ঈহিতা জলিল:
কাশেম সাহেব এর স্ত্রী মারা গেছেন গত বছর। দীর্ঘ ছয় বছর রোগে ভোগার পর মারা গেলেন। কী যে মিষ্টি ছিলেন দেখতে!!! হাসলে দুই গালে টোল পরতো। পিঠ ছড়ানো কুচকুচে কালো চুল। এতো সিল্কি ছিলো! কোনদিনও চুল বেঁধে রাখতে পারতেন না। নিপুণ হাতে সাজাতেন সংসার। একমাত্র ছেলের পড়ালেখা, সব। কী সুন্দর করেই না মানুষ করেছেন ছেলেকে। অথচ ছেলের প্রতিষ্ঠা দেখে যেতে পারলেন না।
একা বসে কাশেম সাহেব হাতড়ে ফেরেন পুরনো স্মৃতি!!! কতই বা বয়স তাদের! এমন অসময়ে একা ফেলে কেনো যে চলে গেলো! বুকের ভিতর থেকে একটা অস্ফুট চিৎকার বের হয়ে আসে, “আর তো পারি না বিনু…আমার যে দম বন্ধ হয়ে আসে…আমার ভীষণ একা লাগে। আর কদিন পর ছেলেও কানাডা চলে যাবে, আমার তখন কী হবে?”
তিনি নতুন করে শুরু করতে চাইছেন, তাঁর একজন সঙ্গীর খুব দরকার কিন্তু ছেলে কি রাজী হবে!!!

মুনিয়া বেগম। কত আর বয়স, টেনেটুনে ৪৫। ১৮ বছর বয়সে প্রেম করে বিয়ে করলেন। তাঁর কলেজে সেই ছিলেন সবচেয়ে সুন্দরী। বর তাঁকে আদর করে ‘মন’ ডাকতেন। কিন্তু সুখ যে তাঁর কপালে নেই। বছর ঘুরতেই হঠাৎ স্বামীর মৃত্যু। পেটে তখন একমাত্র কন্যার অস্তিত্ব।
স্বামীর মৃত্যুর পর সন্তানের জন্ম। মৃত স্বামীর ভালোবাসার ঘোর চোখে আর চিহ্ন কোলে নিয়ে কাটিয়ে দিলেন বেশ কয়েক বছর। এই কয় বছরে বহু প্রপোজাল তাঁর জন্য এসেছে। কিন্তু নিজের মনকে সে মানাতে পারেনি। অনেকটা সময় পেরিয়ে যখন নতুন করে শুরু করার কথা ভেবেছেন, তখন মেয়ের প্রবল আপত্তির মুখে সে ভাবনা থেকে সরে এসেছেন। এখন মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। মেয়ের মাথায় এখন চিন্তা এসেছে তাঁর বিয়ে হয়ে গেলে মায়ের কী হবে? সারাটা জীবন মা এভাবে কাটিয়ে দিলো! এখন সে মায়ের বিয়ে দিতে চায়। কিন্তু মায়ের বক্তব্য, ” যখন করার তখনই করিনি, এখন আর এসব নিয়ে ভাবতে চাই না”।
বনানীরা ১০ ভাইবোন। সবাই যার যার মতো প্রতিষ্ঠিত। কোটিপতি বাবার বিশাল ব্যবসা। নাতি-নাতনী নিয়ে ভরা সংসার। এর মধ্যে ক্যান্সারে ওদের মা মারা গেলেন। একা বাড়িতে ওদের বাঘের মতো বাবা কেমন বিড়াল হয়ে গেলো! অনেক ভেবে বনানী আর ওর বড় ভাই সব ভাইবোনদের নিয়ে বসলেন। ওরা ওদের বাবার বিয়ে দিতে চায়। সবচেয়ে ছোট ভাই-বোন দুটি একটু নারাজ হলেও সবার মতের সাথে তাঁরাও মত দিলো।
এরকম হাজারও ঘটনা আমাদের চারপাশে ঘটে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। জীবন সায়াহ্নে এসে হঠাৎ ছুটে যাচ্ছে জীবন সঙ্গীর হাত। কারণ যাই হোক, কখনও মৃত্যু, কখনও ডিভোর্স। সেক্ষেত্রে সন্তানদের ভূমিকা কী হওয়া উচিত?
মা-বাবারই বা কেমন সঙ্গী বেছে নেওয়া উচিত!
বাবা-মায়ের করণীয়
অবশ্যই দ্বিতীয়বার জীবন শুরু করতে গেলে সেখানে আবেগের চেয়ে যুক্তি-ই বেশী কাজ করবে। তাই সিদ্ধান্তও খুব ভেবে নেওয়া উচিত। আপনার সঙ্গী নির্বাচনে এমন কাউকেই বেছে নিন যার অভিজ্ঞতা আপনার মতো অথবা কাছাকাছি। যেখানে আপনাদের জুড়ে রাখবে দুজনের দুঃখ-কষ্ট-না পাওয়া-একাকিত্ব। দুপক্ষের সন্তানদের সমান গুরুত্ব দিন। বন্ধনে জড়ানোর আগেই সন্তানদের সাথে খোলাখুলি আলোচনা করুন। তাদের মতামত শুনুন।
বয়স যদি ৫০ পেরিয়ে যায়, তাহলে নতুন করে সন্তান নেয়া থেকে বিরত থাকুন। সম্পত্তির প্রপার ডিস্ট্রিবিউশন করুন। কারণ আপনার জীবনে আপনি যে সম্পত্তি করেছেন, তাতে আপনার স্বামী/স্ত্রী দুজনের ত্যাগ আছে। তাই এতে অধিকারও আপনাদের দুজনের সন্তানের। নিজের ভবিষ্যৎ এর জন্য একটা অংশ অবশ্যই রেখে নিবেন, যা হবে আপনার ভবিষ্যতের নিরাপত্তা।
কারণ আপনার নতুন সম্পর্ক সাকসেসফুল নাও হতে পারে। আবার যদি সাকসেসফুল হয়, তখন এই সম্পর্কে সন্তান এলে তাঁর ভবিষ্যৎও তৈরি করা আপনার দায়িত্ব। তবে আগের সম্পর্কে সন্তান থাকলে নতুন সম্পর্কে সন্তান না আনাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। নতুন সঙ্গীর ভবিষ্যত নিরাপত্তার বিষয়টিও মাথায় রাখবেন।
সন্তানের ভূমিকা
নিজের বাবা-মায়ের জায়গায় অন্য কোনো ব্যক্তিকে বসানোর চিন্তা করলেই বুকের ভিতরটা নড়ে ওঠে। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তারপরও কথা থেকে যায়। যে বাবা-মা সারা জীবন আমাদের আগলে রেখে কত ত্যাগ করে বড় করলেন, আজ তাঁরা একা। ব্যস্ত জীবনে চাইলেও সার্বক্ষণিক কাছে থাকা অসম্ভব। তাছাড়া কিছু বিষয় থাকে যা শুধুমাত্র জীবনসঙ্গীর সাথে শেয়ার করা যায়, আর কারও সাথে নয়। তাই সন্তান হিসেবে আমাদেরও উচিত তাদের সঙ্গীর চিন্তা করা। তাই বাবা-মায়ের একাকিত্ব,-অসহায়ত্বকে বোঝার চেষ্টা করুন।
মনে নেওয়া অসম্ভব, কিন্তু মেনে নেওয়া সম্ভব। নতুন যিনি আসবেন তাঁকে অসম্মান করবেন না। নিয়মিত খোঁজ রাখবেন। অতি আবেগী হয়ে খুব কাছে না যাওয়াই ভালো। আরেকটা কথা মনে রাখবেন, যিনি আসবেন তিনি আপনার বাবা/মায়ের সঙ্গী, আপনার নয়। আপনার কথামতো চলতেও সে বাধ্য নয়।
আসুন, যুক্তিশীল চিন্তা করি। সমাজ গঠনে ইতিবাচক ভূমিকা রাখি। মনে রাখি, “ফ্যামিলি কামস ফার্স্ট”।
পরিবার সুন্দর হলে সুন্দর হবে দেশ।
ঈহিতা জলিল
১৭.০৮.১৮
শুক্রবার
সময়-০৩.৩৮ মিনিট