ইতু ইত্তিলা:
‘তসলিমা নাসরিন’ নামটির পাশে বাংলাদেশের অনেক সাংবাদিকেরা ‘বিতর্কিত লেখিকা’ শব্দটি লিখে খুব আনন্দ পায়। তসলিমা নাসরিনের একটি বইও যে পড়েনি, তাকে যদি জিজ্ঞেস করেন, তসলিমা নাসরিন’কে সে চিনে কিনা, সে হয়তো বলবে, ‘ওই যে ইসলাম বিদ্বেষী বিতর্কিত লেখিকার কথা বলছেন?’
তসলিমা নাসরিনের লেখা পড়ে আমার কখনো মনে হয়নি তিনি বিতর্কিত কিছু লিখেছেন। আমার কাছে তাঁর আদর্শ, চিন্তা-চেতনা একেবারেই স্পষ্ট ও সঠিক মনে হয়েছে। অবশ্য যারা নারীর সমানাধিকারে বিশ্বাসী নন, যারা নারীকে কেবল মা-বোন-বধূ রূপেই দেখতে পছন্দ করেন তাদের কাছে নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়গুলো বেশ বিতর্কিতই মনে হবে। তবে আশার কথা, ইদানিং বেশকিছু পত্রিকা বিতর্কিত শব্দটির জায়গায় ‘জনপ্রিয় লেখিকা’ শব্দটি ব্যবহার করছে।
‘তসলিমা নাসরিন’ নামটির সাথে আমার পরিচয়, যখন আমি ক্লাস ফাইভে পড়ি। ‘লজ্জা’ পড়েছিলাম তখন। তখন ‘হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা’ ব্যাপারটা আসলে কী, এ সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো ধারণা না থাকলেও জীবনের আটটি বছর গ্রামে কাটানোর কারণে গ্রামে হিন্দু পাড়ার প্রতি মুসলমানদের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন হয়, সে সম্পর্কে কিছুটা ধারণা ছিল।
১৯৯৩ সালে সরকারি এক তথ্যবিবরণীর মাধ্যমে তসলিমা নাসরিনের ‘লজ্জা’ বইটি নিষিদ্ধ করা হয়। সেই তথ্যবিবরণী অনুযায়ী, জনমনে বিভ্রান্তি ও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অঙ্গনে বিঘ্ন ঘটানো এবং রাষ্ট্র বিরোধী উসকানিমূলক বক্তব্য প্রকাশিত হওয়ার জন্য ‘লজ্জা’ নামক বইটির সকল সংস্করণ সরকার বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করে। প্রকৃতপক্ষে মৌলবাদীদের আন্দোলনের কাছে মাথা নত করা সরকার, মৌলবাদীদের খুশি করতে বইটিকে বাজেয়াপ্ত করে।
‘লজ্জা’ বইটি ছিল মূলত তথ্যভিত্তিক বই। ভারতের বাবরি মসজিদ ভাঙাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের হিন্দুদের উপর মুসলমানদের বর্বরতার ঘটনাগুলোই লেখক তাঁর লেখায় চিত্রিত করেছিলেন। বাংলাদেশে নিষিদ্ধ হলেও পরবর্তীতে ৩০টিরও বেশি ভাষায় বইটি অনূদিত হয়।
আরও একটু বড় হয়ে পড়েছিলাম ‘নিমন্ত্রণ’ নামের বইটি। ‘নিমন্ত্রণ’ বইটির প্রথম অংশে দুজন মানুষের প্রেমের কথা থাকলেও, এই গল্পের শেষটি ছিল খুবই বাস্তব এবং নির্মম। শেষ অংশটিতে ছিল, প্রেমিকা কীভাবে প্রেমিকের সাথে দেখা করতে গিয়ে প্রেমিক ও প্রেমিকের বন্ধুদের দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয়েছিল সেই কথা। এই সেদিনও খবরে দেখলাম, ঢাকায় প্রেমিকের সাথে দেখা করতে গিয়ে প্রেমিক ও তার বন্ধুদের দ্বারা প্রেমিকা ধর্ষিত হয়েছে। এসব ঘটনা অহরহ ঘটছে।
গল্পে প্রেমিক প্রেমিকার প্রেম থাকবে, প্রেমিকাকে হিরো প্রেমিক সব বিপদ থেকে রক্ষা করছে, এধরনের কাহিনীর লেখকরাই সমাজে হাততালি পাবেন। কিন্তু সমাজের বাস্তব চিত্র যেই লেখকের লেখায় উঠে আসবে, তিনি হবেন নিষিদ্ধ। কারণ আমাদের নিজেদের বাস্তব রূপটা যে এতোটাই কুৎসিত, সেটা আমরা নিজেরাই মেনে নিতে পারি না।
এরপর পড়ি, ‘অপরপক্ষ’। নারীকে মায়ের জাত বলে, মাতৃত্বের জন্য নারীকে মহান করে দেখানো হয়। অথচ পিতার পরিচয় ছাড়া সন্তানের কোন পরিচয় নেই, সে নাকি হয় ‘জারজ সন্তান’। সমাজের এই ভণ্ডামিটা ‘অপরপক্ষ’ নামক উপন্যাসে অসাধারণভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
কবিতা আমার ভালো লাগে না, বেশির ভাগ কবিতার বইগুলোতে কেবল প্রেম আর প্রেম। বাস্তবে তো নারীর প্রতি পুরুষের প্রেম কোথাও দেখি না। দেখি নারীর শরীরটির প্রতি পুরুষের লোলুপ দৃষ্টি। ‘নির্বাচিত নারী’ নামক কবিতার বইটিতে বাস্তবভিত্তিক অসাধারণ কিছু কবিতা পড়ে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম।
‘নষ্ট মেয়ের নষ্ট গদ্য’ বইটির ভূমিকায় লেখক লিখেছেন, ‘নিজেকে এই সমাজের চোখে নষ্ট বলতে আমি ভালোবাসি। কারণ এ-কথা সত্য যে, যদি কোনও নারী নিজের দুঃখ-দুর্দশা মোচন করতে চায়, যদি কোনও নারী কোনও ধর্ম, সমাজ ও রাষ্ট্রের নোংরা নিয়মের বিপক্ষে রুখে দাঁড়ায়, তাঁকে অবদমনের সকল পদ্ধতির প্রতিবাদ করে, যদি কোনও নারী নিজের অধিকার সম্পর্কে সজাগ হয়, তবে তাকে নষ্ট বলে সমাজের ভদ্রলোকেরা। নারীর শুদ্ধ হবার প্রথম শর্ত নষ্ট হওয়া। নষ্ট না হলে এই সমাজের নাগপাশ থেকে কোনও নারীর মুক্তি নেই। সেই নারী সত্যিকার সুস্থ ও শুদ্ধ মানুষ, লোকে যাকে নষ্ট বলে’। ঠিকই তো, প্রতিবাদী কোন নারীকে দমিয়ে দিতে প্রথম যেই শব্দগুলো তার দিকে ছুঁড়ে দেয়া সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো, ‘নষ্ট মেয়ে’।
‘যাবো না কেন? যাবো’ বইটির নামের মধ্যেই রয়েছে একপ্রচণ্ড সাহসিকতা। ‘নির্বাচিত কলাম’ বইটি মূলত লেখকের নব্বইয়ের দশকের পুরুষতন্ত্র ও ধর্মের ভণ্ডামি নিয়ে লেখা অসাধারণ কলামগুলো নিয়ে সাজানো হয়েছে। নব্বইয়ের দশকে লেখক হিসেবে তসলিমা নাসরিন ছিলেন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। ৭১ এর পর বাংলাদেশে নাস্তিকতা ও নারীবাদের হাতে খড়ি হয়েছে তসলিমা নাসরিনের মাধ্যমে। সেসময় তিনি একাই তার ‘অস্ত্র’ (কলম) তুলে ধরেছিলেন, ধর্মের বিরুদ্ধে, পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বিরুদ্ধে। অন্য কোন লেখককে তখন এধরনের বিপদজনক লেখা লিখতে দেখা যায়নি। পরে অবশ্য তসলিমা নাসরিনের জনপ্রিয়তাকে হিংসে করে অনেকেই নারীবাদী বই লেখার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু নিজে নারী হয়ে, নিজের সাথে ঘটে যাওয়া অভিজ্ঞতা, নারীর দুঃখ কষ্টগুলো অনুভব করে লেখা, আর জনপ্রিয়তা লাভের জন্য, নিজের চরিত্রে চরম পুরুষতান্ত্রিকতা রেখে নারীবাদ লেখা তো আর এক হয় না।
‘ছোট ছোট দুঃখ কথা’, ‘দুঃখবতী মেয়ে’, ‘নারীর কোনও দেশ নেই’, ‘নিষিদ্ধ’, ‘শোধ’, ‘বন্দিনী’ বইগুলো পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম। তাঁর বইগুলো আমাকে শিখিয়েছে অনেক কিছু। সমাজের নিয়মনীতির বিরুদ্ধে গিয়ে নিজের অধিকারের পক্ষে লড়াই করার সাহসটুকু আমি সেখান থেকেই পেয়েছি।
তসলিমা নাসরিনের আত্মজীবনীর সাতটি খণ্ড পড়লেই বোঝা যায়, লেখক হিসেবে তিনি কতটা সৎ। যদিও সাতটি খণ্ডের মধ্যে চারটিই বাংলাদেশে নিষিদ্ধ। আত্মজীবনীতে নিজের ভুল ত্রুটিগুলো লিখতে কুন্ঠাবোধ করেননি। পরবর্তীতে সেই ভুলগুলো সাহসের সাথে মোকাবেলা করার কথাও তিনি লিখেছেন। ‘উতল হাওয়া’ বইটিতে রুদ্রের সাথে প্রেমের ঘটনা পড়ে আমরা সবাই বলেছি, ‘আহা কী প্রেম!’ রুদ্রের নষ্টামিগুলো পড়ে অনেকে বলেছে, ‘নিজের বাসর ঘরের কাহিনী কেউ এভাবে রাখঢাক না রেখে বর্ণনা করে! ছি: কী অশ্লীল!’ অথচ কারও চোখে পড়েনি, বাসর ঘরে এক বুক স্বপ্ন নিয়ে আসা মেয়েটির স্বপ্নভঙ্গের কষ্ট।
‘ক’ বইটি আমার কাছে মনে হয়েছে তসলিমা নাসরিনের আত্মজীবনীগুলোর মধ্যে শ্রেষ্ঠ একটি বই। এই বইয়ে অন্য বইগুলোর মতো নারীর জীবনের কান্না-দুঃখ-কষ্টগুলোর চেয়েও বেশি ফুটে উঠেছে বাধা উপড়ে সামনে এগিয়ে চলার সাহসিকতা।
কিন্তু অবাক হয়ে লক্ষ্য করেছি, ‘মেয়েবেলা’, ‘উতল হাওয়া’ বইগুলো পড়ে যারা হাততালি দিয়েছেন, তাদের অনেকেই আবার এই বইটির বিরুদ্ধে গেছেন। নারী কেবল পুরুষতান্ত্রিক শেকলে বন্দী হয়ে যন্ত্রণায় কাঁদবে, প্রেমিককে সমস্ত প্রেম উজাড় করে দিয়ে প্রতারিত হয়ে হতাশায় ডুবে থাকবে এসব দেখতে আমাদের সমাজ অভ্যস্ত হলেও নারী মেরুদণ্ড সোজা করে উঠে দাঁড়িয়েছে, সমস্ত অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করছে, এটাতে অভ্যস্ত নয় আমাদের সমাজ। তাই সমাজের প্রগতিশীল পুরুষেরা এই বইয়ের বিরুদ্ধে গেছে।
সবচেয়ে অবাক হয়েছি বাংলাদেশে প্রথাবিরোধী লেখক হিসেবে পরিচিত হুমায়ুন আজাদের বক্তব্যটি পড়ে। তিনি বলেছেন, ‘সম্প্রতি প্রকাশিত ‘ক’ বইটি সম্পর্কে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় পড়ে আমার মনে হয়েছে, এটি একটি পতিতার নগ্ন আত্মকহন অথবা একজন নিকৃষ্টতম জীবনের কুরুচিপূর্ণ বর্ণনা’। তাঁর এই বক্তব্যতেই বুঝতে পেরেছি, তিনি নারীবিরোধী প্রথাগুলো খুব যত্নে নিজের মধ্যে লালন করতেন।
‘ক’ বইটি নিয়ে বাংলাদেশের আরও কয়েজন বুদ্ধিজীবীর বক্তব্য পড়ে তাদের নোংরা পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার পরিচয় পেয়েছি।
সৈয়দ শামসুল হক, সাহিত্যিক
তসলিমা আমার চরিত্র হনন করেছে। মান-সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে। ৫২ বছরে লেখক হিসেবে আমি যে সম্মান কুড়িয়েছিলাম তা আজ ধুলিস্যাৎ। নিশ্চয়ই এর পিছনে কিছু রহস্য আছে। না হলে তিনি দেশের এতো সম্মানিত লেখক ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে লিখতে সাহস পেতেন না। আমার মনে হয়েছে, প্রতিবাদ করা দরকার। তাই মামলা ঠুকে প্রতিবাদ জানালাম।
সংবাদ প্রতিদিন, ১০ নভেম্বর, ২০০৩
আসাদ চৌধুরী, সাহিত্যিক
‘ক’ বইটি আমি পড়িনি। তবে যার বিরুদ্ধে লেখা হোক না কেন, লেখকের ওপর পাঠকের কতটুকু আস্থা আছে তা অবশ্য মূল্যায়ন করতে হবে। কারণ ব্যক্তি সমাজ বিশাল জনগোষ্ঠি নিয়েই সাহিত্য, কোনও লাম্পট্যের নির্লজ্জ বর্ণনা কখনও সাহিত্য হতে পারে না। আজকের কাগজ, ১১ নভেম্বর, ২০০৩
তসলিমা নাসরিনের কোনও বই ঢাকার কয়েকটি মার্কেট ছাড়া বাংলাদেশের আর কোথাও পাওয়া যায় না। আমি তসলিমা নাসরিনের যেসকল বই পড়েছি, তার বেশিরভাগই বুক শেল্ফের পুরাতন বইয়ের তাকে ছিল। বাকিগুলো ঢাকা থেকে অর্ডার দিয়ে আনিয়েছি। দেশের কোনও দোকানে গিয়ে তসলিমা নাসরিনের বই চাইলে, আপনাকে প্রথমেই দোকানী জানিয়ে দেবে, ওই লেখকের বই তারা বিক্রি করে না। ফ্রিতে একটি উপদেশও দিয়ে দিতে পারে, ওই নাম যেন আপনি মুখে এনে আপনার মুখকে অপবিত্র না করেন।
বাংলাদেশে ‘তসলিমা নাসরিন’ নামটি একটি নিষিদ্ধ নাম। নব্বইয়ের দশকে যিনি ছিলেন জনপ্রিয়তার শীর্ষে, তিনিই কিনা এখন দেশে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ! আপনার কী ধারণা এর পিছনে দায়ী মৌলবাদীরা? মোটেই না। এজন্য দায়ী ভোটের রাজনীতি আর সুবিধালোভী হীনচরিত্রের মানুষগুলো। মৌলবাদীদের কোনও ক্ষমতা ছিল না তসলিমা নাসরিনকে দেশ থেকে বের করার। তসলিমা নাসরিনের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকেছিল মৌলবাদ তোষণকারী সরকার।
তসলিমা নাসরিনের আত্মজীবনী চতুর্থ খণ্ডটি মূলত ১৯৯৪ সালে তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করার পর ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো নিয়ে।
তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার (বিএনপি) ধর্মানুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগ তুলে তসলিমা নাসরিনের বিরুদ্ধে মামলা করে। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি কোরান সংশোধনের কথা বলেছেন। অথচ তিনি শরিয়া নামক বর্বর আইনটি বাতিলের কথা বলেছিলেন, কোরান সংশোধনের কথা নয়। তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হলে তিনি আত্মগোপন করতে বাধ্য হোন।
এ নিয়ে দৈনিক ভোরের কাগজে ক’জন বিশিষ্ট নাগরিকের মন্তব্য-
হুমায়ুন আজাদ, কবি, অধ্যাপক
নাসরিন নামের একটি তুচ্ছ বস্তুকে বাংলাদেশের অপদার্থ সরকার, আনন্দবাজার আর হিন্দু মুসলমান মৌলবাদীরা আন্তর্জাতিক বস্তুতে পরিণত করেছে। এটা এখনকার সবচেয়ে বিরক্তিকর ব্যাপার।…এই সময়ের একটি বেশ হাস্যকর ব্যাপার হচ্ছে, নাসরিনের মতো একটি তুচ্ছ বস্তুকে নিয়ে সারা পৃথিবীর মেতে ওঠা। পশ্চিম ইউরোপ তার জন্য দরজা খুলে দিয়েছে।
আহমদ ছফা, লেখক
তসলিমা নাসরিন ভারতের সৃষ্টি।…তসলিমা এবং তাকে যারা সমর্থন করে তারা মৌলবাদকে এমনভাবে উস্কে দিয়েছে, স্বাধীন চিন্তাভাবনার লোক মস্ত বিপদে পড়ে গেছেন।…তসলিমা এবং তার সমর্থকদের অবিবেচনার কারণে দেশের সমস্ত চিন্তাশীল ব্যক্তি একটি সঙ্কটের সম্মুখে পড়েছে।…একটি অমঙ্গলের শক্তি।
ফরিদা রহমান, সাংসদ, বিএনপি
ঐসব আজেবাজে লেখা ছেড়ে দিয়ে তসলিমার মাফ চাওয়া উচিত। তারপর সাধারণ জীবনযাপন করা উচিত।… জনগণ যদি ক্ষমা করে তারপর আমরা সাধারণ মহিলারা যেভাবে জীবনযাপন করি সেভাবে তার জীবনযাপন করতে হবে।
সূত্র: সেই সব অন্ধকার, তসলিমা নাসরিন।
সেই সময় মৌলবাদীদের তোষণ না করে যদি প্রকাশ্যে তসলিমা নাসরিনের মাথার মূল্য নির্ধারণকারী ধর্মীয় গুরুকে শাস্তির আওতায় আনা হতো, সুবিধাবাদী লেখক প্রগতিশীলেরা যদি সেসময় হিংসের বশবর্তী না হয়ে, সবাই এক হয়ে সেসব মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতেন, সরকারের ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতেন তবে হয়তো আজকের এই দিন আমাদের দেখতে হতো না। এই প্রগতিশীল লোকেদের অনেকেই পরবর্তীতে মৌলবাদীদের প্রশয় দেয়ার ফল ভোগ করেছেন এবং করছেন। সেই ১৯৯৪ সাল থেকেই তো মৌলবাদীরা প্রশ্রয় পেতে পেতে আজকের এই রূপ নিয়েছে। এজন্য মৌলবাদীরা নয়, বরং দায়ী সুবিধাবাদীরা- এ নিয়ে কারও সন্দেহ আছে কী?
বর্তমানে ব্লগার-লেখক-প্রকাশক ইত্যাদি প্রগতিশীল মানুষদের হত্যার বিরুদ্ধে দেশের বুদ্ধিজীবিদের তেমন কোন প্রতিবাদ লক্ষ্য করা না গেলেও, হাজার হাজার মাইল দূরে বসে যিনি একটি আধুনিক প্রগতিশীল রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেন, তিনি ঠিকই তাঁর কলমে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে, সরকারের ভূমিকার বিরুদ্ধে।
অথচ এখনও প্রতিনিয়ত আমরা ‘তসলিমা নাসরিন’ নামটিকে অত্যন্ত সচেতনভাবে বাদ দিয়ে বাংলাদেশে মুক্তচিন্তা, বাক স্বাধীনতার কথা বলি। যিনি বাংলাদেশে নাস্তিকতা ও নারীবাদের সূচনা করেন, যিনি ধর্ম ও পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে লেখার কারণে আজ ২১ বছরেরও বেশি সময় ধরে দেশে নিষিদ্ধ হয়ে আছেন, তাঁকে বাদ দিয়ে মুক্তচিন্তা করাটা আদৌ ফলপ্রসু হয়েছে বা হচ্ছে? যে মুক্তচিন্তা পুরুষতান্ত্রিকতা মুক্ত নয়, সে চিন্তাকে আমি মুক্তচিন্তা বলতে পারি না। এটা এক ধরনের ভন্ডামীর নামান্তর।তারা প্রকৃতপক্ষ ধর্মের কুসংস্কার থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারলেও, নারীবিরোধী সংস্কারগুলো থেকে মুক্ত হতে পারেননি।
বাংলাদেশের প্রগতিশীলদের তসলিমা বিষয়ে এমন নীরবতা আমাকে অবাক ও ক্ষুব্ধ করেছে। তাই ২০১৪ সালে আমি আমার বন্ধুদের নিয়ে ‘তসলিমা পক্ষ’ নামের একটি ফেসবুক পেজ খুলি। তসলিমা নাসরিনের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত মিথ্যা অপপ্রচারগুলো সম্পর্কে মানুষকে জানানো, তসলিমা নাসরিনের লেখাগুলো মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেয়াই এই পেজের উদ্দেশ্য। পরবর্তীতে আমরা তসলিমা নাসরিনের জন্মদিনে, ‘তসলিমা দিবস’ উদযাপন করি। এছাড়াও তসলিমা পক্ষের আয়োজনে মুক্তচিন্তার পক্ষের মানুষদের নিয়ে এ পর্যন্ত বেশ কয়েকটি প্রোগ্রাম হয় শাহবাগে। বর্তমানে দেশের পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে, অফলাইন প্রোগ্রামের ঘোষণা না দিয়ে অনলাইনেই তসলিমা নাসরিনের লেখাগুলো নিয়ে ছোট ছোট অনলাইন পোস্টার বানিয়ে ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করছি।
পুরুষতান্ত্রিক সমাজ, ধর্মান্ধ সমাজ নারীকে নানাভাবে দমন করে এসেছে। নারীর কথাগুলো যাতে উচ্চারিত না হয় সে জন্যই উপামহাদেশের শ্রেষ্ঠ নারীবাদী লেখককে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নিষিদ্ধ করেছে। তসলিমা নাসরিনকে তাঁর নিজ ভূমি নির্বাসন দণ্ড দিলেও সভ্য দেশগুলো তাঁকে নানাভাবে সম্মানিত করেছে। তসলিমা’কে নিষিদ্ধ করাতে তসলিমার খুব বেশি ক্ষতি না হলেও সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাংলাদেশ। তসলিমা নাসরিনের নির্বাসন কেবল একজন মানুষ তসলিমার নির্বাসন নয়, এটি মুক্তবুদ্ধি, মুক্তচিন্তা আর মানবাধিকারের নির্বাসন।
যেসব কথা বলা নিষেধ, সেসব কথাই তিনি জোর গলায় বলেছেন। যে শব্দ উচ্চারণ করা মানা ছিল, সে শব্দই তিনি বারবার উচ্চারন করেছেন। আজ আমরা সেসব শব্দের-ভাষার প্রতিধ্বনি শুনতে পাই। তসলিমা নাসরিন এদেশের নারীদের কথা বলা শিখিয়েছেন, বাধা উপড়ে এগিয়ে চলতে শিখিয়েছেন। আজ আমরা কথা বলতে পারি, প্রতিবাদ করতে পারি। আমরা ভুলিনি তসলিমা নাসরিনকে। নিষিদ্ধ নামটিই আমরা গর্বের সাথে উচ্চারণ করি। কারণ এই নিষিদ্ধ নামেই আমরা আমাদের শক্তি খুঁজে পাই, প্রতিবাদ করার সাহস পাই।