সানজিতা শারমিন:
স্বামী স্ত্রী দুজনের গায়ের রঙের দিক থেকে মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। একজন একদম ফর্সা অন্যজন একদম কালো(!)। বলছিলাম আমার বাবা-মায়ের কথা। জিনগত বৈশিষ্ট্যের কারণে আমরা ভাইবোনের ও বাবা অথবা মা অথবা আমাদের বংশের কারো মতো হওয়াই স্বাভাবিক। সেদিক থেকে আমি পেয়েছি আমার মায়ের গায়ের রঙ অর্থাৎ শ্যামবর্ণ (কালো)। আমার রঙ নিয়ে আমার বা আমার বাবা মা কারোরই কোন মাথাব্যথা ছিল না কখনো।
১.
আমি আর আমার মা ছাড়া আমার বাড়ির সবাই ফর্সা(সুন্দর)। এখন স্বাভাবিকভাবেই আমরা দুজন সবার থেকে আলাদা। খেলতে গেলেও আমি কালো বলে আমার কাজিনরা আমাকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতো, অথচ আমি খেলতামও ভালো আর খেলার সামগ্রীও আমার। আম্মু স্কুল থেকে ফিরলে কেঁদে কেঁদে কতো নালিশ করতাম যে তারা আমাকে কালো বলে ক্ষেপায়। কিন্তু আমার মা হাসিমুখে সব সময় বলতো ওরা তোমাকে মিথ্যে কথা বলে মা। তুমি খুব সুন্দর। মন খারাপ করো না। ওদের সাথেও খারাপ ব্যবহার করো না।
যাই হোক শৈশব আমার ‘কালো মেয়ে’ শব্দটি শুনতে শুনতেই কাটিয়ে দিয়েছি। ওদেরই বা দোষ কী, সারা বাড়ির সবাই ফর্সা এক আমি ছাড়া। স্বাভাবিকভাবেই তারা আমাকে অবহেলা করবে। প্রাইমারি লেভেলে আমি আমার সমবয়সী বাচ্চাদের মুখে শুনতে শুনতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি এবং বিশ্বাস করতে শুরু করেছি আমি কালো এবং অসুন্দর।
২.
প্রাইমারির গণ্ডি পেরিয়ে যখন আমি মাধ্যমিকে ভর্তি হলাম আমার চলার পথ আরো বড় হয়ে গেল, তখন এই শব্দটি আমি আগের চেয়ে বেশি শুনতে লাগলাম। ভেতরে ভেতরে ভীষণ কষ্ট পেতাম। বাবা তখন স্কুল কমিটির সদস্য। বাবাকে এলাকার সবাই চিনে। স্কুলেও উনার মেয়ে হিসেবে পরিচিতি পেয়ে গেলাম। অনেককেই বলতে শুনতাম মেয়েটা বাবার মত হলনা। বাবা কত সুন্দর। একদিন বাবাকে বললাম, বাবা, আমি কি খুব বিশ্রী দেখতে? সেদিন তিনি আমার মাথাটা উনার বুকে চেপে ধরে বলেছিলেন, ‘তুমি পৃথিবীর সব থেকে সুন্দর মেয়ে। যারা এসব বলে তাদের জ্ঞান বুদ্ধি কম মা। মানুষ সুন্দর হয় তার আচার-আচরণে, কর্মে’।
আমার মন ভালো হয়ে গেল। বহুদিন আমার মন খারাপ হয়নি এ ব্যাপারে। বাবার কথা মাথায় এলেই আমি নিজেকে ঠিক করে নিতাম এই ভেবে যে বাবার কথাই ঠিক। কিন্তু প্রতিনিয়ত এসব শুনতাম বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গেলে, কোন আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে গেলে। এক শুধু কলেজের সময়টাতে কেন জানি এসব কথা আমি শুনিনি। হয়তো ওখানে আমার চেয়েও কালো বর্ণের কেউ ছিল, নয়তো বাবা এবং আমাকে পাশাপাশি কেউ দেখেনি।
৩.
নার্সিং কলেজে এডমিশন ফর্ম তুলতে শহরে গেলাম। তো সেখানেই আমার ফুফুর বাসা। আমার ফুফু ভীষণ সুন্দরী (ফর্সা) মানুষ। তো উনার মেয়েরাও উনার মতো। বাবাকে আমার এক বোন সরাসরি বলেই ফেলেছে, মামা আপনি কত সুন্দর, কিন্তু আপনার মেয়েটা এমন বিশ্রী কেমনে হলো! সেই আপুটা তখন একটা গভমেন্ট জব করে বিদেশে ছিল বহুবছর। পড়াশোনা ক্যারিয়ারেও অনেক এগিয়ে। আমার ভীষণ লজ্জা লাগলো যে সে আমার সামনে না বললেও পারতো। বাবা চুপ করে থেকে উঠে সোজা আমাকে নিয়ে বেরিয়ে এসেছেন। অতিরিক্ত রেগে গেলে বা কষ্ট পেলে আমার বাবা কথা বলতে পারেন না।
এই আপু আমাকে এখনো খুব আদর করেন, কিন্তু আমি সেদিনের কথা আজও ভুলতে পারি না। সে যতই আদর করুক, দগদগে ঘা’টা আমার শুকায়নি। হয়তো বাবারও না। অথচ আমার মা-বাবাকে ভীষণ ভালবাসে আপুটা।
৪.
আমি একটা নামীদামী অর্গানাইজেশনেও জব করেছি। একদিন বাবা আমাকে দেখতে গেলেন আমার কর্মক্ষেত্রে। সেই দেখতে যাওয়াটা আমার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ালো। আমার অফিসের অধিকাংশই আমাকে বলেছে, আমি এমন কেন? বাবার মতো কেন না! এর কোন উত্তর কোনদিনও আমি দিতে পারিনি। যদিও উত্তর দেবার মতো উত্তর আমার কাছে ছিল।
৫.
অবশেষে আমার বর্তমান কর্মক্ষেত্রও এর ব্যতিক্রম রইলো না। একদিন কোনো একটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে আমার অফিসার স্থানীয় একজন বললেন নিজে তো পরিষ্কার নও। কাজে কর্মে অন্ততপক্ষে পরিষ্কার থাকো। অবাক হয়ে উনার দিকে তাকাতেই বললেন, ভুল কিছু তো বলিনি তুমি কি অমুকের মতো ফর্সা?
আমি এতোটাই শকড হয়েছি যে, উনাকে বলার মতো কিছু আমি খুঁজে পাচ্ছিলাম না।
শুধু এতোটুকু বলেছি, আপনার সার্টিফিকেটগুলো একেকটা সাদা কাগজ।
উপরের কথাগুলো জাস্ট উদাহরণ। কতোটা মানসিক নির্যাতন করা হয় একটা কালো মেয়েকে।
অথচ আমার গায়ের রঙ নিয়ে আমার কোন মাথাব্যথা নেই। ছিলও না। আমি কখনো বাজার থেকে হাজারটা রঙ ফর্সাকারী ক্রিমের ভেতর থেকে একটা ক্রিম কিনিনি। নিজেকে ফর্সা রাখার জন্য আলাদা কোন যত্ন আমি জীবনে নেইনি। কারণ আমার বাবা মা আমাকে আমার পড়া কোন বই আমাকে শেখায়নি যে গায়ের রঙ কোন যোগ্যতার মাপকাঠি হতে পারে।
এই আমি করি না দৈনন্দিন এমন কোনো কাজ নেই। আমার একাডেমিক ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট কেউ দেখলো না। আমি যথেষ্ট ভালো রান্নাবান্না পারি। নিজে নিজে ইউটিউব থেকে দেখে দেখে অথবা কোথাও কোন কিছু দেখলে বাসায় বসে বসে তৈরি করি। আমি সেলাইয়ের কাজ জানি, আমি হ্যান্ডিক্রাফটের বিভিন্ন কাজ জানি। আমার নিজের জামা আমি নিজে তৈরি করি। হোস্টেলে আমার নিজের ইউনিক ডিজাইনের জামা বানানোর জন্য একটা সুনাম ছিল। আমি বাজার করতে জানি, আমি দেশের একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে নির্দ্বিধায় ছুটে বেড়াতে পারি কারো উপর নির্ভর না করেই। আমি একটা সরকারি চাকুরী করি, আমার নিজের ভরণপোষণ আমি নিজেই করতে পারি, কারো কাছে আমার হাতপাতা লাগে না কোন কিছুর জন্য।
আমি চাইলেই অন্য একজন মানুষকে আমার সাধ্যমত সাহায্য করতে পারি। আমি আমার জীবনে মায়ের হাত ধরে প্রায় হাজার দুই বই পড়ে ফেলেছি। যা আমার আচরণ চিন্তাভাবনাকে আরো শানিত করেছে বাস্তব জীবনে। কম্পিউটারের সমস্ত অফিসিয়াল অপারেটিং ইন্টারনেট ব্রাউজিং চমৎকারভাবে পারি।
অথচ এতো কিছু জানা বা পারা সত্ত্বেও আমার যোগ্যতার মাপকাঠি আমার গায়ের রঙ!!!
আমি ব্যক্তিজীবনে প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসধারী মেয়ে। হতাশা আমাকে কখনো ছোঁয় না। জীবনে অনেক সমস্যা আমি কাটিয়ে উঠেছি কখনো আমাকে কিছুই ভেঙে ফেলতে পারেনি।
আমার লেখা দেখে ভাবার কারণ নেই আমি গায়ের রঙ নিয়ে কষ্টে আছি। কিন্তু আমি মানসিকভাবে নির্যাতিত হয়েছি তাদের আচরণে। আমার আত্মীয় হোক, অনাত্মীয় হোক আমি ভেবে পেতাম না কী করে মানুষ একজন আরেকজনকে গায়ের রঙের জন্য দোষারোপ করতে পারে।
আমি কষ্ট পাই তাদের এসব জ্ঞানের দৈন্যতা দেখে। তাদের বুদ্ধিভিত্তিক চর্চা নেই দেখে। আমি কষ্ট পাই তারা আমাকে এসব বলে জাস্ট মজা নেওয়া ছাড়া নিজের কোনো লাভ করতে পারে না বলে।
এখনও যদি কেউ বলে তুমি কালো, তুমি অসুন্দর তখন তাদের উদ্দেশ্যে আমার বাবার কথাটিই বলতে চাই ‘মানুষ সুন্দর হয় তার আচার আচরণ, কর্মে। গায়ের রঙে নয়’।
বিঃদ্রঃ পড়া শেষে আমাকে সান্ত্বনা দিয়েন না দোহাই লাগে।
২৪.০৮.২০১৮