ইমতিয়াজ মাহমুদ:
নারীবাদ বা ফেমিনিজম নিয়ে খুব জটিল কোন ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ কি জরুরি? আমার তো মনে হয় না। তাইলে মাঝে মাঝে যে লোকে একে অপরকে বিজ্ঞের মতো বলতে থাকে, এটার মানে নারীবাদ না, বা নারীবাদ মানে ওটা না ইত্যাদি, এইসবের মানে কী? নারীবাদ মানে কি তবে খুব কঠিন রকমের সুনির্দিষ্ট রীতিনীতি বা বিধিবিধানওয়ালা একটা পলিটিক্যাল সিস্টেম? আপনি যদি নারীবাদী হতে চান, তাইলে কি আপনাকে একরকম একটা পরীক্ষা পাশ করে ‘এইসব নিয়ম নীতি কঠোর ভাবে মানিয়া চলিব’ ধরনের শপথবাক্য পাঠ করে নারীবাদী সার্টিফিকেট পেতে হবে?
না। যারা এইটা নারীবাদ না বা নারীবাদ মানে ঐটা না এইরকম কথা বলে, এরা বেশিরভাগই প্রতিক্রিয়াশীল পুরুষবাদী পাণ্ডা।
পুরুষবাদী পাণ্ডারা এইরকম কেন বলে? দুনিয়ার সকল রাষ্ট্রই তো পুরুষবাদী, আর সকল সমাজ সকল ভাষা সকল আইন- অন্যভাষায় বললে সকল সংস্কৃতিই পুরুষতান্ত্রিক। কেন? কারণ মৌল কাঠামো, মানে কিনা অর্থনৈতিক কাঠামো সেইটাই যে পুরুষতান্ত্রিক। রাজনৈতিক কর্মীরা সমাজগুলিকে যেইভাবে নাম দেয়, সামন্তবাদী সমাজ বা বিকশিত পুঁজিবাদী সমাজ বা অবিকশিত আধা পুঁজিবাদী বা আধা সামন্তবাদী সে যে সমাজই হোক, সবগুলিই পুরুষতান্ত্রিক। অর্থনৈতিক কাঠামোর যে চরিত্র, আইন কানুন ধর্ম সবকিছুই সেই চরিত্রেরই হবে।
মানুষের চিন্তাও সাধারণত এই চরিত্র দিয়েই গঠিত হয়, অর্থাৎ সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামো যেটা সমাজের সংখ্যাগুরু মানুষের চেতনার ধরনটা সেইরকমই হয়। বিশেষ করে শিক্ষিত মধ্যবিত্তের চেতনা, সেটা একদম প্রচলিত সমাজ ব্যাবস্থার অনুগত হয়ে থাকে। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত যদি বিপ্লবের চিন্তা করে সেটাও দেখবেন যে ওরা প্রচলিত রীতিনীতি ও মূল্যবোধ নামক যেসব আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক নর্ম আছে সেইসব দিয়েই জাস্টিফাই করতে চায়। আপনার পরিচিত বিপ্লবীদের মধ্যে অনেককেই দেখবেন যে ‘বিপ্লবী কাজ’ আর ‘ভালো কাজ’ দুইটাকে এক অর্থেই ব্যবহার করেন। বিপ্লব আর কল্যাণ এগুলিও একসাথে মিলিয়ে ফেলেন।
(২)
এইটা কেন হয়? কারণ ওদের মগজ দখল করে রেখেছে প্রচলিত অর্থনৈতিক কাঠামো থেকে জন্ম নেওয়া সমাজের প্রথা প্রতিষ্ঠান বিধিবিধান এইসব। প্রচলিত প্রথার বাইরে কিছু চিন্তা করার ক্ষমতা সাধারণত প্রচলিত শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্তের বেশিরভাগ মানুষেরই থাকে না। অনেকটা ধর্মবিশ্বাসীদের মতো। ওরা ভালো-মন্দ নির্ধারণ করে ওদের গ্রন্থের বিধানের স্কেলে। আপনি যদি ওদের এই মাপ নিয়ে প্রশ্ন করেন, ওরা আপনাকে ওদের গ্রন্থ দেখিয়ে দেবে। আপনি যদি ওদের গ্রন্থের যথার্থতা বা সত্যতা বা গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন করেন, তখন ওরা আপনাকে বলবে যে এই মহাগ্রন্থ যে সঠিক এবং নির্ভুল, সেটা নিয়ে কোন সন্দেহের অবকাশ নাই। কেন? তখন ওরা আবার সেই গ্রন্থ খুলেই দেখিয়ে দেবে, এই যে এখানে লেখা আছে যে এই গ্রন্থ নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নাই।
কেননা পুরুষবাদী সমাজের সংস্কৃতি ওদের মগজ দখল করে রেখেছে, আপনি যখন প্রচলিত প্রথাসমূহের মৌলিক জায়গাটায় আঘাত করতে চাইবেন, তখন ওরা আপনার চিন্তাকে সেই প্রচলিত সমাজের নর্ম দিয়েই মাপতে আসবে। তাইলে তো দেখা যাবে যে আপনার চিন্তা ওদের নর্মের সাথে মিলছে না। তখন ওরা বলবে যে এটা তো সমাজের মৌলিক মূল্যবোধ ইত্যাদির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ না, সুতরাং এটা মন্দ, এটা বাতিল এবং এটা কোন মতবাদ হতে পারে না। এইখানে এসেই ওরা বলে যে নারীবাদ মানে এটা না, বা নারীবাদ মানে সেটা না ইত্যাদি। আর নারীবাদীরা যেহেতু ওদের সমাজের মৌলিক মূল্যবোধগুলিই টেনে নালায় ফেলে দিতে চায়, নারীবাদীরা তাইলে ওদের চোখে কী? নারীবাদীরা ওদের চোখে নষ্টা, সমাজ বিরোধী, ভ্রষ্টা ইত্যাদি।
একজন নারী যিনি প্রচলিত নর্ম মানবে না, সে তো বর্তমান সংস্কৃতিতে অবশ্যই মন্দ নারী। ভালো কে? ভালো মানে কী? ভালো মানে হচ্ছে সকল প্রচলিত বিধিবিধানকে সঠিক জ্ঞানে মেনে চলা। ভালো আর মন্দ এইসব কথা তো হচ্ছে ভ্যালু জাজমেন্টমূলক কথা। জাজমেন্ট কীভাবে করবেন? কতোগুলি নর্ম নেবেন, সেইসব নর্মের সাথে মিললে ভালো, না মিললে মন্দ। প্রচলিত সমাজের নর্ম ভাঙার কথা বললে তো আর আপনার কথা প্রচলিত নর্মের সাথে মিললো না। সুতরাং আপনি মন্দ।
(৩)
এইজন্যেই দেখবেন যে এমনিতে বেশ ভালো মানুষ নারীর প্রতি সহানুভূতি আছে, নারীর অনেক কষ্ট ও ভোগান্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদও করেন, এইরকম লোকজনও নারীবাদীদের সাথে সুর মেলাতে পারেন না। ওরা নারীর কল্যাণ চান বটে, কিন্তু নারীর অধিকার স্বীকার করেন না। অধিকারের কথা তো সমাজ ভাঙার কথা- সে কথা বললে তো তিনি মন্দই হয়ে যাবেন।
নারীর কল্যাণ চাওয়া আর নারীর অধিকার স্বীকার করা এই দুইটার পার্থক্য তো বুঝেনই। কল্যাণ কী? আপনি নারীর দুর্দশা দেখে সহানুভূতি দেখালেন, বললেন যে না, অবলা নারীর প্রতি এটা অন্যায় আচরণ হচ্ছে, নারীরা হচ্ছে মায়ের জাত, বোনের জাত, ওদের জন্যে একটা কিছু করা দরকার। এইটা হচ্ছে নারীর জন্য কল্যাণের কথা। কল্যাণ যারা করতে চায়, ওরাও নারীকে পুরুষের চেয়ে একটু নিচু বা ঊন ধরে নিয়েই ওদের জন্যে কল্যাণ করতে চান। নারীকে এরাও পূর্ণাঙ্গ মানুষ মানেন না- পুরুষের সমান মানেন না। সদাশয় মানুষরা যেরকম অবলা প্রাণীর কল্যাণ চায়, পুরুষতন্ত্রকে রেখেই কল্যাণ করতে চাওয়া সেটাও একই রকম সদাশয় কাজ। নারীবাদ এইটা না।
নারীবাদের মূল কথা একটাই- নারী পূর্ণাঙ্গ মানুষ, পুরুষের অধীন বা পুরুষের মালিকানাধীন প্রাণী নয়। বাকি আর আর সব কথাবার্তা সব হচ্ছে এই কথাটারই বিস্তারিত ও প্রায়োগিক রূপ। সেখানে নানাপ্রকার মত আছে, পথ আছে, নানান শাখা প্রশাখা আছে। কিন্তু মূল কথা ঐটাই। কোনটা? যে নারীও পুরুষের সমান পূর্ণাঙ্গ মানুষ, একটু কমও না, একটু বেশিও না- সমান।
এইটা যদি আপনি মানেন, তাইলে আপনি নারীবাদ মানলেন। আর আপনি যদি এইটা না মানেন, আপনি নারীর প্রতি সহানুভূতিশীল হতে পারেন, কিন্তু নারীবাদী নন। কেননা নারীকে ঊন-মানুষ যে বিবেচনা করবে, সে আর যাই হোক নারীবাদী তো নয়।
এবং আপনি নারীদের মধ্যেও অনেককে দেখবেন, নিজেকে একরকম নারীবাদী ভাবেন, কিন্তু নারীকে পুরুষের চেয়ে একটু কম মানুষ বিবেচনা করেন। পুরুষরা তো প্রায় সকলেই এইটাই বলেন আরকি।
(৪)
নারীবাদ কিন্তু কোন একটা সুনির্দিষ্ট মতবাদ হিসাবে খুব সুশৃঙ্খলভাবে বিকশিত হয়নি। রাজনৈতিক মতবাদ বা দার্শনিক মতবাদ বা আইনি মতবাদ বা অর্থনৈতিক মতবাদ এইরকম কোন ক্ষেত্রেই বা কোন ক্ষেত্রের মতো নারীবাদ একটা বই বা একসারি বইতে কেউ বিশেষভাবে রচনা করেননি। পণ্ডিত ধরনের লোকেরা আপনাকে নারীবাদের পয়লা জোয়ার, দ্বিতীয় জোয়ার, তৃতীয় জোয়ার, এইভাবে ভাগ করে দেখাবে নারীবাদ কিভাবে বিকশিত হয়ে বর্তমানে কোন অবস্থায় রয়েছে। এইসব ব্যাখ্যা আপনি ইন্টারনেটে ফ্রিতে পাওয়া যায়, এরকম অনেক প্রবন্ধ বের করেও পরে দেখলে পাবেন।
এইসব কথাবার্তা সেগুলি তো গুরুত্বপূর্ণ বটেই, নারীবাদের আজকের অবস্থানে আসার ইতিহাসটা জানাও গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে নারীবাদের মৌলিক জায়গাটা জানা। সেখানে থেকে আপনার চিন্তা আপনাকে বাকি পথ দেখিয়ে দেবে। আর আপনার পথ চলাটাকেই হয়তো পণ্ডিতরা পরে নারীবাদের আরেকটা ওয়েভ বা আরেকটা জোয়ার হিসাবে দেখাবে। সেটা পণ্ডিতদের কাজ, পণ্ডিতরা করুক। আপনার কাজ মূল জায়গাটাকে চিহ্নিত করে সেটার উপর ভিত্তি করে নারীকে দেখার চোখটা অর্জন করা।
মুল জায়গাটা কী? ঐ যে আগে বলেছি- আগে একবার বলেন যে নারীও পূর্ণাঙ্গ মানুষ। বারবার বলেন। এরপর আপনি সেই দৃষ্টিতে দুনিয়া দেখেন। দেখতে গেলে দেখবেন যে, আপনার এই দৃষ্টিটার সাথে দুনিয়ার বিদ্যমান অবস্থা মিলছে না। আপনি জানছেন এবং বলছেন যে নারীও পূর্ণাঙ্গ মানুষ, কিন্তু সমাজে সর্বত্র তো নারীকে পুরুষের মালিকানায় একটি জিনিস বা মাল বা পণ্য হিসাবেই দেখছে। সমাজের সর্বত্র দেখবেন এইটাই বিবেচনা- নারীর মালিক পুরুষ, নারীর দেহের মালিক পুরুষ, নারীর চিন্তার মালিক পুরুষ। কোন ব্যতিক্রম আপনি দেখবেন না। নারীকে সমাজ নানান রূপে দেখে, মা রূপে, স্ত্রী রূপে, প্রেমিকা রূপে, বারবানিতা রূপে, ভগ্নি রূপে, দেবী রূপে এইরকম নানান রূপে। কিন্তু নারীকে কেউ মানুষরূপে দেখে না।
এইখানে আপনি সিদ্ধান্ত নিবেন যে নারীকে কি আপনি সত্যিই মানুষ মনে করেন নাকি করেন না। যদি আপনি নারীকে মানুষ বিবেচনা করেন, তাইলে আপনি হয়ে গেলেন নারীবাদী। আর যদি না করেন, তাইলে না।
(৫)
তাইলে অনেক বুদ্ধিমান লোক যে পদে পদে নারীবাদের সীমানা সংজ্ঞা ইত্যাদি নির্ধারণ করতে চায় ওদের বক্তব্যের সারবস্তু কী? ওদের বক্তব্যের সারবস্তু হচ্ছে ঘোড়ার ডিম, তথা অশ্বডিম্ব তথা অলিক কল্পনা। শূন্যও না, কারণ শূন্যেরও একটা ইয়ে আছে, এদের কথার শূন্যসমান মূল্যও নাই। এইগুলি পুরুষতন্ত্রেরই নানাপ্রকার ফোঁড়া, ফোস্কা বা চুলকানি।
কী কথা বলে ওরা? বলে যে ‘নারীবাদ মানে কি মেয়েদের যা ইচ্ছা তাই করা?’ ‘নারীবাদ মানে কি পুরুষকে শত্রু বিবেচনা করা?’ ইত্যাদি। এইসব প্রশ্নই বাজে প্রলাপ। ও ভাই, নারী যদি মানুষ হয়, তাইলে সে যা ইচ্ছা তাই-ই তো করবে। কেননা মানুষ হিসাবে আপনার যেরকম ইচ্ছা আছে, নারীরও তো ইচ্ছা আছে। এরপর ওরা বলবে যে তাইলে তো সমাজ রসাতলে যাবে। গেলে যাক। এই পচা সমাজ রসাতলে গেল, নাকি কশাতলে গেল তাতে কিইবা এমন ক্ষতিবৃদ্ধি হবে? তখন দেখবেন পুরুষ বা পুরুষবাদী নারীটি বলবে যে, তাইলে কি সামাজিক শৃঙ্খলা বা বিধিনিষেধ বলে কিছু থাকবে না? অবশ্যই থাকবে। কিন্তু সে তো পুরুষের আচরণের উপরও আছে।
নিষেধাজ্ঞা যেটা পুরুষের উপর আছে, সেটা নারীর উপরও থাকবে। যেমন আপনি ইচ্ছা করলেই একজন মানুষকে হত্যা করতে পারেন না- সেটা নারী হলেও পারেন না, পুরুষ হলেও পারেন না। আপনি চুরি করতে পারেন না- এটাও নারী পুরুষ দুইজনের ক্ষেত্রেই সমান। এইসব লিঙ্গনিরপেক্ষ সাধারণ বিধিনিষেধ, যেগুলি নারী-পুরুষ সকলের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, সেগুলি তো আছেই। এর বাইরে পুরুষ যেরকম যা ইচ্ছা তাই করতে পারে, নারীও তাই করবে। এখানে নারীবাদ বা অ-নারীবাদের কী আছে? না, উনারা চান যে নারীর জন্যে কিছু আলাদা নিষেধাজ্ঞা থাকবে, যাতে নারী যা ইচ্ছা তাই করতে না পারে। কেন? কারণ উনারা মনে করেন, নারী পুরুষের চেয়ে কম মানুষ। সেজন্যেই নারী যা ইচ্ছা তাই করবে শুনলে উনারা আঁতকে ওঠেন, আর চিৎকার করে ওঠেন, ‘হায় হায়, নারী কেন যা ইচ্ছা তাই করবে?’
তারপর বলে যে পুরুষকে শত্রু মনে করাই কি নারীবাদ? ভাইজান, চক্ষু খুলে দেখেন, সুস্থ মাথায় চিন্তা করেন। নারী যদি নিজেকে পূর্ণ মানুষ বিবেচনা করে, তাইলে কে সেটাতে বাধা দিতে আসে? কে কাৎরাতে থাকে যে, গেল গেল, ধর্ম গেল, সমাজ গেল, হেন গেল তেন গেল? কে? বেশিরভাগ পুরুষ এবং সেই সাথে পুরুষবাদী নারীরা। তাইলে নারীর অধিকার অর্জনে যারা বাধা দিচ্ছে, ওরা কি নারীবাদের শত্রু? নাকি মিত্র?
(৬)
দেখবেন যে একটা পর্যায়ে এরা অনিবার্যভাবে যৌনতা টেনে আনবে। বলবে যে ‘তার মানে কি একজন নারী যার সাথে ইচ্ছা তার সাথেই শুয়ে পড়বে? ছি ছি ছি!’ বিশেষ করে আপনি যখন বলবেন যে নারীর শরীরের মালিক নারী নিজে, নারীর জরায়ুর মালিক নারী নিজে, তখন তো এরা এই কথাটা বলবেই। তো ভাইজান, নারী যার সাথে ইচ্ছা তার সাথে শোবে না তো কি তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাকে শুতে হবে? আরে যার সাথে ইচ্ছা তার সাথেই তো শোবে। নাকি? তখন এরা বলবে যে, ও তাইলে নারীবাদ মানে হচ্ছে যৌন স্বেচ্ছাচার?
শোনেন, একাধিক পুরুষের সাথে সম্পর্ক রাখার জন্যে একজন নারীকে নারীবাদী হওয়ার দরকার হয় না। উলটোভাবে বললে যে নারীটি একই সাথে একাধিক পুরুষের সাথে সম্পর্ক পছন্দ করেন তিনিই নারীবাদী না। প্রশ্নটা এক বা একাধিক পুরুষের সাথে নারীর সম্পর্কের বিষয় না, বা তার যৌন আচরণের প্রবণতার বিষয় না। আবার তার ইচ্ছা বা সম্মতির গুরুত্বের প্রশ্ন এটা।
পুরুষরা এই শোয়াশুয়ির প্রশ্নটা এতো গুরুত্বের সাথে নিয়ে আসে কেন? নারীবাদ বা নারীর অধিকারের প্রশ্ন এলেই কেন এরা কেবল সঙ্গম বা যৌনতার প্রশ্নটাই সকলের আগে ওদের মাথায় ঢুকে পড়ে! কারণ নারীকে ওরা একটা ভোগের পণ্য বা সঙ্গমের মেশিন ছাড়া আর কিছুই বিবেচনা করে না। পুরুষতন্ত্র নারীকে দেখে কেবল একটা ভূমিকাতেই- বিছানায় পুরুষকে আনন্দ দেওয়া আর পুরুষের জন্যে বাচ্চা পয়দা করা, আর নানাভাবে পুরুষের সেবা করা। এঁর বাইরে নারীর অন্য কোন ভূমিকা যে থাকতে পারে, সেটা পুরুষরা সাধারণত ভাবতেও পারে না। এইজন্যেই যখনই আপনি বলবেন যে নারী তার ইচ্ছামতো যা ইচ্ছা তাই করবে, তখন চট করে ওদের মাথায় কেবল শোয়াশুয়ির স্বাধীনতার কথাটাই মনে আসে।
ভাইসাহেব, শারীরিক মিলন বা শোয়াশুয়ি মানুষের জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ বটে, কিন্তু এটাই মানুষের জীবন না। একটা মানুষ, সে নারী হোক বা পুরুষ হোক, জীবনের কতোটা অংশ বিছানায় সঙ্গমে কাটায়? একজন মানুষ যদি ধরেন সত্তর বছর বাঁচে, তাইলে তার সত্তর বছরের জীবনে মোট কতদিন বা কতো বাস তার সঙ্গমে ব্যয় হয়? অতি নগণ্য বা অনুল্লেখযোগ্য একটা সময় হবে সেটা। কিন্তু পুরুষ তো নারীকে শুধু ঐটুকুর লায়েকই মনে করে- আর কিছু না। সুতরাং পুরুষতন্ত্রের চোখে নারীর সবকিছুই ঐ কেন্দ্রিক।
(৭)
শোনেন, আপনি নানাপ্রকার নারীবাদী দেখতে পাবেন। মার্ক্সবাদী নারীবাদী আছে, সুশাসনপন্থী নারীবাদী, কনজারভেটিভ নারীবাদী, লিবারেল নারীবাদী- নানাপ্রকার নারীবাদী আছে। সত্তরের দশকে একদল নারীবাদী ছিলেন যারা লিপস্টিক পরতেন না, গায়ে লোম রেখে দিতেন, পোশাকেও ঐরকম ইয়েই করতেন। অরুন্ধতী রায়ও নারীবাদী, আমাদের তসলিমা নাসরিনও নারীবাদী, আবার মুম্বাইয়ের শোভা দে, সেও নারীবাদী। এদের মধ্যে আপনি নানারকম মতভেদ প্রকারভেদ দেখতে পাবেন। তাইলে এরা সকলের মধ্যে ঐক্যটা কোথায়? এরা সকলেই কী করে নারীবাদী হলেন?
ঐ কথাটাই আবার ঘুরেফিরে আসে। মূল কথাটা। অধিকারের প্রশ্নটা- যে নারী মানে পুরুষের চেয়ে কম বা ছোট বা নিচু কোন মানুষ না, নারীও পূর্ণাঙ্গ মানুষ এবং পুরুষের সমান মানুষ। এইটাই হচ্ছে মূল কথাটা। বাকিগুলিও গুরুত্বপূর্ণ বটে, কিন্তু সেগুলি হচ্ছে এই মৌলিক অধিকারটা বা সাম্যটা কীভাবে অর্জন করবেন, কীভাবে প্রয়োগ করবেন, রাজনীতিটা কী হবে এইসব নিয়ে নানান মত।
এই মতগুলিতে ভিন্নতা আছে, ভিন্নতা থাকবেই- এইসব ভিন্ন ভিন্ন মত ও পথের মধ্য থেকেই ঠিক পথটা বের হয়ে আসবে এবং সকলেই সেইখানে একদিন ঐক্যবদ্ধ হবে। কেননা মূল প্রশ্নে তো সকলেই এক।
আমার কথা যদি জিজ্ঞাসা করেন, আমি বলবো যে চূড়ান্ত সাম্যবাদী সমাজ অর্জনের আগে নারীর চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হবে না। আর সেই বিজয় কেবল নারীরই হবে না, সেই বিজয় হবে নারী-পুরুষ সকলের। কিন্তু সেটা আবার ভিন্ন প্রসঙ্গ। সেটা আরেকদিন।