মাসকাওয়াথ আহসান:
এলিট ফোর্সের এক সুপারকপ ফেসবুকে ফ্যান-ফেয়ার করছিলো। সেখানে সরকারি স্বেচ্ছাসেবক সংঘ (সসেস) সদস্য এসে জানায়, স্যার আমি খিয়াল করছি পুরুষ-জনতাকে ডর দেখায়া কাম হয়; কিন্তু মাইয়া গো দেমাগই আলাদা। কথায় কথায় তারা মাই ফুট কইয়া আনফ্রেন্ড কইরা দেয়।
সসেস-এর এক নারী সদস্য বলে, সহমত ভাই; আইজকাল সব নারীবাদী হইছে; এমন সব কথা বলে যেন বিরাট গিয়ানী আইসা-পড়ছে এক একজন।
এক ঘোমটা দেয়া নারী নেত্রী এসে বলে, এদের চলাফেরা আমাদের মূল্যবোধের সঙ্গে মানানসই নয়। ইনডিসেন্ট পোশাক পরে। এরা উস্কানি দেয়।
সসেস-এর আরেক নারী সদস্য এসে জানায়, আর ঐ যে হিজাবিগুলি আছে না; এরা সব পাকিস্তানি। বাংলাদেশে বইসা খাইতেছে, আর গুজব রটাইতেছে।
সসেস-এর এক রাজনীতি বিশেষজ্ঞ অভিমত রাখে, এরা মুসলিম-বাংলা গড়ার জিহাদে নেমেছে। এই যে আমরা হারমোনিয়াম-ডুগি তবলা পাঞ্জাবি-শাড়ির সাংস্কৃতিক আন্দোলনে একটা সুগভীর অসাম্প্রদায়িক পরিবেশ ধরে রেখেছি; এটা সরিয়ে পাকিস্তানি ভাবধারার হিজাবি কালচার গড়ে তোলার ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে পরাজিত শক্তি।
কোত্থেকে বেরসিক রসরাজ এসে জিজ্ঞেস করে, অসাম্প্রদায়িক পরিবেশ কী স্যার!
পুলিশের সহমত স্যার ফাউন্ডেশনের সদস্য ধমক দেয়, অই তোর এতো বড় সাহস; স্যারের পোস্টে কমেন্ট করস! আবার কী জেলে যাইতে চাস!
সুপারকপের ফ্যান-ফেয়ার পণ্ড হয়ে যায়। ইনবক্সে এক সসেস কর্মী বার্তা পাঠায়, আপনি দিবারাত্র এতো কাজ ক্যামনে করেন তন্ময় হইয়া ভাবি স্যার। আপনার মতো দেশপ্রেমিক অফিসার, বার বার দরকার। কোটা আন্দোলন থেকে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন; সবই উন্নয়নের সরকার বিরোধী ষড়যন্ত্র। আমি ফেসবুকে যারা উস্কানিদাতা ও গুজব প্রণেতা তাদের একটা তালিকা প্রণয়ন করেছি স্যার। অবসরে একটু দু’নয়ন ভরে দেখবেন স্যার।
সসেস কর্মীর লিস্ট অনুযায়ী ধর-পাকড় শুরু হয়ে যায়। চলতে থাকে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ। কিন্তু লক্ষ্য করা যায় এলিট ফোর্সের কপেরা আটক তরুণদের জিজ্ঞাসাবাদের চেয়ে আটক একটি তরুণীকে জিজ্ঞাসাবাদেই বেশি ইন্টারেস্ট দেখাচ্ছে। এমনকী তরুণী যেখানে আটক; সে জায়গাটা পাহারার দায়িত্বে থাকতে চাইছে নন্টে-ফন্টে কপেরা। আগে যারা দেরি করে ডিউটিতে আসতো; তারা আটক তরুণীর সেলের ডিউটিতে পৌঁছে যাচ্ছে সময়ের আগেই।
সিদ্ধান্ত হয় এলিট ফোর্সের কপদের মোটিভেশন বাড়াতে আরো কিছু তরুণীকে আটক করা হবে। উস্কানিদাতা একটি মুখঢাকা গোলাপী সালোয়ার-কামিজ পরা মেয়ের ভিডিও-র সঙ্গে মিলিয়ে গোলাপী সালোয়ার-কামিজ আছে এমন আরেকটি মেয়েকে ধরে আনা হয়।
সসেস-এর এক নারী সদস্য এক কপকে ইনবক্সে আরো কিছু মেয়ের নাম দিয়ে বলে, এদের ফেসবুক টাইম লাইনে কোন উন্নয়ন বন্দনা নাই; শুধুই উস্কানি আর গুজব।
আরো কিছু তরুণীকে আটক করা হয়। এলিট ফোর্সের সিনিয়ার কর্মকর্তা অবাক হয়ে দেখে তরুণদের একঘন্টা জিজ্ঞাসাবাদ করেই যেসব কর্মকর্তারা হাঁপিয়ে ওঠে; তারা বেশ কুটুর কুটুর করে তরুণীদের জিজ্ঞাসাবাদ করে ঘন্টার পর ঘন্টা।
এলিট ফোর্সের এক কপ মনের আনন্দে গুন গুন করে গান করে, এই জিজ্ঞাসাবাদ যদি না শেষ হয়; তবে কেমন হতো তুমি বলো তো।
আরেক কপ পাশে দাঁড়িয়ে বলে, না না তুমি বলো।
এক নারী কপ এসে সিনিয়ার অফিসারকে বলে, স্যার ধরে আনা তরুণ-তরুণীদের জিজ্ঞাসাবাদে কোনভাবেই কোন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া কিন্তু যাচ্ছে না। যারা বিসিএস দিতে চায়; তাদের কোন দলের মিটিং-মিছিল-শো-ডাউনে অংশ নেবার সময় থাকে না।
–কিন্তু সসেস, সহমত ভাই ফাউন্ডেশন ও সহমত স্যার ফাউন্ডেশনের সদস্যরা যে অভিযোগ করলো, এরা সরকার পতনের গভীর ষড়যন্ত্র করছে।
–স্যার আপনার বিসিএস পরীক্ষার আগে আপনার কী সরকার পতন আন্দোলনে অংশ নেয়ার সময় ছিলো! আর নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের তরুণ-তরুণীরা তো বিসিএস-ও দিতে চায় না। এরা উদ্যোক্তা হতে চায়। তারা দেশে বসবাসের পরিবেশ চায়; যাতে পরিবেশ না পেয়ে অনিচ্ছাসত্ত্বেও বিদেশে চলে যেতে না হয়।
সিনিয়ার অফিসার চিন্তায় পড়ে যায়। সসেস-দের অভিযোগে নেচে ওঠাটা খুব প্রফেশনাল সিদ্ধান্ত হয় নি। তবে ওপরেরও চাপ ছিলো সরকার পতনের ষড়যন্ত্রকারীদের যন্তর-মন্তর ঘরে ঢুকিয়ে উন্নয়ন সংগীত শোনানোর।
নারী কপ বলে, তরুণীদের আটক করা খুব জেন্ডার সেনসিটিভ বিষয় কিন্তু স্যার। এদের বিরুদ্ধে সাবস্টানশিয়াল কোন প্রমাণ যদি না থাকে জোর করে প্রমাণ করা যাবে না। বিপদটা হবে ঠিক তখনই। সেটা ফিমেল হ্যারাসমেন্ট কেস হয়ে যাবে স্যার।
এ কথা শুনে সিনিয়ার অফিসারের মুখ শুকিয়ে যায়। রুম থেকে বেরিয়ে একবার রাউন্ডে গিয়ে দেখে, কপেরা হিরো হীরালালের মত সেজেগুজে তরুণীদের জিজ্ঞাসাবাদ করছে। আর তরুণদের জোর করে বিটিভির সামনে বসিয়ে রাখা হয়েছে যাতে তারা বুঝতে পারে; তাদের দেশটি একটা ভূস্বর্গ।
সিনিয়ার অফিসার রুমে ফিরে এসে একটু ফেসবুকে গিয়ে দেখে, এক সসেস তার পোস্টে লিখেছে, কে এই উস্কানিদাতা নবারুণ ভট্টাচার্য! যে সরকার পতন আন্দোলন উস্কে দিতে লাশের গুজব ছড়াচ্ছে! এই দেখুন, কীভাবে এই সুশীল তার মিথ্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে,
যে পিতা সন্তানের লাশ সনাক্ত করতে ভয় পায়
আমি তাকে ঘৃণা করি-
যে ভাই এখনও নির্লজ্জ স্বাভাবিক হয়ে আছে
আমি তাকে ঘৃণা করি-
যে শিক্ষক বুদ্ধিজীবী কবি ও কেরাণী
প্রকাশ্য পথে এই হত্যার প্রতিশোধ চায় না
আমি তাকে ঘৃণা করি-
(এই গল্পের সব চরিত্র কাল্পনিক)