হুমায়রা প্রিয়ন্তী:
নিজেকে না ভালবাসলে, নিজে ভালো না থাকলে অন্যকে ভালো রাখা যায় না। এই সহজ সত্যটা আমরা বুঝতে বুঝতেই অনেক দেরি করে ফেলি।
মেয়েদের বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে ভালবাসলে অন্যকে এতো বেশি ভালবেসে ফেলা যে নিজের ক্ষেত্রে আমি যে একটা ব্যাপার, সেটাই খেয়াল থাকে না। বিবাহিত জীবনে প্রাণাতিপাত করে ঘর গোছানো, সংসার সামলানো, রান্নাবান্না করা, সন্তানদের পিছনে দৌড়ে বেড়ানো, সেই ভোরে উঠা থেকে শুরু হয়। আর যতক্ষণে এই দৌড় শেষ হয়, ততক্ষণে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়ানোর সময় আর ইচ্ছাটাও যে একই সাথে চলে গেছে, সাথে বয়সও, সেটাও অনেকের খেয়াল থাকে না, অন্য কিছু তো দূরের ব্যাপার।
চাকরি করলে তো আরও এককাঠি উপরে। সারাদিন অফিস করে এসেও আবার ঘরের কাজ! সুবিধা একটাই, মাস শেষে বেতনটা নিজের, খরচে আপনি স্বাধীন। অনেকের আবার নিজের সেই বেতনও নিজে খরচ করার স্বাধীনতা থাকে না।
আমরা টেবিলে তিন বেলা খাবার পাই, কোথা থেকে আসে, কে রান্না করে, ঘরের সমস্ত কাজ রেডি থাকে, সবকিছু ঝকঝকে তকতকে, সেটা পরিবারের অন্য সদস্যরা কিন্তু ভাবে না। এজন্য তারা ন্যুনতম কৃতজ্ঞতাও বোধ করে না।আসলে বুঝতেই শেখে না, বা শেখানো হয় না, তারা মনে করে এটাই স্বাভাবিক। এমনি এমনিই সব হয়ে গেছে। এটা পাওয়া তাদের অধিকার।
মা অথবা বউ রান্না করছে, কাজ করছে, সেটা মায়ের অথবা বউয়ের দায়িত্ব। হাউজওয়াইফ হলে তো ব্যাপারটা এমন দাঁড়ায় যে টেকেন ফর গ্রান্টেড। যিনি চাকরি করেন তার ক্ষেত্রেও কিন্তু ব্যাপারটা সেইম, আদতে তার থেকেও বেশি।শুধু তুমি তো কিছুই করো না অপবাদ থেকে মুক্তি মিলুক বা না মিলুক, কেউ সামনে বলতে অতটা সাহস করে না, এটুকুই।
কথা প্রসঙ্গে ছেলেদেরটাও বলি, ছেলেরা যা করে, ছেলেমেয়ে, বউ অথবা পরিবারের সদস্যরাও মনে করে, এইটা আমার অধিকার। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত এতো কষ্ট করে যে মানুষটা পরিবারের সব চাহিদা পূরণ করছে অনেক ক্ষেত্রে নিজের সামান্য চাহিদাটুকুও ইগনোর করে, তাকে এপ্রিশিয়েট তো দূরে থাক, দুটা নরমাল ভালো কথা, একটু গুরুত্ব দেয়ার কথাও কারও মনে থাকে না। বেচারা পুরুষ মানুষটি অফিসে যায়, অফিস থেকে এসে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। এইটা তার লাইফ।
তাহলে সমস্যাটা কোথায়? সমস্যাটা এখানে যে, আমরা ভাবি আমরা যেটা করছি সেটা কেবলমাত্র অন্যের খুশিতেই আমার খুশি।সন্তানকে খুশি করতে হবে, স্বামী, স্ত্রী, মা, বাবা, ভাই,বোন, আত্মীয়, বন্ধুবান্ধব,পৃথিবীর অন্য সব মানুষকে খুশি রেখে চলতে হবে, চাহিদা বুঝে চলতে হবে। কিন্তু নিজের খুশি? নিজের ইচ্ছা? ওগুলার কোনো মূল্য নেই?
সারাজীবন নিজে কিছু না খেয়ে, পরে, ঘুরে, নিজের সামান্য কমদামি শখও না মিটিয়ে (সামর্থ্য, সুযোগ থাকলেও), নিজেকে সময় না দিয়ে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে আমি কিছুই পাই নাই বলার কোনো অর্থ হয় না। কারণ যখন নিজেকে কিছু দেয়ার সময় ছিল, তখন নিজেই নিজেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। সেখানে অন্য কেউ নিজের জন্য নিজের থেকে বেশি করবে, বা শেষ বয়সে অন্য কারও থেকে রিটার্ন আসার বাসনায় সারা জীবন যেনতেন ভাবেই কাটিয়ে দিলে তা ফেরত আসবে ভাবাটা বোকামিই নয় শুধু, নিজের সাথেই নিজের প্রতারণা করা।
অন্যকে ভালো রাখার সাথে সাথে নিজেকে ভালবাসা, ভালো রাখাটাও জরুরি বৈকি। এবং তা বৃদ্ধ হওয়ার আগেই, পড়ে নয়!