উম্মে ফারহানা মৌ:
দিনকয়েক ধরে পরকীয়া বিষয়ক আইন নিয়ে ফেইসবুকে কিছু কথাবার্তা দেখতে পাচ্ছি। কেউ বলছেন, ভারত দেশটাই অনৈতিক, কেউ বলছেন পরকীয়া নামে কোন শব্দ আইনে ছিলোই না, যে শব্দ আইনেই নেই সেটা বেআইনি হয় কী করে? কেউ বলছেন পরকীয়া আইন পালটে কী হলো? কেউ বলছেন অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে।
প্রথম কথা হলো, যে আইনটি পরিবর্তিত হয়েছে (৪৯৭ ধারা) তাতে একজন পুরুষ আরেকজনের স্ত্রীর সঙ্গে সেই নারীর স্বামীর ‘অনুমতি ছাড়া’ যৌন সংসর্গে লিপ্ত হলে তার শাস্তি বিধানের উপায় ছিল। এই আইনে স্ত্রীকে স্বামীর সম্পত্তি ধরা হয়েছিল। কোন বিবাহিত পুরুষ কোন অবিবাহিত/বিধবা/বিবাহবিচ্ছিন্ন নারীর সঙ্গে সম্পর্কিত হলে কী হবে, তা বলা ছিল না।
তার মানে হলো, নারীর শরীর একটি সম্পত্তি, যার মালিক সে নিজে নয়, তার স্বামী। এবং বিবাহিত পুরুষ চাইলেই যথেচ্ছা নারীগমন করতে পারেন যদি সেই নারীদের কোনো ‘মালিক’ না থেকে থাকে। সে হিসেবে বেআইনি ছিল না কথাটা আংশিক ঠিক।
এই আইনটি বাতিলের মাধ্যমে নারীকে বা তার শরীরকে পুরুষের/নারীর বিবাহিত সঙ্গীর সম্পত্তি হিসেবে বিবেচনা করার ব্যাপারটি লুপ্ত হলো। ‘পরকীয়াকে বৈধতা দেওয়া হয়েছে’- এমন নয় ব্যাপারটা।
দ্বিতীয় কথা হলো, যারা ভাবছেন এই আইন বাতিলের মাধ্যমে বিবাহে অসততা বেড়ে যাবে (এক কবি ছড়াও লিখেছেন, কাকাকে নাকি বাপ বলে ডাকবে ছেলে) তাঁরা একটা ভুলের মধ্যে আছেন। অসততা বা সঙ্গীর কাছে মিথ্যা বলে আরেকটি সম্পর্কে থাকা যদি অপরাধ হয় তাহলে তা নারীর জন্যেও অপরাধ হওয়া উচিৎ। সেক্ষেত্রে যে কোন পক্ষের বিরুদ্ধে প্রতারণার মামলা হতে পারে। ৪০৫ ধারায় সেটি স্পষ্ট করে বলা আছে, প্রতারণা বা বিশ্বাসভঙ্গের দায়ে বিবাহিত নারী বা পুরুষ সংগী/সঙ্গিনীর বিরুদ্ধে মামলা করতে পারেন এবং এটি নন বেইলেবল, অর্থাৎ জামিন হবে না। একে বলা হয় Criminal breach of trust.
আর কোনো পুরুষ যদি স্ত্রীকে সম্পত্তি ভেবে অন্য পুরুষের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারেন তবে নারীদেরও অন্য যে নারী তার স্বামীর সঙ্গে যৌন সম্পর্কে লিপ্ত আছে তার বিরুদ্ধে মামলা করার এবং তাকে অন্যের ‘সম্পত্তি’ ভোগদখলের অপরাধে অপরাধী সাব্যস্ত করার অধিকার থাকা উচিৎ এবং অপরাধী নারীর সাজা হওয়ার বিধান থাকা দরকার। ডিএনএ টেস্ট নামে একটি ব্যাপার আছে, প্যাটারনিটি নির্ধারণ করা তেমন কঠিন কিছুই না।
তৃতীয় কথা হলো, অন্যায় এবং অপরাধ দুইটা জিনিস আলাদা। অকারণে গাছ থেকে পাতা ছিঁড়লে অপরাধ হয়না,রাস্তার কুকুরকে লাথি মারলে কারো শাস্তি হয় না, তাই বলে আপনি কি তা করেন?
বিবেক বিবেচনা বলে যেমন কিছু ব্যাপার আছে, তেমন প্রতিটি ব্যক্তির জীবনযাপন, বোধবুদ্ধি, তার অভিজ্ঞতা, বাস্তবতা আলাদা আলাদা।তাই অন্যের ব্যাপারে জাজমেন্টাল হওয়া সহজ, কিন্তু কারো পরিস্থিতির জটিলতা বোঝা সবার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই সবচেয়ে ভাল ব্যক্তিকে বা যুগলকেই তাঁর/তাঁদের পারিবারিক সমস্যা সমাধান করতে দেওয়া।
সম্পর্ককে মানবিকভাবে দেখতে শিখুন, নারীকে পুরুষের সম্পত্তি ভাবা বন্ধ করুন। বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানের শর্তই হলো একে অন্যের প্রতি নিষ্ঠাবান থাকা। এই শর্তে না যেতে পারলে কারো বিয়ে করাই উচিৎ নয়। আর যদি বিয়ের পরে অন্য কারো সঙ্গে সম্পর্ক হয়েই যায় (যার পক্ষ থেকেই হোক) সেটাকে অনেক ভাবেই সমাধান করা যেতে পারে, আদালতে গিয়ে একটি পুরুষকে সাজা দিয়ে এবং নারীটিকে জড়বস্তু ভেবে (যদিও নারীটি সমান অংশীদার) আপাত রেহাই দিয়ে আর মানসিক শাস্তি ও সামাজিক অসম্মান করে কোনমতেই বিবাহের পবিত্রতা রক্ষা করা সম্ভব নয়।