বিচার যেখানে শুধুই একটি শব্দ…

সাবিরা শাওন:

ভৌগলিক প্রতিবেদন বলছে, এই উপমহাদেশে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে গেছে, সেই সাথে বাংলাদেশে নদীগুলোও শুকিয়ে যাচ্ছে, আর নদীতে বা দেশে কোথাও যদি পানি না থাকে তাইলে নৌকা চলবে কই? এই নৌকা ভাসিয়ে রাখার জন্য আমাদের সরকার প্রধানরা পানির বদলে রক্ত দিয়ে একটা কৃত্রিম নদী বানানোর চেষ্টা করছেন। কথাটা আমার একান্ত মনগড়া নয়, গত কয়েক দিনের ঘটনা আর দুর্ঘটনাগুলো মনে করলেই বুঝতে পারবেন।

রক্তের বন্যায় আছে দেশের প্রায় সব শ্রেণির মানুষের রক্ত। তবে এর মাঝে এক শ্রেণির মানুষের রক্ত আছে যাদের রক্তের রঙ আমাদের আর সব বাঙ্গালীর মতো লাল হলেও আমরা অন্য রঙ আর অন্যরকম গন্ধ ঠিকই খুঁজে পাই।

বলছিলাম আদিবাসীদের কথা। গত ৯ আগস্ট ছিলো আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস। এই দিনে সারাবিশ্বের সব আদিবাসীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে অনেক সেমিনার, আলোচনা সংঘটিত হয়েছে। আমাদের বাংলাদেশেও এর ব্যাতিক্রম না।

কিন্তু চলুন এবার একটু বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে তাদের নিরাপত্তার নমুনা দেখি।

বিচারহীনতার সংস্কৃতি আমাদের দেশে নতুন নয়, বরং বিভিন্ন সময় আমাদের দেশের সরকার প্রধান ও তাদের চুনোপুঁটিরা এতে নতুন নতুন মাত্রা যোগ করছে। আর সংখ্যালঘুদের ক্ষেত্রে সেই দৌরাত্ম্য কতটা ভয়াবহ হতে পারে তার চিত্র আমরা বিগত দিনগুলোতে দেখেছি, এখনো দেখছি এবং সামনের দিনগুলোতে আরও দেখবো।

মূলত অবৈধ ভূমি দখল ও আদিবাসীদের উচ্ছেদ করার জন্য তাদের উপর যে ধরনের হামলাগুলো করা হয়, তার মাঝে মেয়েদের উপর শারীরিক ও যৌন নির্যাতন এবং ধর্ষণ অন্যতম। এই বছরের শুরু থেকে জুলাই ৭ তারিখ পর্যন্ত ১৫ জন আদিবাসী মেয়ে ও মহিলা ধর্ষিত হয়েছে। (সূত্রঃ দি ডেইলি স্টার ৯ আগস্ট ২০১৮)। যাদের মধ্যে দুজনকে গ্যাং রেপড শেষে মেরে ফেলা হয়। তিক্ত হলেও সত্য এই জঘণ্য কাজগুলোর সাথে প্রায় ৯৫% বাঙ্গালী জড়িত।

সাম্প্রদায়িকতার পারদ যখন উর্ধ্বমূখী হয় তখন সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন কিছুটা গা সওয়া বটেই। আর এরজন্যই তারা এর কোন বিচার পায় না। আমাদের প্রশাসন এই অপরাধীদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করে না বলেই তারা একবার রেপ করার পর আবার হুমকিও দেয় মুখ না খোলার জন্য। পুলিশ, প্রশাসনের এমন নিরব ভূমিকার জন্য অনেক আদিবাসী পরিবার বিচার চাওয়ার চেয়ে কিডন্যাপ হওয়া মেয়েকে জঙ্গলে খুঁজতে যাওয়াটা বেশি নিরাপদের মনে করে। যদি সেই নির্যাতিতাকে পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া যায়, তাহলে তার পরিবারের লোকজন বারংবার হুমকির মুখে নীরব হয়ে থাকে। নাহলে তাদের পরিণতি হয় সুজাতা চাকমার মতো। ছয় বছর আগে সুজাতা চাকমা নিজের ওপর সংঘটিত নির্যাতনের বিচার চাইতে গিয়ে হারিয়েছে নিজের জীবন, আর নিজের ১৩ বছর বয়সী আরো এক কাজিনও নির্যাতিত হয়, ধর্ষণের শিকার হয়। ছয় বছরেও নাকি এই কেসের ইনভেস্টিগেশন অফিসার আর মেডিকেল অফিসার কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেন নাই।

তাহলে গত ২৮ জুলাই বাচ্চা একটা মেয়ে কৃত্তিকার সাথে যা হয়েছে তার জন্য আমাদের আরো কত বছর অপেক্ষা করতে হবে কে জানে! অবশ্য ধৈর্য্য ধরার জন্য ভিক্টিমের পরিবারকে ৫০,০০০/- ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে।

বিচার না পেয়ে নিজেদের অদৃষ্টকে মেনে নিতে অভ্যস্ত আদিবাসীরা আর পত্রিকার কোণায় থাকা এইসব সহিংসতা, অরাজকতার খবর আমাদেরও গা সওয়া হয়ে গেছে। তবুও হয়তো কোন একদিন সুদিন আসবে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের হাত ধরে। অন্ততঃ গত ১০ দিনের (২৯ জুলাই থেকে ৭ আগস্ট পর্যন্ত ছাত্র আন্দোলন) ঘটনা আমাদের এতোটুকু আশার আলো দেখিয়েছে। তারা কাজ করবে দল, মত, ধর্মের উর্ধ্বে সব মানুষের জন্য। অপেক্ষা সেই সুদিনের …।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.