লাভ, সেক্স এন্ড ধোঁকা (২য় পর্ব)

প্রমা ইসরাত:

এখন পর্যন্ত আমার সবচেয়ে খারাপ “ব্রেক-আপ” ঝেড়ে ফেলতে আমার সময় লেগেছে দুই মাস। এই দুই মাস আমি আক্ষরিক অর্থে “টুন্ডা লাইগ্যা পইড়া আছি” টাইপ অবস্থায় কাটিয়েছি। এমনিতেই নারী শরীরে পিরিয়ড সাইকেলের হরমোন কারিশমার কারণে মুড উঠানামা করে। তাঁর উপর ব্রেক-আপ এবং সাথে ইহজাগতিক সকল ঝুট ঝামেলা, সমাজ,রাষ্ট্র, আদর্শ, জীবন সংগ্রাম সম্পর্কিত নানান বিষয় মিলিয়ে আমি খুব নাকানি চুবানি খেয়েছি।
ব্রেক-আপ এর সিজনে যে গানটা খুব জনপ্রিয় ছিল সেটা হচ্ছে “অপরাধী” গান।
“পোলা/মাইয়া তুই অপরাধী রে, আমার যত্নে গড়া ভালোবাসা দে ফিরাইয়া দে”

প্রথমে একটু ব্রেক-আপ নিয়ে বলি। ব্রেক আপ বলতে আমরা প্রায় সবাই মনে করি , একটা প্রেমের সম্পর্ক ভেঙে যাওয়া। আদতে ব্রেক আপ মানে হলো, হৃদয় ভেঙে যাওয়া। কোন সম্পর্ক ভেঙে গেলে কেউ ফিঙ দিয়া তিন দোল খেয়ে, যদি বলে ওঠে, “আমি নৃত্য-পাগল ছন্দ, আমি আপনার তালে নেচে যাই, আমি মুক্ত জীবনানন্দ”, তাহলে সেটা তো আর ব্রেক-আপ হলো না। সেটা তো যে “চপোল চপোল হিন্দোল” তাঁর জন্যে আনন্দের ঘটনা।

প্রমা ইসরাত

যাই হোক, অনলাইনের সেনসেশনাল ব্রেক-আপ সঙ্গীত পোলা/মাইয়া তুই অপরাধী রে গানটা খুব শুনেছি। সত্যি বলতে গানের মিউজিকটা খুব মাথায় লেগেছে। আর যারাই গেয়েছে, হৃদয়ে যে তাদের কতো ব্যথা, কত বেদনা, আহা! তবে এই গানের পোলা ভার্সন এর মিউজিক এতো দারুণ বিট এ ছিল যে, আমার উঠে নাচতে ইচ্ছে করেছে, গুজরাটিদের কাঠি নৃত্য আছে না? এই কাঠি নাচকে “ডান্ডিয়া” বলে। তো গানের তালে তালে আমার খুব ডান্ডিয়া নাচতে ইচ্ছে হয়েছে, কিন্তু পার্টনার নাই এই দুঃখে আবার “টুন্ডা লাইগ্যা” শুয়ে পড়েছি।
এই লেখায় বায়াসড হচ্ছি, অপরাধী নারী ভার্সন এর লিরিক্স নিয়ে একটু লিখবো আর কী!

অপরাধী শব্দটা এতে ব্যবহার করা হয়েছে, মেয়েটি ছেলেটিকে অপরাধী বলছে। অপরাধ বিজ্ঞান নিয়ে আমাদের যখন পড়ানো হয়েছিল, তখন পড়েছিলাম মানুষ মাত্রই বিবাদ প্রিয় প্রাণী। মানুষ যেহেতু মানুষ , সে বিবাদে লিপ্ত হবেই, এবং অপরাধ করবে। এই পৃথিবীতে এমন কোন সমাজ এবং সমাজ ব্যবস্থা ছিল না/নেই/হবে না, যেখানে মানুষ অপরাধ করবে না। অপরাধবিহীন সমাজ একটি মিথ।

এখন অপরাধ কাকে বলে? অপরাধ বলতে সাধারণ ভাবে বোঝায়, নীতিবিবর্জিত-অসামাজিক-পাপকাজ। এখন এই তিনটি শব্দই আদতে আপেক্ষিক। এই তিন শব্দ নিয়ে বসে থাকলে, না সমাজ ব্যবস্থা চলবে, না অপরাধ প্রমাণ করা যাবে, না কাউকে শাস্তি দেয়া যাবে। তাই আধুনিক আইনে অপরাধ বলতে বোঝায়, ফৌজদারি আইন ও দণ্ডবিধি অনুযায়ী কোন আইনের লঙ্ঘন।

হৃদয় ভাঙার জন্য কোন আইন, দণ্ডবিধান এই বইগুলোতে নেই। সেটা সম্ভবত বিবেকের ভেতরে থাকতে পারে, কারণ ঢাকা জজ কোর্টের দিকে যে মুড়ির টিন বাহাদুর শাহ্‌ পরিবহন যায়, তাঁর পেছনে লেখা আছে “এই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আদালত মানুষের বিবেক”।

আচ্ছা যাই হোক। এইবার আসি অপরাধী গানে মেয়েটি ছেলেটি কে অপরাধী হিসেবে দোষারোপ করছে সেই যুক্তিতে। মেয়েটি বলেছে, “আমার অনুভূতির সাথে খেলার অধিকার দিলো কে”? আমি বলি, কে দিয়েছে। আপনার অনুভূতির সাথে খেলার অধিকার আপনিই দিয়েছেন।

না, এই কথা শুধু আমি বলছি না। রুজভেল্ট বলেছেন, “তোমার সম্মতি না থাকলে কেউ তোমাকে আঘাত করতে পারে না”, আর মহাত্মা গান্ধী বলেছেন, “আমার ক্ষেত্রে যা ঘটে, তা আমার অনুমতি নিয়েই ঘটে”। তাঁরা এগুলো বলেছেন বলেই সেগুলো মেনে নিতে হবে এমন কোন কথা নেই। প্রত্যেকের নিজ নিজ প্যারাডাইম আছে। কিন্তু দুঃখ পাওয়া, অনুভূতিতে আঘাত পাওয়া এগুলো আমাদের নিজেদেরই সিদ্ধান্ত।

হয়ত কথাগুলো অযৌক্তিক লাগতে পারে, কিন্তু এটা বাস্তব। আমরা যেমন ভালোবাসার সিদ্ধান্ত নেই, কারো জন্য হাত পুড়িয়ে রান্না করার সিদ্ধান্ত নেই, টিউশনির টাকা জমিয়ে আবেগ কেনার সিদ্ধান্ত নেই। ঠিক তেমনি সেই মানুষের আঘাত আমি নেবো কি নেবো না সেই সিদ্ধান্তও আমার। আমাকে অপমান করার, কষ্ট দেয়ার, নিপীড়ন করার অধিকার তাকে দেবো কি দেবো না, সেই সিদ্ধান্ত আমার।

কেউ যখন কাউকে ভালোবাসে, তখন সেই ভালোবাসায় আবেগ থাকে, মায়া থাকে, এবং থাকে সিদ্ধান্ত। তো, সেই ভালোবাসার মানুষটির সাথে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেলে তাকে দোষ দিয়ে অপরাধী বানানোর কোন যুক্তি নেই। আপনি সম্পর্কে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, সে সম্পর্ক না রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ব্যাপারটা খুব কষ্টের, কিন্তু ব্যাপারটা এমনই।

এবার আসা যাক পোলা অপরাধী কখন হবে। পোলা অপরাধী তখন হবে যখন সে আপনাকে শারীরিক এবং মানসিক ভাবে নিপীড়ন করবে, শারীরিক আঘাত করবে, আপনাকে ধর্ষণ করবে, কিংবা ধর্ষণের চেষ্টা করবে কিংবা আপনার টাকা পয়সা মূল্যবান সম্পত্তি নিয়ে উধাও হয়ে যাবে, জোরপূর্বক দখলে রাখবে। সেই ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট আইন অনুযায়ী সেই পোলা’র বিরুদ্ধে আপনি অবশ্যই অবস্থান গ্রহণ করতে পারেন। তবে আপনারা যারা একটু টাইট দেয়ার জন্য, এবং আবার আপনার সেই “পোলা তো নয় যেন আগুনেরই গোলা” কে কাছে রাখার সাধে, আইনের আশ্রয় নেন/ ভয় দেখান/হুমকি দেন, এবং ওই পোলা এসে লাল্টু পাল্টু আলাপ দিলেই আবার গলে যান, আপনাদের জন্য এই লেখা না। আপনারও নিপীড়ক, তবে অন্য কিসিমের। পরবর্তীতে এই নিয়ে আমি লিখবো। অবশ্যই লিখবো।

এইবার আসা যাক অর্থই অনর্থের মূল এই ব্যাপারে। একটি সম্পর্ক, সেটা বন্ধুত্ব, সহকর্মী, স্বামী স্ত্রী, যেই রকমেরই হোক না কেন, টাকা পয়সার লেনা দেনা হলে ঝামেলা হতেই পারে। আমরা বন্ধু বান্ধব অনেককেই টাকা বা মূল্যবান জিনিস ধার দেই; বিশ্বাস, ভরসা, পারস্পরিক বোঝাপড়া ইত্যাদির ভিত্তিতে।

কিন্তু মানুষ মাত্রই বিচিত্র জীব। মানুষের মন বদলে যায়। সেক্ষেত্রে আপনার প্রেমিক বা প্রেমিকাকে যদি টাকা পয়সা বা মূল্যবান কিছু ধার দেন, তবে সেক্ষেত্রেও বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি। পুরো লেনা দেনা লিখিত থাকলে দুই পক্ষেরই সুবিধা হয়। নইলে পরবর্তীতে যদি, আপনার প্রেমিকা/প্রেমিকের নামে অভিযোগ করে বলেন, পোলা/মাইয়া রে তুই অপরাধীরে, বিছানায়ও শুইলি, টাকাও নিলি, এটলিস্ট টাকাগুলি দে ফিরাইয়া দে, তবে আমার মতে, আপনার কপাল বরাবর একটা লাত্থি আপনার প্রাপ্য, কিন্তু সভ্য ভব্য সুশীল সমাজে কিছু উকিল আপনি তবুও পাবেন, যারা একটি মারদাঙ্গা কেইস আপনার হয়ে ফাইল করে দিবে। সেই ক্ষেত্রে পোলা এবং কিছু ক্ষেত্রে মাইয়াদের প্রতি সতর্ক বার্তা এবং সমবেদনা।

প্রেমে দুঃখ পেয়ে আরেকটি ভিডিও দেখলাম একজন ক্রিকেটারের প্রেমিকার ভিডিও সম্ভবত। আসলে অনলাইন অশ্লীল শব্দ বোমা ক্রেজ সেফাত উল্লাহ্‌র ভিডিও দেখতে গিয়ে, মানে অনেকটা চাঁদ দেখতে গিয়ে আমি তোমায় দেখে ফেলেছি হয়ে গেছে। মেয়েটি কেঁদে কেঁদে অনেক কিছু বলছিল, আর সেফাত উল্লাহ্‌ মেয়েটিকে বকছিল। তবে উন্মাদ হোক আর যাই হোক, এই লোকটির একটি কথা ভালো লেগেছে, “ছেলে তোরে পছন্দ করে না, তুই এর পিছনে যাস ক্যান”।

তো, ঘটা করে সম্পর্ক গভীর এবং কত যে গভীর, সেই কথা জানাতে পছন্দ করি আমরা। হ্যাঁ, আমরা, এই সুশীল মানব সমাজ। এই প্রাণী জগতে যৌন চাহিদার ব্যাপারে সবচেয়ে নির্লজ্জভাবে লাজুক মানব জাতি। এবং আরও লাজুক এই বাঙালি সমাজ। মানে সে গরীবের মধ্যে আরও গরীব, ছোটলোকের মধ্যে আরও ছোটলোক। তাই “যৌন সম্পর্ক করেছে” এই কথাটি, বোল্ড করে, গলা উঁচিয়ে কিংবা গলা খাদে নামিয়ে, ফিস ফিস করে, চোখে টিপি দিয়ে নানান ভঙ্গিতে বলতে ও শুনতে আমরা পছন্দ করি। সম্পর্কে দোষারোপের সময় এই বক্তব্য একটি ব্রহ্মাস্ত্র। দুজন মানুষ তাদের সম্পর্ক চলাকালীন, পারস্পরিক সম্মতিতে, মার্ক্স এঙ্গেলস নিয়ে আলাপ করবে, নাকি তসবি জপবে, নাকি দুজন একসাথে মধু মালতী ডাকে আয় গানটি গাইবে, এটা সেই দুজন মানুষের সিদ্ধান্ত। এটা নিয়ে ছড়িয়ে লাট শুধু তারাই করতে পারে, যারা না নিজেদের সম্মান করে, না অন্যকে। সবচেয়ে বড় কথা তাঁরা নিজেরা সিদ্ধান্তের সম্মান করতে জানে না।

প্রতিটি বিষয় একটি আরেকটির সাথে সম্পর্কিত। আমাদের ভালোবাসা, প্রেম আবেগ সম্পর্ক এগুলোও সমাজ ব্যাবস্থা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। পুঁজিবাদ এবং পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যাবস্থায় নারী এবং পুরুষের সম্পর্ক লাভ, সেক্স এবং এর পর ধোঁকায় ঘুরপাক খায়।

ব্রেক-আপ হলে আমি ঈগল হয়ে যাই। জানেন তো, ঈগল চল্লিশে পৌঁছুলে তাঁর ঠোঁট ভোঁতা হয়ে যায়, পাখা ভারী হয়, পায়ের থাবা নরম হয়ে যায়। সেই ঈগলের কাছে অপশন থাকে আত্মহত্যা করার, শকুনের মতো উচ্ছিষ্ট খেয়ে বেঁচে থাকার, কিংবা আবার জীবন শুরু করার। ঈগল তাঁর ঠোঁট পাথরে বাড়ি দিয়ে ভেঙে ফেলে, ছিঁড়ে ফেলে পাখা, ঘষে উঠিয়ে ফেলে থাবার নখ। তারপর প্রতীক্ষা, ১৫০ দিন । এইভাবে ঈগলকে কষ্ট করতে হয়। দেখতে দেখতে তাঁর নতুন ঠোঁট, নতুন পাখা, নতুন থাবা ফিরে আসে। এবং সে আকাশে পাখা মেলে আবারও তাঁর আত্মগরিমায়, সম্ভ্রমে, স্বাধীনতায়।

ভালোবাসা এবং মর্যাদার মধ্যে কোনো ক্রাইসিস নেই। দুটো থেকে যে কোনো একটি যদি বাছাই করতে হয়, মনে রাখতে হবে, আমিই ভালোবাসা, আর মর্যাদা আমার একমাত্র অপশন।

তো আপনি ভালোবাসা হবেন, না উকুলেলে বাজিয়ে অপরাধী গাইবেন আপনার ব্যাপার।

দ্যা চয়েজ ইজ ইয়োর্স বেইব।

আগের পর্বের লিংক:

https://womenchapter.com/views/24327

শেয়ার করুন: