স্যালুট রমা চৌধুরী, একটি যুগের অবসান হলো আজ

সুপ্রীতি ধর:

বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা ও একাত্তরের জননী রমা চৌধুরী আর নেই। আজ সকালে চট্টগ্রামে তিনি চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন।
মাত্র সাত মাসের ব্যবধানে আমরা আরও দুজন জননীকে হারালাম। মার্চে চলে গেছেন ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী। ঠিক তার দুদিন আগেই ল্যাবএইডে তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিতে গিয়েছিলাম। উনি আমার হাতটি ধরে কেঁদেছিলেন সেদিন। অস্ফূট স্বরে বলেছিলেন, ‘চলে যাবি?’ তারও কিছুদিন পরই নীরবে নিভৃতে থাকা বীর মুক্তিযোদ্ধা কাঁকন বিবিও চলে গেছেন।

রমা চৌধুরীকে শেষবারের মতোন দেখা হয়নি। দেখা হয়েছিল ছায়ানট মিলনায়তনে বীরাঙ্গনাদের জীবন নিয়ে নির্মিত প্রামাণ্য চিত্র প্রদর্শনীর শো’তে। সেই প্রথম, সেই শেষ। সেদিন জড়িয়ে ধরেছিলাম তাঁকে, কেমন একটা মা মা গন্ধ আমাকে আপ্লুত করে রেখেছিল সেদিনের পুরো সন্ধ্যাজুড়ে। রমা চৌধুরী সেদিন তাঁর বক্তব্যে বলেছিলেন কেমন বাংলাদেশ তিনি দেখতে চেয়েছিলেন। বলেছিলেন, যদি উনাকে সুযোগ দেয়া হতো, তবে সেই বাংলাদেশ তিনি গড়ে দিতে পারতেন।

একাত্তরের এতো এতো বীরত্বগাঁথা আর বীরযোদ্ধাদের গল্পের নিচে চাপা পড়ে গেছে রমা চৌধুরীদের আত্মদান। তাঁদের গল্প আমরা কেউ শুনিনি, আমাদের শোনানো হয়নি ছেলেবেলা থেকে, বড় হয়ে, পরিণত বয়সে আমরা নিজ উদ্যোগে শুনে নিয়েছি, আর পরম শ্রদ্ধায় মাথা নত করেছি, মা বলে, জননী বলে ডেকেছি তাঁদের। কিন্তু ওইপর্যন্তই। এরপর আর কোনো দায়িত্ব আমরা নিজেরাও পালন করিনি। শুধু দূর থেকে শুনে গেছি রমা চৌধুরী অসুস্থ, হাসপাতালে শয্যাশায়ী। মানুষজন যখন তাঁর সুস্থতা কামনা করে গেছে ‘বলতে হয় তাই বলে’ এরকম একটা ভাব করে, আমি ব্যক্তিগতভাবে উনার চিরশান্তি কামনা করেছি।

কারণ আমি জানি, আরও অনেকেই জানে, ১৯৭১ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত কী অমানবিক জীবনই না যাপন করতে হয়েছে তাঁকে। একাত্তরের হাতেগোণা কয়েকটি দিনের নিকৃষ্টতম, বর্বরতম নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন রমা চৌধুরী, কিন্তু গত ৪৭ বছরে তিনি কি এর চাইতেও চরম কষ্টকর জীবন যাপন করেননি? কী পেয়েছেন তিনি? তাঁর খুব যে বেশিকিছু চাওয়া ছিল, তাও নয়। কিন্তু এই সমাজ, এই রাষ্ট্র, এই আমরা তাঁকে তার বিন্দুমাত্র দিয়েছি? দিতে পেরেছি?

পারিনি। আমার এক বন্ধু তাঁর বই প্রকাশের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। সেই খরচটুকু ঊনি নিয়েছিলেন। সেই বই আমরা নিজেরাই কিনে নিয়েছি, কারণ এছাড়া ঊনার পাশে দাঁড়ানোর বিকল্প উপায় ছিল না।

যতোটুকু আমরা গত কয়েক বছরে দিতে উদ্যোগী হয়েছি, ঊনি নিতে চাননি। এখানেই তাঁর বিশেষত্ব, এখানেই তাঁর অহংকার। একাত্তরে তিনি যে শুধু নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন, তাই নয়। দুটি ছেলেকেও হারিয়েছিলেন বিনা চিকিৎসায়। সেই ছেলে দুটির কথা ভেবে, এমনি হাজারও, লাখো সন্তানের কথা ভেবে তিনি কোনদিন জুতা পায়ে হাঁটেননি, সন্তান ব্যথা পাবে বলে, সন্তানের প্রতি একজন মায়ের ভালবাসা থেকে। এমনকি তিনি গণভবনে যখন প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করতে গেলেন, তখনও খালি পায়েই গিয়েছিলেন। এমন মা কি আর হয়? শুনেছি কোনদিন এমন মায়ের কথা? হ্যাঁ শুনেছি, আজাদের মা যতদিন বেঁচেছিলেন, তিনি কোনদিন আর ভাত খাননি ছেলে খেতে চেয়েছিল বলে! রমা চৌধুরীর গল্পটাও ঠিক এরকমই। একেকজন মা একেকটা বিস্ময়!

কিন্তু আমরা সন্তানেরা, আমাদের রাষ্ট্র সেই ভালবাসার প্রতিদানটুকু কোনভাবেই দেইনি, বা দিতে চাইনি। আমরা কজন বীরাঙ্গনা মায়ের কথা জানি?? সংখ্যাটা দুই থেকে চার লাখ। তা যাই হোক, কজনকে চিনি? বা কজনের জীবনযুদ্ধের খবর রেখেছি? আমাদের বানানো সমাজে ‘পতিত’ তাঁরা, কারণ তাঁরা নাকি যুদ্ধে ‘সম্ভ্রম’ হারিয়েছেন! এই যে এতোবার করে বলা আমাদের কথা যে, নারীর সম্ভ্রম যোনিতে থাকে না, একাত্তরে ধর্ষণের শিকার কোনো নারীই ‘সম্ভ্রম’ হারাননি, তাঁরা কেবল নিকৃষ্টতম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, কিন্তু কেউ কি শুনছে আমাদের সেই দাবি? আজও পত্রিকার পাতাগুলোতে চোখ বুলান, দেখবেন রমা চৌধুরীকে তারা ‘সম্ভ্রম’ হারানোর কাতারে ফেলেছেন। একাত্তরে যাদের নখ উপড়ে, চোখ উপড়ে, বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নির্যাতন করা হয়েছে বা হত্যা করা হয়েছে, নানাবিধ উপায়ে ধর্ষণও সেইরকম একধরনের নির্যাতন, যা করা হয়েছে নারীদের ওপর। যা থেকে এখনও মুক্তি মেলেনি নারী-শিশুকন্যাদের।

‘সম্ভ্রম’ যদি কেউ সত্যিকার অর্থে হারিয়েই থাকে, তাহলে হারিয়েছে রাষ্ট্র অথবা সরকার, কারণ তারা নারীকে আরও আরও অধিকতর নির্যাতনের দিকে ঠেলে দিয়েছে চরম অবজ্ঞাভরে। তাদের শারীরিক-মানসিক চিকিৎসার প্রয়োজন ছিল, তা হয়নি। তাদেরকে সমাজের বুকে ভালবেসে টেনে নেয়া উচিত ছিল, তা নেয়নি কেউ। না মানুষজন, না সিস্টেম, না রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা। তাঁরা সমাজচ্যুত হয়েছে, তাঁরা ‘কলংক’ নিয়ে বেঁচে থাকতে বাধ্য হয়েছে নিজ পরিবারেই। যেন তাঁরা উচ্ছিষ্ট, তাঁরা অচ্ছুত। নারীজন্মই যেন তাঁদের পাপ।

ঠিক এরকম একটি অবস্থা থেকেই নিজেকে টেনে তুলেছিলেন রমা চৌধুরী। নিজেকে নিজেই প্রতিষ্ঠিত করেছেন সমাজে। দ্বিধাহীন কণ্ঠে বলেছেন নিজের ওপর ঘটে যাওয়া নির্যাতনের গল্প। বই বের করেছেন নিজের সেই লেখাগুলো দিয়ে। নিজেই ফেরি করে বিক্রি করেছেন। কারও কাছ থেকে এক টাকাও নেননি সহায়তা হিসেবে। এমন বলিষ্ঠ, এমন শিরদাঁড়াসমৃদ্ধ মানুষ আজকাল কই?

এই যে আমরা বলছি সমস্বরে, রমা চৌধুরী আর নেই। বলছি কারণ বলতে হয় আমাদের। নতুন কোনো শব্দ আমরা জানি না বলে। কিন্তু আসলেই কি ঊনি ছিলেন কোথাও? আমাদের জীবনে, আমাদের যাপনে, আমাদের আনন্দ-কোলাহলে? তিনি কি ছিলেন আদৌ? অসুস্থ হওয়ার আগে কি আমরা কেউ কখনও খোঁজ রেখেছি? তাঁকে কি আমরা ব্রাত্য করে রাখিনি আমাদের মাঝে?

এই যে আমরা নারীবাদ, পুরুষতন্ত্র নিয়ে কথা বলি, এই আমরাই কি কখনও রমা চৌধুরীর ভিতরে রোপিত নারীবাদের অস্তিত্বের সন্ধান পেয়েছি? পাইনি। কারণ আমরা তা চাইনি, চেষ্টাও করিনি। জীবনভর তাঁর যুদ্ধ তো একজন নারীবাদী রমা চৌধুরীরই যুদ্ধ। আমরা কজন সেটাকে দেখার চোখ রাখি?

আজ সকালে সব কষ্টের অবসান হলো জননী রমা চৌধুরীর। বিদায় বলবো না, কারণ মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ঊনি আরও বেশি করে এখন বেঁচে উঠবেন। যারা এতোদিন তাঁকে জানতেন না, এখন কিছুটা হলেও জানবেন এবং জানার চেষ্টা করবেন। ঊনি বেঁচে থাকুন আমাদের প্রতিদিনের জীবনে লড়াইয়ের প্রতিভূ হয়ে, বেঁচে থাকুন আমাদের প্রতিটি নি:শ্বাসে। আমরা বেঁচে উঠবো ঊনার সাহসে সাহসী হয়ে, লড়াই চলবে।

স্যালুট মা আমাদের। উইমেন চ্যাপ্টারের সব লেখক ও পাঠকদের পক্ষ থেকে তোমাকে প্রণাম।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.