বাবারা অদৃশ্যই থেকে যায়

সালেহা ইয়াসমীন লাইলী:

#সাহেরা এক গৃহস্থ বাড়িতে কাজ করে। সাহেরার বাবাও সে বাড়িতে কাজ করেছে দীর্ঘদিন। এখন বয়স হয়েছে বলে কাজ করতে পারে না। যতোটা না বয়স তার চেয়ে বেশি অসুস্থতা। সারা জীবন অভাব অনটনের শরীরের মাত্রাতিরিক্ত খেটে খেটে নানা রোগ বাসা বেঁধেছে শরীরে। সবশেষে যক্ষাও ধরা পড়েছে। ডাক্তার বলেছে সময় খুব বেশি হাতে নেই।

সাহেরার মা মারা গেছে বেশ কয়েক বছর আগে। এই গৃহস্থ দূর সম্পর্কের আত্মীয় হওয়ায় সাহেরার বাবাকে অসুস্থতা নিয়ে চলে যেতে বলেনি। বরং বাড়ির বাইরের চাকরদের থাকার ঘরটির এক কোণায় তাকে মরার আগ পর্যন্ত থাকার অনুমতি দিয়েছে গৃহস্থ। শাহেরা সারাদিন নিজে কাজ করে। পেটে ভাতের কাজ। বাবাকেও তিন বেলা তিন থালা খাবার খেতে দেয়।

একহারা চেহারার কালো সাহেরাকে বয়সের কারণে সুন্দর লাগে। খাটা-খাটনির মাঝেও যখন সাহেরা হাসে তার শাদা ঝকঝকে দাঁতগুলো ঝলক দেয়। কালো মুখটাও তখন আলো হয়ে ওঠে।

একদিন গৃহকর্তীর নজর এড়ালো না শাহেরা শরীরের পরিবর্তন।কাছে গিয়ে জানতে চাইলে সে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলো শুরুর দিকে। কিন্তু একসময় অস্বীকার করার উপায় থাকলো না তার পেটে বেশ খানিকটা বড় হয়েছে কারো সন্তান। ক্রমে বাড়ি থেকে গ্রামবাসি জানলো এখবর। গৃহস্থ দূর সম্পর্কের এই আত্মীয়কে অস্বীকার করে তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিলেন। তখন সাহেরার বাবার অসুস্থতা অনেকটা বেড়ে গেছে। তিনিও সব জেনে গেছেন। কিন্তু কিছুই করার উপায় তার নেই। হয়তো মেয়ের দsর্দশার চেয়ে নিজের অসহায়ত্বের জন্য বেশি কাতর ছিলেন তিনি।

সাহেরা আশ্রয় নিলো পাশের দোলা জমির মাঝে একটি পরিত্যক্ত স্যালো মেশিন ঘরে। সারাদিন দূরের বাজারে গিয়ে খাবার ভিক্ষা করে। রাতে স্যালো মেশিন ঘরে ঘুমায়। এক রাতে দূর পাড়া থেকে এক সদ্যজাত শিশুর কান্না শুনতে পেলো অনেকে। পরদিন পাড়ার নানা বয়সি নারী শিশুরা সাহেরাকে দেখতে গেলো। ভাঙ্গা বেড়ার ফাঁক দিয়ে ভাঙ্গা দরজা দিয়ে গিয়ে দেখলো মায়ের বুকের পাশে শুয়ে থাকা মেয়ে শিশুটিকে।

সেদিনও সাহেরা নিজের দsর্বল শরীরটাকে টেনে নিয়ে ভিক্ষা করতে গিয়েছিল বাজারে। খুব বেশিদিন সাহেরার আর সে ঘরে থাকা হয়নি। ঘরের মালিক এসে তাকে তাড়িয়ে দিয়েছে। তারপর খোলা আকাশের নীচে, গাছতলায়, খড়ের ঢিবির পাশে তার রাত কেটেছে ঝড়ে-শীতে-রোদে। একদিন এক ঝড়ের রাতে সাহেরার বাবা একা মরে পড়ে ছিল ঘরটায়। পরদিন সাহেরা দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখেছে বাবার শেষযাত্রা। কাছে আসার বা কাঁদারও সাহস হয়নি তার। তারপর কোন একদিন সাহেরা নিখোঁজ হয়েছে। কবে, কোন সময় থেকে তাকে গ্রামে দেখা যাচ্ছে না কেউ তা বলতে পারেনি।

#আফরোজা বড় বোনের বাচ্চা হওয়ার কিছু আগেই বোনের দেখা শুনার জন্য সে বাড়িতে গেছিল। বোনের বাচ্চা হওযার পর বাচ্চাকে দেখাশুনার জন্য বোন দুলাভাই কয়েকমাস তাকে নিজ বাড়িতে ফিরতে দেয়নি। তারপর যখন ফিরে এলো বেশ নাদুস নুদুস হয়েছে তার শরীর। বাড়িতে সবাই বলাবলি করছিল, বাহ! বোনের বাড়িতে তো অনেক যত্ন হয়েছে। ‍স্বাস্থ্যটা বেশ ভালো হয়ে গেছে। বলতে বলতে প্রায় দুই মাস অতিক্রান্ত তবু পিরিয়ড হচ্ছে না দেখে আফরোজার মা উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চাইলেন মেয়ের কাছে। মেয়ের চেহারা পড়ে তিনি বুঝতে পারলেন কি ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটে গেছে তার সাথে। ততো দিনে সাত মাস পার হয়ে গেছে। আফরোজাকে বাড়ির বাইরে যাওয়া বন্ধ করে দেয়া হলো। লোকজনও যেন দেখতে না পারে তার জন্য দরজা আটকিয়ে রাখা হলো। ডাক্তারের কাছে নিয়ে গোপনে বললেন।অনেক টাকা দিতে চাইলেন। ডাক্তার ঝুঁকি নিতে রাজি হলেন না। অগত্যা কবিরাজ বৈদ্যকে ডাকলেন বাড়িতে। তারা নানা গাছ-গাছড়ার ছাল বাকল খাওয়ালো, ব্যবহার করালো কিন্তু সময় বাড়তে থাকলো। কোন কাজে লাগলো না।

এভাবে আরো সময় হয়ে এলো। একদিন তার ব্যথা শুরু হলো। দুইদিন, তিনদিন ব্যথা চললো। ব্যথা আর গোপন রাখতে পারল না। তার গগন বিদারী চিৎকারে গ্রামবাসির ঘুম ভাঙলো। পাশের বাড়ির মালেকা বেগম জোর করেই আফরোজার ঘরের ভিতরে গিয়ে ঢুকলেন। তারপর তিনি যা দেখলেন, আফরোজা সদ্য সন্তান প্রসব করে জোরে জোরে গোঙিয়ে দম ফেলছে, আর তার মা মেঝেতে পড়ে থাকা শিশুটির গলায় পা দিয়ে চেপে ধরে আছে শক্ত করে। আফরোজা সেদিকে অপলক তাকিয়ে আছে। মালেকা বেগম আফরোজার মাকে ধাক্কা দিয়ে সরালেন কিন্তু ততক্ষcB আর দম ফেরানোর সুযোগ পেলেন না।

পরের ঘটনাটি হয়তো এমন- নাসিমা কারো বাসায় গৃহকর্মীর কাজ করতো। সেখানেই কারো বিকৃত লালসার শিকার হয়ে গর্ভবতী হয় সে। এক সময় তাকে শারিরিকভাবে লাঞ্ছিত করা হয়। তাকে প্রচন্ড মারধর করে পা ভেঙ্গে দেয়া হয়। মাথার চুল কেটে দেয়া হয়। তারপর বাড়ি থেকে বের করে রাস্তায় ফেলে দেয়া হয়। নাসিমা কারো সহায়তায় কুড়িগ্রামে চলে আসে।তার শারিরিক অবস্থা চেহারা তাকে পাগলি সাজতে সহায়তা করে। সে পাগলির ভান করে রাস্তায়, দোকানের বারান্দায় পড়ে পড়ে থাকে। কারো সাথে কথা বলে না। ইশারায় খাবার চেয়ে নেয় আর ইচ্ছে করেই হয়তো শরীরটা নোংরা রাখে। এভাবে একদিন তার গর্ভের বয়স ৮ মাস পার হয়। সেসময় তাকে রাস্তা থেকে তুলে মহানুভব এক তরুন হাসপাতালে ভর্তি করায়। প্রায় দুই সপ্তাহ পর হাসপাতালেই নাসিমা জন্ম দেয় এক পুত্র সন্তান।

পাগলি তার সন্তানের দায় নিতে পারবে না ভেবে অনেকে সহায়তায় এগিয়ে আসে। কেউ কেউ দায়িত্ব নিতে চায়। কেউ কেউ সন্তানকে দত্তক নিতে চায়। তারা পাগলির কাছ থেকে শিশুটিকে সরিয়ে নেয়। নেড়ে চেড়ে দেখে। সে সন্তানকে বুকের সাথে জড়িয়ে রাখতে চায়। সরাতে দিতে চায় না। সন্তানের সাথে এটুকু বিচ্ছেদ মানতে পারে না। একসময় সে কথা বলা শুরু করে। ‘আমার বাচ্চা আমার পাশে দেন’। তারপর একটু একটু করে কথা বলে। তবে তার নাম ও ঠিকানা বলতে বললেই বোবার মতো চুপ হয়ে যায়। হয়তো এর পরের গল্প কোন ট্রাজেডিতে শেষ হবে। সময় শুধু অপেক্ষার।

(উপরের দুটি ঘটনা সম্পূর্ণ সত্য। দুটি কুমারী মায়ের করুণ কাহিনী। শেষের ঘটনাটিও কাল্পনিক নয়। দৃশ্যমান সত্য।)

সালেহা ইয়াসমীন লাইলী
লেখক সাংবাদিক

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.