আর সইতে পারছেন না বীরাঙ্গনা মমতাজ

momotajজান্নাতুল ফেরদৌস: কীসের বিজয়? কার বিজয়? ক্রোধে, ক্ষোভ, অভিমানে জলভর্তি চোখ মুছতে মুছতে জাতির কাছে জানতে চাইলেন ‘৭১-এর ‘বীরাঙ্গনা’ মমতাজ বেগম।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের মূল্য পরিশোধ করতে গিয়ে আসন্নপ্রসবা মমতাজ বেগমের পেটে থাকা ৯ মাসের শিশু হয়েছে খুন। সম্ভ্রম হয়েছে লুট। আর ক্ষতবিক্ষত প্রজনন অঙ্গ ও পায়ুনালী হয়েছে চিরতরে বিকলাঙ্গ। অনাহার আর অর্ধাহারকে সঙ্গী করে পেটের মধ্যে লাগানো কৃত্রিম পায়ুনালীর অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে মমতাজ বেগম পার করেছেন ৪২টি বছর। আরও কত যে করবেন, তা তার জানা নেই!

তাই, প্রতিবছর ডিসেম্বর মাসটি আসে মমতাজের জীবনের এক দুর্বিষহ স্মৃতির বোঝা নিয়ে। আজ থেকে ৪২ বছর আগে স্বাধীনতা যুদ্ধের ঝড়ো হাওয়া তার জীবনটি ওলটপালট করে দিয়ে যায়। প্রস্ফুটিত হওয়ার আগেই ঝরে যায় তার জীবনের সব স্বপ্ন-সাধ-আহ্লাদ।

আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের নিরব সাক্ষী অমানুষিক নির্যাতনের শিকার ‘বীরাঙ্গনা’ মমতাজের কাহিনী জানতে হলে যেতে হবে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার গোসিঙ্গার লতিফপুর তালতলা গ্রামে।

এখানে শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ঘেঁষা লতিফপুর গ্রামের মেয়ে মমতাজ। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় মমতাজের বয়স ছিল ১৭ বছর। তখন তিনি ছিলেন দুই কন্যা সন্তানের জননী। মাত্র ১০ বছর বয়সে মমতাজের বিয়ে হয় একই গ্রামের দরিদ্র কৃষিশ্রমিক কাছম আলী মোড়লের ১১ বছরের ছেলে রমিজ উদ্দিন মোড়লের সঙ্গে।

‘ছোট বলে আড়াই বছর পর রমিজ আমাকে তার ঘরে তোলেন। রমিজ আর আমি আমাদের দুই কন্যাশিশুকে নিয়ে একরকম সুখেই ছিলাম। সংসারে অভাব ছিল। কিন্তু, নারকেল-সুপারি বাগানে ঘেরা ছোট্ট ঘরে আমাদের কোনো অশান্তি ছিল না’- বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন মমতাজ।

তখন ১৯৭১ সাল। মুক্তিযুদ্ধ চলছে। আলাদা যুদ্ধ ক্ষেত্র বলতে কিছু ছিল না। সারা দেশই তখন রণাঙ্গন। শহর, গ্রামগঞ্জ, সর্বত্রই যুদ্ধ চলছে পাকিস্তানি খান সেনাদের সঙ্গে। স্বাধীনতার সৈনিক মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা হামলায় দিশেহারা পাকিস্তানি সেনা আর তাদের দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও শান্তিকমিটির সদস্যরা নির্মম আক্রোশে এ দেশের নারী-পুরুষকে শুধুমাত্র নির্বিচারে হত্যাই করেনি, জাতিগত শুদ্ধি অভিযানের অংশ হিসেবে তারা নারীদের শ্লীলতাহানিও শুরু করে। এমনি এক নির্মম ও হৃদয়বিদারক ঘটনার শিকার হন মমতাজ।

সেই ভয়ঙ্কর দিনটির কথা আজও স্পষ্ট মনে আছে মমতাজের। দিনটি ছিল ১৯৭১ সালের ৭ জুন। চাঁটাইয়ের বেড়া আর ছনের ছাউনির ঘর থেকে তাকে তুলে নিয়ে যায় পাকিস্তানি খান সেনারা।

বন্দুকের মুখে তাকে নিয়ে যায় পাশের এক সেতুর কাছে। তখন তিনি ছিলেন নয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা। দল বেঁধে নরপিশাচের দল তার ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায়। শত অনুনয়, বিনয় কোনো কিছুই তাদের সহানুভূতি কাড়তে পারেনি।

পালাক্রমে ধর্ষণ করার পর তার কী হয়েছে, তা আর কিছুই মনে নেই মমতাজের। শাশুড়ির আহাজারিতে যখন জ্ঞান ফেরে, তখন তিনি নিজেকে দেখতে পান বাড়ির উঠোনে চাটাইর ওপর শুয়ে আছেন। ছোপ ছোপ রক্তাক্ত শরীরকে তিনি আর নড়াতে পারছিলেন না। অসহ্য যন্ত্রণায় বুকের নিচ থেকে শরীরটি তখন অবশ হয়ে গেছে।

চোখ মেলে দেখেন তার স্বামী রমিজ ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছেন। কারো কারো চোখে পানি। আর শাশুড়ি তখন বুক চাপড়িয়ে বিলাপ করছেন, ‘হতভাগী তুই মরলি না ক্যান, অহন তোরে লইয়া আমরা কি করমু? কই যামু ক?’ আবার জ্ঞান হারান মমতাজ।

পরে প্রতিবেশী কয়েকজন নারী মমতাজের গর্ভ থেকে টেনে টেনে বের করে আনেন এক মৃত পুত্র সন্তান। কিন্তু, শিশুটির দেহের একটা অংশ থেকে যায় পেটের ভেতরেই। ক্ষত-বিক্ষত পায়ুনালী আর যৌনাঙ্গ দুটি তখন একাকার হয়ে গেছে!

এই দুঃস্বপ্ন তিনি গত ৪২ বছর ধরে দেখছেন। তার মনে হয়, শরীর থেকে রক্ত ঝরছে। এক মুহূর্তের জন্যও পবিত্র রাখতে পারেননি তার শরীর। অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করে এতগুলো বছর কেটে গেছে তার।

মমতাজ জানালেন, ‘একটি রাতের জন্যও ঘুমাতে পারিনি। কানে শুনি না। ঝাঁপসা হয়ে গেছে চোখ। কোনো কাজ করতে পারি না।’

একাত্তুরের সেই দিনগুলির কথা মনে করে মমতাজ বেগম জানান, সারাদিন অন্যের বাড়িতে কৃষি কাজ করে এসে প্রতিদিন সন্ধ্যায় স্বামী রমিজ উদ্দিন শীতলক্ষ্যার জলে তার রক্তাক্ত জামা কাপড় ধুয়ে দেন। ইচ্ছে করলে তিনি তখনই মমতাজকে ছেড়ে দিতে পারতেন। কিন্তু, ভালোবাসার এই মানুষটিকে বুকে আগলে রাখেন রমিজ।

কৃষিশ্রমিক রমিজ উদ্দিন গরিব হলেও স্ত্রীকে তিনি প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসতেন। আজও সেই বন্ধন রয়েছে অটুট! মহৎপ্রাণের অধিকারী রমিজ উদ্দিনের নিজস্ব জমি বলতে তেমন কিছুই নেই। যা আছে, তা বিক্রি করে এবং হাড়ভাঙা পরিশ্রমের টাকা দিয়ে গত ৪২ বছর ধরে স্ত্রীর চিকিৎসাসেবা করে চলেছেন তিনি।

নির্যাতনে মমতাজের পায়ুনালী ও যৌনাঙ্গ ক্ষতবিক্ষত এবং ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেছে স্থায়ীভাবে। তাকে পাঁচ বার অপারেশন করেও সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। বিকল্পভাবে তলপেটে পায়ুনালী স্থাপন করে কৃত্রিম পাইপ দিয়ে মলত্যাগ করছেন।

কিন্তু, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসের দলিলপত্রে মমতাজের ঠাঁই হয়নি কোথাও। কেন্দ্রীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদও ‘বীরাঙ্গনা’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি তাকে। কারণ, অভিশপ্ত জীবনের গ্লানি আর বোঝা বয়ে বেড়ানো নিরক্ষর মমতাজের সাধ্যে কুলায়নি কোনো তদবির করার।

বিজয় দিবস আসে আর যায়! স্বাধীনতা দিবস আসে আর যায়! কিন্তু মমমতাজের খবর নেয় না কেউ! মাত্র দুবার উপজেলার পক্ষ থেকে বিজয় দিবসের দাওয়াত পেয়েছেন বলে জানান মমতাজ।

২০০৬ সালে তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রাশিদা ফেরদৌস তাকে ২০ হাজার টাকা দিয়েছিলেন বলে তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন তিনি। রাষ্ট্রের কাছ থেকে পাওনা বলতে এটুকুই পেয়েছেন বলে জানান।

বয়েসের ভারে নুয়ে পড়া মমতাজকে এখনও প্রতিদিন প্রায় ২শ টাকার ওষুধ খেতে হয়। বৃদ্ধ স্বামীকে অতিকষ্টে জোগাড় করতে হয় এই টাকা। ওষুধের খরচ জোগাড় করতে গিয়ে প্রায়ই উপোস থাকতে হয় মমতাজ দম্পতিকে।

গ্লানিকর জীবনের এই যন্ত্রণাদগ্ধ বোঝা আর সইতে পারছেন না তিনি! বেঁচে থাকার আর ইচ্ছাও তার মধ্যে কাজ করে না বলে জানান মমতাজ।

জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তার আর কিছুই চাওয়ার নেই বলে জানান  এখন শুধু একটাই চাওয়া, বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা যেন অন্তত একটিবার এসে তাকে দেখে যান। এটাই তার জীবনের অন্তিম চাওয়া। সে চাওয়া কি তার পূরণ হবে না? তা-ও জানতে চান তিনি।

(লেখাটি প্রজন্ম ব্লগ থেকে নেয়া)

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.