বেশ করেছে, বিয়ে করছে

সুদীপ্তা ভট্টাচার্য্য রুমকি:

প্রিয়াঙ্কা আর নিকের বিয়ের খবরে ট্রলের বিষয়টি যে কোনদিকে মোড় নিচ্ছে তা অনুমানও করতে পারছি না। এটাকে এখন সুপারহিট বিষয় করে তোলা হয়েছে। আজ একটা পোস্ট দেখলাম প্রিয়াঙ্কা যখন এগারো তখন নিকের বয়েসের অবস্থা সম্বন্ধিত, সেখানে দুজনের বয়সের পার্থক্য বোঝাতে এতোটাই কুরুচিপূর্ণ ছবি ব্যবহার করা হয়েছে যে তা বলতেও রুচিতে বাঁধছে। অথচ সেই পোস্টে অনেকেই কমেন্টের মাধ্যমে নিজেদের যার যার বংশের পরিচয় দল বেঁধে দিতে উঠে-পড়ে লেগেছেন।

আমাদের চারপাশের অনেক মানুষের চিন্তাধারা যে এতো নিচু তা দেখলে খারাপই লাগে। উনাদের দুঃখে, ক্ষোভে, শোকে পোস্ট দিয়ে, কমেন্ট দিয়ে ওদের মুণ্ডুপাত করার একটাই কারণ, তাহলো, কেন প্রিয়াঙ্কা তার চেয়ে ১১ বছরের ছোট নিককে বিয়ে করেছে! মেয়ে হয়ে বয়সে এতো ছোট ছেলে বিয়ে করাটা মেনে নিতে তারা কোনভাবেই পারছেন না। প্রিয়াঙ্কার প্রগ্রেসিভ মাইন্ড নিয়ে অতিষ্ঠ হয়ে নিজেরা নিজেদের এগ্রেসিভ মাইন্ডের পরিচয় নির্লজ্জভাবে দিচ্ছেন তাও ইনারা বুঝতে পারছেন না। অথচ অন্যদিকে রনবীর কাপুর আর আলিয়ার বিয়ের গুঞ্জনে কারো মাথাব্যথা সৃষ্টি হয়নি, কারণ এই ক্ষেত্রে পুরুষটি নারীটির চেয়ে এগারো বছরের বড়।

বিয়ের ক্ষেত্রে পুরুষটিকে বয়সে বড় হতেই হবে, তা না হলে মহাভারত অশুদ্ধ হবে বলে আমার জানা নেই। আমরা সচরাচর যা দেখি তার বাইরে গিয়ে কেউ যদি সো-কলড ‘নৈতিকতা বহির্ভূত’ কোন কিছু না করে, তাহলে কেন অন্যের গাত্রদাহের সৃষ্টি হবে? বিয়ের ক্ষেত্রে বয়সটা কেবল একটা সংখ্যা মাত্র। বিয়ে টেকানোর জন্য সম্পর্কের প্রতি শ্রদ্ধা থাকাটা জরুরি। একটা বিয়ের সফলতা নির্ভর করে একজন আরেকজনের প্রতি কতটা কমিটেড তার উপর। স্বামীর চেয়ে স্ত্রী কতোটা জুনিয়র, তার উপর ভিত্তি করে বিয়ের সফলতা আসে না। আমাদের উপমহাদেশে ব্যতিক্রম ছাড়া বেশিরভাগ দম্পতির ক্ষেত্রে স্বামী বয়সে বড় হয়ে থাকে। তারা সবাই কি সুখী? তাদের সবার বিবাহিত জীবন কি সফল?মোটেই না।

তারপরও একপক্ষ খোঁড়া যুক্তি নিয়ে উপস্থিত হয়ে যাবেন, আরে বোঝনা কেন! ছেলেদের ম্যাচুরিটি দেরিতে আসে, ছেলেরা হেন, ছেলেরা তেন! এসব একপেশে সুবিধাবাদী মন্তব্য ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না আমার। ছেলেদের ম্যাচুরিটি কেন দেরিতে আসবে আবার একটা মেয়ে কুড়িতে বুড়ির মেন্টালিটি নিয়ে বসে থাকতে কেন বাধ্য হবে? সেই দিব্যিটা কে দিয়েছে?

মেয়েরা বরং বেশি ইমম্যাচিয়ুর থাকে জীবনের বিভিন্ন দিক সম্বন্ধে। অনেক সময় কিম্ভুতকিমাকার চিন্তাধারার উদ্ভট জীবনসঙ্গীর দায় এড়ানো সংসারের ঘানি যখন কোনো মেয়ে একা টেনে নিয়ে যায়, তার সেই অনিচ্ছাকৃত বাধ্যবাধকতাকে একটা মেয়ের ম্যাচুরিটি বলে না। সেটা তার মনুষ্যত্ব। বায়োলজিক্যাল কারণে সন্তানকে এড়িয়ে নিজের ভোগ নিয়ে ব্যস্ত থাকতে না পারাটা একটা মেয়ের বিচক্ষণতা নয়, সেটা তার মাতৃত্ব।

আগের যুগে পঁচিশ বছরের ছেলে তিন-চার বাচ্চার বাবা হয়ে সংসার, সন্তান সবই সামলাতে পেরেছে, তারা ক্লান্ত হয়ে যায়নি, অথচ এখন পঁয়ত্রিশ বছর পার করেও ন্যাকা সেজে ছ্যাবলামি করতে থাকা পুরুষের অভাব নেই, যেন তারা কিছুই বোঝেন না। নিজের চেয়ে বয়সে ছোট বিয়ে করা বউ এর উপর সংসার, সন্তান সবকিছুর দায়িত্ব দিয়ে নিজেরা হাত-পা ঝেড়ে বসে থাকেন যারা, তারা এতোই ইমম্যাচিয়ুর যে উনাদের সন্তানের ম্যাচুরিটি চলে এলেও বোধ হয় তাদের তা আসবে না। সন্তান ফিডার খাওয়া ছেড়ে দিলেও মনে হয় তারা নিজেরা সেই ফিডার মুখে পুরে বসে থাকবেন।

এধরনের পুরুষদের আধ বুড়ো বয়সে টিন এজারের মতো আচরণকে ধন্য দেয়ার জন্যও এক পায়ে খাড়া আমাদের কিউট সোসাইটির বৃহৎ অংশ! হাইট, ওয়েট এক জায়গায় থেমে থাকার অর্থ বয়সটাও থেমে আছে, তা কিন্তু নয়। বয়সটা ঠিকই আকাশ ছোঁয়। বয়সে ছোট বউ থাকার পড়েও নিজের হাঁটুর বয়সী, গোড়ালির বয়সী মানুষের সাথেও প্রেমে জড়াতে লজ্জিত বোধ করেন না যেসব পুরুষ, তারা তো ভেবে কুল পাবে না, নিক কী করেছে!

আর “I am the item of entertainment with my age”এই মতাদর্শের ধারক, বাহক, নিম্নরুচি সম্পন্ন যেসব নারী অবিবাহিত বা বিবাহিত, বাচ্চার বাপ কিনা সেদিকে খেয়াল না করে নিজের চেয়ে সাত গুণ বড় লোকের সাথে প্রেম করে পত্নী শুধু না, উপপত্নী হওয়ার লোভও যখন সামলাতে পারে না এবং যদি তা করতে না পারে তাহলেও ছ্যাঁক খেয়ে, সংসার করতে না পারার দুঃখে কোঁ কোঁ করতে থাকে, তাদেরও বোধগম্য হওয়ার কথা না প্রিয়াঙ্কা কোন আক্কেলে এই বিয়ে করেছে! শুধুমাত্র বয়স দিয়ে যারা সম্পর্কের মূল্যায়ন করে, এদের মতো অত্যন্ত চিপ ম্যান্টালিটির নারী বা পুরুষ আসলেই কীভাবে বুঝবে প্রিয়াঙ্কা -নিকের সম্পর্কের অর্থ।

আরেকটা খুবই স্থুল শব্দ ব্যবহার করেন অনেকে যে, মেয়েরা ছেলেদের আগে বুড়ো হয়ে যায়! মনে মনে বলি সেটাতেও দোষ? নিজের চেয়ে দশ, পনেরো বছরের বড়কে বিয়ে করে তার সাথে কোনো দিকে তাল মেলাতে না পেরে হয়তো হাল ছেড়ে দেয়। আর ছেলেরা নিজের চেয়ে ছোট বিয়ে করে তার সাথে পাল্লা দিতে গিয়ে কিছুটা মেইন্টেন্ড থাকেন, এই আর কী! ডিভোর্স, সঙ্গীর মৃত্যু কোন কিছুতেই তো পুরুষের জীবন রথ থামে না, সন্তানের জীবনও সেখানে বিচার্য হয় না। পুরুষটির বয়স পঁয়তাল্লিশ কিংবা পঞ্চাশ হলেও সে আবার নব উদ্যমে জীবন শুরু করে। তাহলে সে বুড়ো হবে কোন দুঃখে?

আর নারীর ক্ষেত্রে পঁয়তাল্লিশ কিংবা পঞ্চাশে আবার নতুনভাবে জীবন নিয়ে ভাবার কথা শুনলে ছি: ছি: করতে করতে মুখে ফেনা তুলে ফেলবে তারাই, যারা কিনা ঐ বয়েসী পুরুষের একাকি জীবনের নাম শুনলে ঘটকালি করতে না পারলে বিনিদ্র রজনী যাপন করতে থাকেন মনের দুঃখে।

হিন্দু অল্পবয়সী মেয়েদেরও যদি স্বামী মারা যায়, বা যদি স্বামী দায় এড়িয়ে পালিয়ে বাঁচে, যেহেতু ডিভোর্স আইনগতভাবে নেই, তাই তাদের জীবনের অবস্থা জানলে অর্ধেক মানুষ অজ্ঞান হয়ে যাবেন তাই আর লিখলাম না আজ। তবে মুসলিম মেয়ের ক্ষেত্রেও সামাজিকভাবে এই নতুন জীবন শুরু করার পথটা এতো মসৃণ নয়, আর বাচ্চা যদি থাকে তাহলে তো মায়ের পরিচয়টাই বড় হয়ে দেখা দেয় মানুষ পরিচয়ের চেয়ে। তারা দু:শ্চিন্তা, অশান্তিতে বুড়ো হবে না তো কী হবে!

তবে এটাও সত্য, যারা সুন্দর মনের পুরুষ, তাদের কাছে জীবনসঙ্গীর জীবনে উপস্থিতিটাই মুখ্য থাকে আজীবন। তারা একসাথে পথ চলার শপথ নেন সঙ্গীর দেহের বয়স দেখে নয়, তা সেই নারী হতে পারে সমবয়সী, ছোট বা অনেক ছোট, কিংবা কোন ক্ষেত্রে হয়তো বড়। বিয়েটাতে যখন আত্মিক সম্পর্ক মুখ্য হয় সঙ্গিনীর সাথে, দেহ সেখানে গৌণ ভূমিকা পালন করে।

কোন কোন সংসার কোনদিনও এতো সুন্দর রূপ নিতে পারতো না যদি পুরুষটি তার সঙ্গীর প্রতি অনুভূতিপ্রবণ না হতো!বিয়ের পর সন্তান ধারণ, পালনে কোনদিন সঙ্গিনীর বিয়ের আগের রূপটি বজায় থাকে না। দেহেরও পরিবর্তন হয়, হোক সে সমবয়সী কিংবা ছোট, কিন্তু পুরুষ সঙ্গীটির ভালবাসা সেখানে না কমে যেখানে বাড়ে, সেখানেই সংসারের আসল সৌন্দর্য, বিয়ের সার্থকতা। পুরুষ মানেই বিকৃত রুচির পৈশাচিক প্রাণী নয় যে তাদের সবার কাছেই নিজের জীবনসঙ্গীর মূল্যায়নের মাপকাঠি হবে স্পেশাল প্রফেশনে জড়িত নারীকে যে মানদণ্ড দ্বারা নির্বাচন করা হয় তা। তাহলে এতো বছর ধরে বৈবাহিক সম্পর্ক চলতো না।

নিক এবং প্রিয়াঙ্কাও হয়তো উদার ভাবেই ভেবেছেন বিষয়টা নিয়ে। সবচেয়ে বড় কথা, তারা তো প্রতারক নয়। তাদের স্ব স্ব স্বামী বা স্ত্রী, সন্তানসন্ততির সাথে প্রতারণা বা বিশ্বাসঘাতকতার মাধ্যমে তারা অনৈতিক সম্পর্কে জড়ায়নি। তারা দুই পরিবারের সম্মতি নিয়েই বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হতে যাচ্ছে। দুইজন অবিবাহিত মানুষ জীবনসঙ্গী হিসাবে কাকে বেছে নেবে সেটা তাদের সম্পূর্ণ নিজস্ব এখতিয়ার। সেখানে অন্যদের উপযাচক হয়ে নিজস্ব মতের পরিস্ফুটন আশা করা নিতান্তই হাস্যকর। তারা দুজনে অবশ্যই অন্যান্য জ্ঞান বিশারদের চেয়ে কম জ্ঞান রাখে না সম্পর্কের রসায়ন সম্পর্কে।তাদের বিয়েটা যদি সফল না হয়, তার কারণ অবশ্যই তাদের বয়সের পার্থক্য হবে না, তা হবে অন্যকিছু। এমন হাজারটা নজির আছে এই পৃথিবীতে যে স্বামী-স্ত্রী সমবয়সী বা স্ত্রী স্বামীর চেয়ে বড়, তাদের বিবাহিত জীবন সফল।

ব্যক্তিগতভাবে আমার শুভকামনা রইলো তাদের যুগল জীবনের প্রতি। প্রিয়াঙ্কা আর নিক তো কারো রাঁধা ভাতে ছাই দেয়নি। লুকিয়ে নোংরামো করে জনসমক্ষে সাধু সাজারও চেষ্টা করেনি। বেশ করেছে বিয়ে করছে। আপনাদের অশান্তিতে সাড়া দিতে তাদের বয়েই গেছে।

শেয়ার করুন: