কন্যাকালের রোদকথা

প্ৰজ্ঞা মৌসুমী:

আমি আর মা। আমরা মুখোমুখি অথচ মাঝ বরবার থেকে গেছে এক আলোকবর্ষ দূরত্ব। কখনো আমরা কেউ কাউকে ছুঁতে পারিনি। মা অবশ্য স্বচ্ছ দিঘির মতোন। আমাদের নিয়ে তাঁর প্রত্যাশা, ক্ষোভ বা অভিযোগ সবটাই আমার মুখস্ত। অথচ আমি গাঢ় থেকে গাঢ়তর শৈবালের ঝোঁপ তৈরি করে ফেলেছি। না আমি মায়ের কাছে যেতে পেরেছি, না মা আসতে পেরেছে। তাই ইউ-টার্ন না করে আমাদের কেবল সমান্তরালে ছুটে চলা।

‘গর্ভধারিণী’ উপন্যাসে পড়েছিলাম “যে বাচ্চা মাকে বেশী কষ্ট দিয়ে পৃথিবীতে আসে, সে চিরদিন সুখী করে রাখে।” আমার জন্মকথা যে শুনেছে সেই-ই বলেছে ‘মিঠি, মাকে কোনদিন কষ্ট দিও না!’ একজন যোগ্য সন্তান হওয়ার দায় চাপিয়ে দিয়েছিল সবাই বুঝে অথবা না বুঝেই। হয়তো সব সন্তানই এইটুকু দায় নিয়েই বড় হয়। মন্ত্রপাঠ করেও মায়ের মনের মতো হতে পারিনি। মা যেসব সরল প্রাপ্তিকে সফলতার চিহ্ন হিসেবে দেখতে চেয়েছিল, সেগুলোকে চেষ্টা করেও সফলতা হিসেবে ভাবতে পারিনি। আমার যা করতে ভালোলাগে, মা সেখানে অপচয় আর সময় নষ্ট খুঁজে পেয়েছে। আমিও অবশ্য সময়ে সময়ে প্রমাণ দিয়েছি সত্যিই সময়ের কী দারুণ অপচয় করছি! তবু ‘ভালো লাগে’ এর থেকে তীব্র যুক্তি আমার কাছে কিছু ছিল না।

সম্ভাবনাকে হাওয়ায় উড়িয়ে দিতে চেয়েছিলাম বলেই হয়তো মায়ের এতো দুশ্চিন্তা, আক্ষেপ। তবু মায়ের অগোচরে অন্য ‘আমি’রা বেড়ে উঠতো। কখনো সখনো অভিমান জমে জমে হয়ে গেছে ক্ষোভ। আমি দিশেহারা অথবা আহত একটা বাঘের ছানার মতো ঝাঁপিয়ে পড়তাম,’আমাকে কখনো বুঝার চেষ্টা করোনি। তুমি কি জানো আমি কী চাই, কিসে ভালো লাগে?’ ভাবিনি মা জানতে চায়নি বলেই কী জানতে চাওয়ার ইচ্ছে হয়নি তাঁর!

মিস উইনডি আর সামলাতে না পেরে ততক্ষণে কাঁদছে। কতো বছর হয়ে গেল মেয়ের সাথে কথা হয় না। মেয়ে আজও ক্ষমা করতে পারেনি কিশোরী মায়ের ভুল। জলের ভেতর কখন যে তলিয়ে গেল পঁয়ষট্টি বছরের বিদেশিনী, ভেসে উঠি আমরা। সন্তানকে বুঝতে না পারাটা কি মায়ের অপরাধ?

যে আমার বয়ো:সন্ধির গল্প জানে, যে ঠিক সময়ে জানিয়ে দিয়েছে কখন আমায় গুছিয়ে নিতে হবে, যে আমার সব জেনে বসে আছে, সে কেন বুঝতে পারছে না আমার এইসব চাওয়া! ভাবতাম একটাই কারণ- আমি গুরুত্ব পাচ্ছি না। আবার ভাবতাম, আমার সবকিছুর বাঁধা হয়ে সুখ নষ্ট করার কি অধিকার আছে? আমি কি তোমার হাতের ঘুড়ি!
কখনো কারো হাতের ঘুড়ি হতে চাইনি। আমি হতে চেয়েছি পাখি। নরম তুলতুলে পাখি। উড়ার স্বাধীনতা চেয়েছিলাম। তুমি উড়ানোর স্বাধীনতা নিয়ে বসে ছিলে। আমি তোমার হাতে বাঁধা পড়তে চাইনি। হয়তো তুমি আমাকে শুধুই ছুঁতে চেয়েছিল আর তোমার ছুঁতে চাওয়াকে মনে হয়েছে রুখে দেয়া। কী অদ্ভুত কন্ট্রাডিকটরি, আমি যতোটা নির্ভরহীন হতে চেয়েছিলাম, ততোটাই নির্ভরতা চেয়েছিলাম তোমার কাছেই!

যত বড় হয়েছি, একটা ভয়ও আমার মতো বড় হয়েছে। আমি কেমন স্ত্রী হবো, পরিবারের বড়/সেজো/ছোট বৌ হিসেবে কেমন হবো এই নিয়ে কখনো ভাবিনি। আমি কেমন মা হবো, এই নিয়েই আমার যতো গা শিরশির করা ভয়। এক সন্তান হয়ে উঠতে পারে মায়ের ব্যর্থতা। একটু এদিক-ওদিক। উঠে আসবে সারি সারি আঙুল। ভালো সন্তানের মা হতে হবে, এই দায় যে মায়ের। নাকি সেটা মায়ের সংস্কার? যেমন থাকে সন্তানের সংস্কার!

মা, তোমারও কি এই ভয় অথবা সংস্কার ছিল? তুমিও কি দিশেহারা হয়ে ছুটে যেতে? এতোসব আত্মবিশ্বাসের আড়ালে তোমার দূর্বলতাই ছিল আমার মতো? তুমি ব্যর্থ হতে চাওনি!

এই এক বিপত্তি- মাকে চাই-ই চাই, আবার মাকেই মনে হয় গলার কাছে চেপে ধরে আছে। চুপ-ভয় থেকে ‘প্রীতি উপহার’ পড়ি, ক্রাচের কর্ণেলের আশরাফুন্নেসাকে, জাহানারা ইমামকে মায়ের অনুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে এনে ব্যবচ্ছেদ করি। বাচ্চাদের সাইকোলজি নিয়ে বিস্তর বই পড়ি। আমার ডায়েরির পাতায় পাতায় আদর্শ মা হওয়ার উপদেশে ঠাসা। মাঝে মাঝে নিজেই হাসি এই ভেবে যে সন্তান পালনের সহজাত ব্যাপারটাকে জটিল আর ব্যাপক করে তুলেছি। পাখির মা হতে পারছি কই! অভিভাবকই থেকে গেলাম বোধহয়। মানুষ যে, মানুষ মায়ের মায়া যে বড় দীর্ঘ! ক’মাসে ডানা ঝাপটানোর কৌশল শিখিয়ে দিয়ে ছেড়ে দিতে পারি না। আশেপাশের মায়েদের দিকে তাকিয়ে ভুল শুধরে নিতে চাই। আশেপাশে তাকাই আর মায়ের দিকেই ফিরে যাই। আমি কেমন যেন মা-ই হয়ে যাই। মা হয়ে যায় লাইট হাউস।

প্রায়ই মেয়ের চোখে আমাকে দেখার চেষ্টা করি। তারও কতো কতো অভিমান জমা হচ্ছে। আমার জন্য তার প্রথম বিশেষণই বোধহয় ‘খারাপ’। যে প্রিয় পুতুল ছাড়া ঘুমুতে পারে না মেয়ে, সেটাই দিয়ে দিতে বাধ্য করেছি। প্ৰিয় জিনিস হারাতে না শিখলে, ছেড়ে দিতে না শিখলে যে সামনের জীবনটায় ব্যথা পাবে। আর সব বন্ধুর মায়ের মতো হাতে ধরে ধরে সব জায়গায় নিয়ে যাই না, ভাতের থালা হাতে পেছনে পেছনে দৌড়ুতে জানি না, মেয়ে ভেবে বসে মায়ের অবহেলা।

ও বোধহয় আমার হাত ধরে হাঁটতেই ভালোবাসে, চায় মেয়েকে নিয়ে মায়ের আদিখ্যেতা। বোকা মেয়ে জানবে কী করে এতো যত্নে পাত্তা না দেয়াটাই যে বিশাল গুরুত্ব দেয়া। পাত্তা দেয়া! কয়টা মুহুর্ত আছে আমার জীবনে যেখানে ও নেই! তবুও আমি মেয়ের বন্ধু হতে পারি না। সে আমাকে বন্ধু ভাবে না। মানুষ বন্ধুতো চিরদিন থাকে না। একলা হওয়াও যে শিখতে হয়।

পাখি হতে চাইলে আমাকেও যে পাখির মা হতে হবেরে মেয়ে, নয়তো উড়বি কী করে! ঘুড়ি নয়, পাখির মতো উড়ে উড়ে মেঘ ছুঁবি তুই… তাই আমি তোকে দেই উড়ার পাঠ। তোকে উড়াবো না, একদিন ঠিক উড়ে যাবি। আর একদিন মা হবে হাওয়ার ঘুম। তোর ছায়ায় বেঁচে থাকবে মানুষ পাখি’ মায়ের নিশ্চুপ ব্যথা, ছিটেফোঁটা সার্থকতা। কে জানে তুইও খুঁজে পাবি বাতিঘর।

যদি না পাস, ক্ষতি কী? ভালো থাকিস নিজের মতো করে।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.