শিল্পী জলি:
যৌনতা জীবনেরই একটি অংশ– মানুষের মৌলিক চাহিদা এবং সৃষ্টির রহস্যও। অথচ ধর্ম, পরিবার, সমাজ যুগ যুগ ধরে বিষয়টিকে নানাভাবে অপব্যবহার করে আসছে। নানা অজুহাতে মানুষের সাধারণ জীবন ধারাকে কন্ট্রোল করছে।
সম্প্রতি বগুড়ার জেলা প্রশাসক ম্যাজিষ্ট্রেটকে দিয়ে পদের জোর খাঁটিয়ে ফাস্টফুড দোকান/ওয়ান্ডার ল্যান্ড পার্কে বসা ছেলেমেয়েদেরকে প্রেমের অভিযোগে অভিযুক্ত করে চরম হিউমিলিয়েশনসহ জরিমানা আদায়ের ব্যবস্থা করেন। ভিডিওতে দেখা যায় ৭২ জোড়া প্রেম কয়েদীকে ধরে রাস্তার দু’পাশে লাইন ধরিয়ে বসিয়ে রাখা হয়েছে। আর চুঙ্গা দিয়ে বলা হচ্ছে, হয় তাদের বাবাকে এনে জরিমানা দিয়ে মুক্ত হতে হবে, নয় তাদেরকে জেলে পুড়বে। কীসের জরিমানা? কেন জরিমানা?
নারী-পুরুষের হাতে হাত রাখা, লুকিয়ে একটু আলিঙ্গনবদ্ধ হওয়া, অথবা ভালোবেসে একটি/দু’টি চুম্বন–কোন জাতের ক্রাইমের আওতাভুক্ত? বাংলাদেশে প্রেমে কি ইতিমধ্যেই শরিয়া আইন প্রথা চালু হয়ে গিয়েছে? নাকি হবার পথে?
অথবা প্রশাসন নতুন কায়দায় ঘুষ হাতাচ্ছে?
নাকি রাষ্ট্রের পক্ষে পিম্পের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে উদ্ধারকৃত এই চল্লিশ হাজার টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা না পড়লে জনগণের আর চলছে না? জনজীবনের একেবারে রফাদফা হয়ে যাবে?
এক যুগলকে আবার জোর করে বিয়ে পড়িয়ে দেবার হুমকিও দেয়া হলো? সে/তারা কাউকে বিয়ে দেবার কে?
বিয়ে কি কোনো ছেলে খেলা নাকি? তাছাড়া প্রেম করলেই যে বিয়ে করতে হবে, এটা দুনিয়ার কোন ডিকশনারিতে আছে?
বিয়ে কি কোন জোর জুলুমের বিষয়?
চুঙ্গা দিয়ে গলার আওয়াজ বাড়িয়ে বলা হচ্ছে, অসামাজিক কাজে লিপ্ত থাকায় তাদের আজ এই হাল–প্রেমের চেয়ে বেশি সামাজিক কাজ আর কী আছে পৃথিবীতে?
যেখানে পারস্পরিক মুগ্ধতাই সম্পর্কের ভিত তৈরি করে, দু’টি আলাদা মন অবিরত এক হতে চায়, নারী-পুরুষ অথবা দুজন মানুষের মাঝে অজান্তেই ভেদাভেদ-দ্বন্দ্ব দূর হয়ে সমতা স্থাপিত হয়!
যেই দেশে পতিতাবৃত্তি বৈধ, সেই দেশে প্রেমের বিষয়ে এতো গলাবাজী আসলেই কি সাজে?
তারা এভাবে মানুষের স্বাধীন চলাচলে যে বাঁধার সৃষ্টি করলেন, সেটা যেমন মানুষের অধিকার হরণ করে, তেমনি সভ্যতার পরিপন্থিও। অগ্রহণযোগ্য। কারও ব্যক্তিগত জীবনে তাদেরকে এভাবে হস্তক্ষেপ করার অধিকার কে দিয়েছে? কোন আইনে?
এই হিউমিলিয়েশনের বিচার কী হওয়া উচিত এখন?
দেশের জনতা নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন না হলে, এভাবে অন্যায় মেনে নিলে ভবিষ্যতে আরও পস্তাবে। ইন্ডিয়ায় যেখানে সমকামিতাকে স্বীকৃতি দেয়া হলো, বাংলাদেশে সেখানে হাতে হাত পেলেই ধরার নিয়ম চালু হয়ে গিয়েছে, সাবাশ বাংলাদেশ!!
বগুড়ার জেলা প্রশাসকের দলের দ্বারা সংঘটিত এই ঘটনাটিই বলে দেয় তিনি এবং তারা ওই ক্ষমতাধর পদটি দখল করে থাকলেও একেবারে ক্লোজড মাইন্ডেড। আইন খাটান, অথচ কমনসেন্স নেই! দেশে এমনতরো বিজ্ঞজন এভাবে গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো দখল করে থাকলে শরিয়া আইন চালু হতে আর বেশি দেরি নেই!
লক্ষ্য করলেই দেখা যায়, দেশে অহরহ মানুষের ভালোমন্দের সার্টিফিকেট দেয়া হয় তার প্রেমপ্রীতি এবং যৌনতার উপর ভিত্তি করে। আবার কাউকে আক্রমণ করতে গেলেও ওমন গালিই ব্যবহৃত হয় — মূলত সেক্স বা লিঙ্গ সংক্রান্ত বিষয়াদি। অথচ লিঙ্গ মানুষের শরীরেরই একটি অঙ্গ। সেক্সও একটি প্রক্রিয়া–নারী-পুরুষ বা দু’জন মানুষের মাঝে সম্প্রীতি, উপভোগ, এবং বংশবৃদ্ধির উপায়। মানুষের মৌলিক চাহিদাও।

সৃষ্টির শুরু থেকেই এই সম্পর্ক বর্তমান এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। বলতে গেলে সবারই কমবেশী এই জীবনের সাথে পরিচয় ঘটে। দরকার শুধু একটি গ্রহণযোগ্য পন্থা অবলম্বন যেখানে সবার জন্যেই সমতা, সমঅধিকার, সুস্থতা, স্বাধীনতার সুবিধা থাকে। তথাপি যুগ যুগ ধরে একে নানাভাবে অপব্যবহার করে মানুষকে দমিয়ে রাখার পাঁয়তারা চলে। কৌশলে একটি শ্রেণীর পথ চলায় বাঁধা সৃষ্টি করা হয় গতিরোধ করতে।
এইসব চারিত্রিক সনদপত্র প্রদান বা বিশ্লেষণের একমাত্র লক্ষ্য, কন্ট্রোল। বিশেষ করে নারীদের ক্ষেত্রে — যৌনতার ‘য’ উচ্চারণেই এমন চাপ যেন তার অধিকার সম্পর্কে প্রশ্ন তোলারই আর সাহস না দেখায়! যৌনতা লজ্জাজনক বা অপ্রয়োজনীয় কোনো বিষয় হলে বিষয়টিকে বিয়ের মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে চালু রাখা হতো কি?
বলে রাখা ভালো যে বিয়ে এবং বিয়ে ছাড়া যৌনতার মূল পার্থক্য হলো সো-কলড হালাল এবং হারামের, যদিও মূল কর্ম একই! উপরন্তু বিয়েতে যৌনতা বৈধ হলেও আদর, কদর, সোহাগ, ভালোবাসা, বা আগ্রহ থাকবেই সেই নিশ্চয়তা নেই। আবার সহসা বাই-বাই বলাও চলে না।
জগতে অনেক বিয়েই গলায় কাঁটা নিয়ে ঘোরাফেরা করে।
যদিও অবাধ যৌনতায় মালিকানা (মূলত নারীর উপর) হাতে থাকে না, যৌনবাহিত রোগবালাই ছড়ায়, হানাহানি বাড়ার আশঙ্কা থাকে, এবং সবার জন্যে (নিজে ছাড়া) অবাধ যৌনতা কারও ততটা কাম্যও নয়, তথাপি যৌনতা দিয়ে কারও চারিত্রিক বিশ্লেষণ চলে না, যদি না এতে অন্য কারও অধিকার খর্ব হয়। পূর্ণ বয়স্ক নারী-পুরুষ সবারই যৌনতায় স্বাধীনতা থাকা জরুরি। এটি জীবনেরই একটি দিক এবং নিজস্ব চয়েস। ব্যক্তির অধিকার। দরকার শুধু বিষয়গুলোর মাঝে সহজতা এবং স্পষ্টতার, যেন সবার সমতা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়। এই বিষয়গুলোতে ঢাক ঢাক গুড় গুড় কালচার জাতিকে পিছিয়ে রাখে। অযথা জীবনের সময় নষ্ট করে, অনেক সহজ সমাধানের পথগুলোকে কঠিন করে দেয়।
যৌনতা প্রাণীকূলের সুস্থদেহ এবং তারুণ্যের প্রতীক। এটা কোনো চরিত্র পরিমাপকের মানদণ্ড নয়! চরিত্র বিশ্লেষণের জন্যে স্তন, লিঙ্গ, বা সেক্স নয়, অন্যান্য সৃষ্টি বা সেবাধর্মী কর্মগুলোই যথেষ্ট। অবশ্যই দু’জন পূর্ণবয়স্ক মানুষের মাঝে সহমতে যৌনতা এবং ইচ্ছার বিরুদ্ধে ধর্ষণ দুটো আলাদা বিষয়!