরে নির্যাতন। শারীরিক এবং মানবিক। এই জন্মের সূচনায় তার কোনো ইচ্ছা বা সহযোগিতা কিছুই ছিল না। বেশিরভাগ সমাজই তাকে এই বাচ্চাসহ মেনে নেবে না। সে হয়তো একটা বাচ্চার জন্মাদানে বা প্রতিপালনের জন্য তৈরিও না। সর্বোপরি সে কেন একা এই সন্তানের দায়িত্ব নেবে, যেটা নির্যাতনের মাধ্যমে তার উপরে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে! তার তো অ্যাবরশন ছাড়া আর কোনো পথ নেই। এক্ষেত্রে অ্যাবরশনকে কি অমানবিক বলা যায়?

অনেক ক্ষেত্রে বিবাহিত মেয়েটির শারীরিক অবস্থা ভালো নয়, জীবনের ঝুঁকি আছে, সেক্ষেত্রেও একই কথা খাটে।
অর্থাৎ উপরের দুটি ক্ষেত্রেই যে প্রাণটি এখনো পৃথিবীতে আসেনি, তার চেয়ে যে প্রাণটি পৃথিবীতে আছে, তাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে এবং সেটাই হওয়ার কথা।

তবে আরও কিছু গোলমেলে কেইসও আছে। বিবাহিত দম্পতির মধ্যেও কোনো কারণে স্বামীর চাপে পড়ে রাজি না থাকা সত্ত্বেও যদি কোনো মেয়ে গর্ভবতী হয়, তখন কি তার অ্যাবরশনের অধিকার থাকা উচিত? অর্থাৎ সিদ্ধান্তটা কি সে একা নিতে পারবে? কেন নয়? সে একজন মানুষ এবং তার জীবনের এতো বড় সিদ্ধান্ত তার উপরে চাপিয়ে দেওয়ার অধিকার কারোরই থাকা উচিত নয়।

বিবাহ বহির্ভূত শারীরিক সম্পর্কের কারণে কেউ যদি অন্ত:সত্ত্বা হয়, তখন? এক্ষেত্রে অ্যাবরশনের অধিকার দেওয়া মানে এই কাজটাকে সাপোর্ট দেওয়া। যেটা সমাজের জন্য ক্ষতিকর। কিন্তু কথা হচ্ছে, একই দোষের জন্য মেয়েটার সমান শাস্তি ছেলেটারও পাওয়া উচিত নয় কি?

আরেকটা ব্যাপার মেনে নিতে আমার খুব কষ্ট হয়, সেটা হলো, অনেক সময় অনেক বিবাহিত নারীকে তাদের স্বামীরা জোর করিয়েও এ কাজ করায়। এটা ভীষণ অন্যায় এবং অমানবিক। সবশেষে শুনতে ভয়ানক হলেও সত্যি যে অনেক নারী শুধুমাত্র নির্ঝঞ্ঝাট থাকতে চায় বলে, ‘এটা শুধুমাত্র একটা অ্যাক্সিডেন্ট’ বলে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে কোনো গ্লানি বা চিন্তা ছাড়াই অ্যাবরশন করায়।

আমি জানি না এসব মহিলার মা হওয়ার কোন যোগ্যতা আছে কিনা। এবং এধরনের অধিকার কারো থাকাটা আদৌ কতটা সমীচীন।

শেয়ার করুন: