মনের জানালাটি কি সবাই খুলতে চাই?

সামিয়া কালাম:

আমি খুব ভোরে উঠি ঘুম থেকে। উঠেই স্টাডি রুমের জানালাগুলো খুলে দেই। ঢাকায় যতোই দূষণ থেকে থাকুক না কেন, ভোরের হাওয়াটা এখনও নির্মল। আমার চোখে-মুখে-গালে হুশ করে অনেকটা হাওয়া এসে লাগে। মন আর শরীর হালকা হয়ে আসে। তারপর প্রার্থনায় বসি। এবং প্রার্থনায় বসেও একটা জানালার জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা জানাই। যে জানালা দিয়ে হাওয়া খেলবে, পাখির কলতান এবং কিছুটা রোদ্দুর আসবে। মনের স্যাঁতস্যাঁতে ভাবটায় রোদ লেগে ধীরে ধীরে সেটা সেরে উঠবে।

কেবল আমি কেন, আমরা সবাই কি “জানালা” খুঁজে বেড়াই না স্বজ্ঞান বা অবচেতনে? সেটা কখনো হয় কিটি পার্টি, উইন্ডো শপিং, বন্ধুদের সাথে আড্ডা…। তারপরেও একটা শূন্যতা মনের কোণে থেকে যায়। কেননা সেই সব কিটি পার্টি আর বন্ধুদের আড্ডায় একটা পর্যায়ে এসে কার কতো আছে, কে কতোটা শো অফ করতে পারছে এবং আমার কী কী নেই, এই তুলনায় নিজেকে জড়িয়ে ফেলতে হয়। কিন্তু এর বাইরে যেয়েও কি ভাবা যায় না কিছু? যে জানালা দিয়ে রোদ আর হাওয়া আসার কথা, সে জানালা দিয়ে এমন কিছু কেন আসবে যা মনকে আবারও বিষণ্ণ করে দেয়!
আর তাই আমি ঠিক সেরকম একটা জানালা খুঁজে বেড়াই যে জানালা কেবলই আমার একান্ত। এটা ঠিক যেন প্রপার টেম্পারেচারে এক কাপ চা পান করার মতো। খুব বেশি গরম হলে জিভ পুড়ে যাবে, আবার খুব বেশি ঠাণ্ডা হয়ে গেলে চা-পানের তৃপ্তিটা থাকবে না।

সেই জানালার নাম দিলাম “মনের জানালা”। এবারে এই মনের জানালার সাথে সমাজের দরজাগুলোর একটা মিথস্ক্রিয়া দেখা যাক।

আপনি যদি বিবাহিত হোন, এবং জানালা হিসেবে যদি কোনো বান্ধবী বা কোন দাতব্য সংস্থাকে বেছে নেন, তাহলে কোনো কথা নাই। কিন্তু সেই জানালায় যদি থাকে পুরুষ বন্ধু, যার সাথে আপনার সখ্যতা? তাহলে দুটি কথা চলে আসে। এবং সেই দুটি কথা গাণিতিক হারে বেড়ে বেড়ে দুইশত কথায় রূপ নেয়।
কথার শুরু হয় পরিবার থেকে, এরপর আত্মীয় এবং সবশেষে সমাজ। তাই মনের জানালা খোলার জন্য সমাজের দরজা সবসময় বন্ধ থাকে। অবিবাহিত নারীদের ক্ষেত্রে এরকম জানালা খোলা আরো বিপদজনক! কেননা তাতে “নষ্ট মেয়ে”-র তকমা গায়ে লেগে যেতে পারে। সমাজের উঁচু শ্রেণীর কথা কিছুটা আলাদা। সেই প্রসঙ্গে না যাই।
তবে মধ্যবিত্ত কিংবা উচ্চমধ্যবিত্ত নামের যে নতুন শ্রেণী আজকাল তৈরি হয়েছে সেই শ্রেণীর মানসিকতায় জেঁকে বসে আছে সংস্কার, লোক লজ্জা, ধর্মের গোঁড়ামি, নিয়মের শৃঙ্খল এবং সব শেষে “পাছে লোকে কিছু বলে” এই আতংক।

জানালা মানেই যে পরকীয়া নয়, কেবল একটি ভালো বন্ধুত্ব। জানালা মানেই যে কেবল শরীরবৃত্তীয় আদান-প্রদান নয়, এর সাথে মানসিক, ক্ষেত্রবিশেষে ইন্টালেকচুয়াল আদান প্রদানের উপাত্তগুলো থেকে যায়, এটা সমাজ আন্দাজ করতে পারে না। আদতে কেউই পারে না। আর তাই এতো কিছু ভেবে জানালাটা আর খোলাই হয় না। সমাজের দরজাগুলো নিয়মমতো খোলে, আবার নিয়মমতো বন্ধ হয়। ঠিক যেভাবে গারদের দরজা খোলা হয়। কিন্তু আমরা তো জানি গারদে জানালা থাকে না।

এই সব মারপ্যাঁচ থেকে বাঁচার জন্য আমরা নিজেরাই চেষ্টা করি নিজেদের জগৎ তৈরি করে নিতে। সোশ্যাল নেটওয়ার্ক, গ্রন্থ, সংগীত, বাগান, পাখি পোষা অথবা কিছুই না করে নিছক দৈনন্দিনের সুরে বেজে চলি। কিন্তু ভোরে ঘুম ভেঙ্গে গেলে পর নিজের একাকিত্বকে নিজের পাশে বসে থাকতে দেখি।

মাঝ বয়সী নারীদের ক্রাইসিসগুলো আরও বেশি তীব্র। জীবনের শুরুর দিকে তারা জান লড়ে দেয় সংসারটাকে গুছিয়ে নেয়ার জন্য। শখের একটা ফুলদানি অথবা লেসের পর্দা কেনার জন্য বাজার খরচের হিসেব থেকে সাবধানে সরিয়ে রাখে অল্প কিছু টাকা। নিজের ব্যক্তিগত শখগুলোর দিকে ফিরেও তাকায় না। বাবার বাড়ি বেড়াতে গেলেও তো পয়সা খরচা হয়। তাই হিসেব করে পৌষ পার্বণে বাবার বাড়ি বেড়াতে যায়। তখন হয়তো দেখা হয়ে যায় সেই ছোট্ট বেলার চড়ুইভাতি খেলতে আসা বান্ধবীটির সঙ্গে। যে আজ নিজের পায়ে দাঁড়ানো আপাতদৃষ্টিতে সফল একজন মানুষ। সেই বান্ধবীকে দেখে এক ঝলক রোদ্দুরের মতো ভালো লাগা কাজ করলেও দিনশেষে মনে হয়, আমার তো কিছুই করা হলো না সংসার ছাড়া।

স্বামী-সংসার এবং সন্তানের একটি স্থিরতা এসে গেলে পর সেই আনএমপ্লয়েড হাউজ ওয়াইফটির আর তেমন কিছু করার থাকে না। তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খায় নিঃসঙ্গতা এবং সে হাতড়ে বেড়ায় জানালা। তার এতো বছরের সাজানো ছন্দে বাঁধা সংসার তার কাছে ধীরে ধীরে বেসুরো ঠেকে। কিন্তু জানালা খুঁজতে কোথায় যাবে সেই নারীটি? যার সাথে কথা বললে, তার মনের ভার হালকা হবে? যার সাথে বসে এক কাপ কফি পান করে দুজনেই যে যার পথে ফিরবে বাড়ি এমন জানালার সন্ধান জারি থাকে সারা জীবন। কেউ খুঁজে পায়, আবার কেউ খুঁজে পেয়েও সেই জানালার ছিটকিনিতে হাত দেবার সাহস রাখে না।

সব আঙুল সমাজের দিকে না তুলে, নিজের দিকেও কিছু আঙুল তুলি চলুন। আমরা আতঙ্ক এবং দ্বিধাগুলো কাটিয়ে উঠতে পারি না বলে আমাদের মনের জানালাগুলো বদ্ধ করেই রাখি। সেখানে হাজার আলোকবর্ষের শূন্যতা ছাড়া আর কিছুই জমে না। পিছুটানগুলো আঁকড়ে রেখে আমরা গেঁড়ে বসে থাকি সেইসব একাকিত্বের সাথে, যেখান থেকে চাইলেই পরিত্রাণ পাওয়া যেতে পারতো।

চাইবার ইচ্ছাটাই যে মরে যায় অভ্যাস আর স্বাভাবিকতার ঠাস বুনটে। হাল আমলের সিরিয়াল আর বক্স অফিস হিট অথবা ফ্লপ মুভিগুলো মোবাইলের ছোট স্ক্রিনে দেখে দেখে চোখের বারোটা বাজে। সময় পেরিয়ে যায়। রাত শেষ করে আরও একটি দিন আসে আরো কিছু একাকিত্বকে সাথে নিয়ে। অথচ চাইলেই পারি নিজেকে মুক্তির আলোয় আলকিত করতে। চাইলেই পারি জানালার ছিটকিনিটা খুলে দিতে। কথা হলো আমরা কি চাই, আমরা কি ভাবি যেভাবে রবির আলোয় ভাবনাগুলো আবর্তিত হয়েছে…
“মুক্ত কর ভয় আপনা মাঝে শক্তি ধর নিজেরে কর জয়।”

লেখক: প্রোডিউসার এবং আরজে সিটি এফএম ৯৬.০

শেয়ার করুন: