তোমাদের বড়ত্বে আমার দম আটকে আসে

সাদিয়া রহমান:

বড়দের বলছি, তোমাদের বড়ত্বে আমার দম আটকে আসে। তোমাদের বড়ত্বে আমার মা পুরুষতান্ত্রিক, আর তার ছেলে একজন নির্যাতিত। তোমাদের বড়ত্বে আমার বড় বোনটা একজন পুঁজিবাদী নেতা, আর আমি একজন নিম্নবিত্ত। তোমাদের বড়ত্বে পিতা সর্বাধিনায়ক, স্বৈরশাসক, আর আমরা সবাই তার খেলনা। বড়রা, তোমাদের বড়ত্বে তাই আমার দম আটকে আসে।

এই বাংলায় জন্ম নেয়া চল্লিশ বছর বয়সীরাও তাদের বাবা-মায়ের হতাশা। আমরা কেউ বড় হই না। আবার আমরা সবাই বড় হই৷ আমাদের বড়দের একটা ছাঁচ বানানো আছে। সেই ছাঁচে গলিত হয়ে আটকে না যাওয়া পর্যন্ত আমরা অবুঝ। আমরা শিশু, আমরা অপরিপক্ক, আমরা অপরিণত। কত বছর কেটে গেলো আমাদের সেই ছাঁচটা একই রকম রয়ে গেছে। প্রতিটা মানুষকে সেই ছাঁচ দিয়ে মাপ মতোন হয়ে বের হতে হয় এছাড়া সে বাতিল। এক ছাঁচ দিয়ে কি অগ্রগতি আসে?

বড়রা, তোমাদের মাপ কাঠিতে জন্ম নেয়া প্রতিটা শিশু হয় ডাক্তার নতুবা ইঞ্জিনিয়ার আর বাকি সব কলংক। বড়রা তোমাদেরই সেই মাপকাঠিতেই সেই ডাক্তাররা হয় কসাই, ইঞ্জিনিয়ার হয় ঘুষখোর, বাকি সব হয় কলংক৷
বড়রা, তোমাদের বড়ত্বে প্রথম হওয়ার গর্ব আছে, আর শেষ রোলটার শুধু গ্লানি আছে। তোমাদের এই বড়ত্বে আত্মহত্যা বাড়ে আশংকাজনক হারে।

বড়রা, যদিও তোমাদের চোখে কোনো কাজ ছোটোরা পারে না, তবু তোমরা মানো না যে পরিবর্তন তোমরা আনো না।
তোমাদের আধা খাওয়া স্বপ্নে আমরা হাত দিয়ে ব্যর্থ হই, আর সেই দ্বিগুণ ব্যর্থতার বহর আমাদের ঘাড়ে চেপে যায়। আজন্ম ব্যর্থতার গ্লানি টেনে আমরা শেষে মরে যাই।

বড়রা তোমরা ঘরে ঘরে হবুহু এক মানুষ তৈরি করতে চাও। কিন্তু মানব জনমে আর মানব জীবিনের বৈচিত্র্য বুঝো না। সব ঘরে সাফল্যে মোড়া, সকল যুদ্ধে কেবল জয়ী বীরপুরুষ দেখতে চাও। যুদ্ধে জয়ী যে তলোয়ারের আঘাতে কত রক্তক্ষরণ ঘটায় তা দেখতে চাও না। অন্যের এই রক্তক্ষরণকে তোমরা বিজয় ভাবো। আর বিজয় উদযাপন করে ঘরে ঘরে তৈরি হয় শক্ত চোয়ালের একনায়ক। তারপর নিজের তৈরি সে শাসন তোমরা নিজের ঘরে ভালোবাসো আর নিজের ওপরে সে শাসন চললে তার বিরোধিতা করো। ঘরে ঘরে বিভেদ হয়ে আছে এই অন্ধ বড়ত্বের জন্য।

বড়রা বিশ্বাস করো, আমরা ছোটোরা তোমাদের চাই। তোমাদেরকে আমাদের পাশে চাই। কিন্ত আমরা ভুল করতে চাই। ভুল করে ভেঙে যেতে চাই। ছাই হয়ে চোখের জলে মিশে যাবো, কিন্তু বাতিল না হয়ে ছাই থেকে জন্ম নিবো৷ আমরা ভুল করে ঘুরে দাঁড়াতে চাই। ভুল করার স্বাধীনতা চাই।

নতুন পথে যাবার সাহস চাই। বড়রা তোমরা নতুন পথে হাঁটো এমন বলি না। আমরা শুধু চাই আমরা নতুন পথে হাঁটবো আর ঘুরে তাকালে দেখবো হাসিমুখে আমার বড়রা আছে।

আমরা ছোটো। আমরা অতি নগণ্য তোমাদের অভিজ্ঞতার তুলনায়। আমরা শুধু চাই আমাদের যে ভিন্ন ধারার অভিজ্ঞতা আছে তা তোমদের অভিজ্ঞতার আলোকে প্রস্ফুটিত হোক। বড়রা, তোমাদের বাতিল তত্ত্ব যে ছোটো ছোটো মানুষগুলোর জন্য কতটা কষ্টের, তা তোমরা জানো কি?

আমরা শুধু চাই আমাদের অভিজ্ঞতা ছোটো হওয়ার দায়ে বাতিল না হয়ে যাক। আমরা শুধু চাই আমাদের ভাবনাগুলো ছোটোদের ভাবনা বলে ফেলে না দাও। আমরা শুধু চাই ছোটো ভাবনাকেও মান দাও। আমরা শুধু চাই আমাদের মাঝে মাঝে “বেশি বেশি” করবার স্থানটুকু দাও।

বড়রা, তোমাদের বড়ত্বে আমার দম আটকে আসে, কিন্তু তোমাদের বড়ত্ব আমার আশ্রয় হবার কথা ছিলো। বড়রা তোমাদের বড়ত্ব আমার থেকে অমিলে মুখ ফিরিয়ে নেয়, অথচ আমি আশা করে তোমাদের মুখের দিকেই আমার নতুন ভাবনা নিয়ে গিয়েছিলাম।

বড়রা, তোমাদের এমন বড়ত্ব আমাদের তটস্থ করে। আমাদের আস্থা দুর্বল করে। আমাদের দিকে তাকাও বড়রা। একটু সহানুভূতি দিয়ে আমাদের বাড়তে দাও। স্বর্ণলতিকার জীবন না, একটা বটবৃক্ষের জীবন দাও।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.