ফারহানা আফরোজ জাহান:
প্রতিরোধ, প্রতিবাদও এতো সুন্দর, এতো ভাল লাগার আর এতো আনন্দের হতে পারে! গা শিউরে উঠার মতো ভাল লাগা। এরা আমাদেরই বাচ্চা, আমাদেরই সন্তান। আমার মতো আরও অনেক মায়ের আদরের সন্তান এরা। এদের প্রতিবাদে একটা দিন বাংলাদেশের রাস্তাঘাট যেন শৃঙ্খলার এক অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছিল।
যে হাত দিয়ে ঘরের ভেতর ভাত তুলে খেতে পারে না, সেই হাতগুলো নাড়িয়ে কী অদ্ভুত ভাবে রাস্তার গাড়িগুলোকে সুশৃঙ্খলভাবে এগিয়ে দিচ্ছিল। রাস্তায় গাড়ির চাপ থাকলেও কারুর মুখে কোন বিরক্তি নেই। সবাই যেন এরকম একটা দিনেরই অপেক্ষা করছিল। এতো শক্তি কোথা থেকে পেল এই বাচ্চাগুলো! কে ওদের শেখালো এতো মধুর প্রতিবাদ! এগুলো কি শুধুই বন্ধু হত্যার প্রতিশোধ নাকি মায়ের মমতার ঋণশোধ? মমতাময়ী কোন মায়ের বুক থেকে যেন সন্তান হারিয়ে না যায়, তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব তাদের দিল কে? মায়ের মমতার এতো জোর!
একজন মা হিসেবে আমি সবসময়ই আমার সন্তানকে আগলে রাখতে চাই। আমার সন্তানের প্রতি ভালোবাসাই আমার কাছে সবচেয়ে বড়। কারও সন্তান মায়ের আদর পেল কিনা তা নিয়ে তো আমরা এতো ভাবি না। প্রতিদিন অহরহ কত মায়ের দুর্ঘটনায় মৃত্যুর খবর আমরা পাই। কই আমরা মায়েরা তো এর প্রতিবাদ জানাতে পারি না। সব মায়েরা তো রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করে বলতে পারি না আর কোনো সন্তান যেন মা হারা না হয়! কিন্তু এই বাচ্চাগুলো কেমন করে সন্তান হারা মায়ের আকুতিগুলোকে নিজের মধ্যে ধারণ করে রাস্তায় নেমে এসেছে।
কী অদ্ভুত শৃঙ্খলা বোধ! প্রশাসনের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে শৃঙ্খলা কাকে বলে!! মায়ের মমতার এত জোর! এই কোমল মতি বাচ্চাগুলো কে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের কি দারুন পথ বাতলে দিয়েছে । আর যে মা হয়ে আমরা অজানা আশঙ্কায় আমাদের বাচ্চাদের আঁচলের নিচে আগলে রাখতে চাই আমদের জন্য ও তারা কত বড় দৃষ্টান্ত স্থাপন করে দিল। সকল মায়েদের তারা দেখিয়ে দিল আমাদের মমতা তাদের কত বড় প্রেরনা! কত বড় উৎসাহ ! আমাদের মমতা পুরো দেশকে পালটে দেয়ার ক্ষমতা রাখে!
আমাদের দেশের প্রশাসনের যারা বড় বড় কর্তা ব্যক্তিরা আছেন, তারাও তো কোন না কোন মায়ের মমতায় লালিত। তাদের কি অন্য মায়েদের জন্য এরকম অনুভুতি হয় না? নাকি সময় আর ক্ষমতার সাথে সাথে তাদের সেই অনুভুতি গুলো ভোঁতা হয়ে গেছে? তাহলে আপনাদের জন্য আমদের এই বাচ্চারা আরেকবার আপনাদের ভিতরের ভোঁতা অনুভুতি গুলো শানিয়ে দিতে এসেছে। অন্য মায়ের বুকের সন্তান হারিয়ে গেলে কেমন লাগে তা বুঝতে এই ছোট ছোট বাচ্চা গুলোর অনুভুতির সাথে একাত্ম হয়ে যান। আপনার ভিতরে আপনার মায়ের জন্য জমে থাকা ভালবাসা আপনাকে একই রকম শৃঙ্খলা আর দায়িত্ব পালনে উতসাহিত করবে।
রাজীব আর মীম এর মৃত্যুতে কারো কারো হাসি পেয়েছিল। কেন পাবে না, তাদের কী দোষ? তাদের বাচ্চার মায়েদের তো আর উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করতে হয় না সন্তানদের স্কুল থেকে ফেরার জন্য! তাদের বাসায় জন প্রতি একটা করে গাড়ি রয়েছে। তাহলে রাস্তায় দাঁড়িয়ে বাসের জন্য অপেক্ষা করাটা তাদের জন্য হাস্যকর হবে না? তাদের সন্তানরা বাড়ি ফেরার সময় রাস্তার সাধারণ জনগণের পথ আটকে, রাস্তা ফাঁকা করে তাদের জন্য পথ করে দেয়া হয়। তাহলে অন্যের গায়ের উপর বাস উঠে যাওয়াটা তাদের কাছে হাস্যকর হবে না!
থাক তাদেরকে আর এই সাধারণ মানুষদের দলে না টানি। আমরা সাধারণ মায়েদের অসাধারণ সন্তানদের কথা বলি। যারা সকল মায়ের সন্তানের প্রতিনিধিত্ব করে। যারা নিজেদের অন্তর দিয়ে মায়ের মমতাকে ধারণ করে; সকল মায়ের জন্য যাদের সমান দরদ।
এই কোমল মতি বাচ্চাদের নিরব প্রতিবাদকে রাজনৈতিক রূপ দেয়ার চেষ্টায় কমতি ছিল না কোন দলেরই। কিন্তু না এদের মগজ ধোলাই ওরা করতে পারেনি। তাই এদের জন্য শুভকামনা রইলো সময় আর ক্ষমতার সাথে সাথে এদের এই নিষ্পাপ অনুভুতির যেন মৃত্যু না ঘটে।
আজকে যেমন দেশকে, দেশের মানুষকে সুশৃঙ্খল হওয়ার পথ তারা দেখাচ্ছে, ভবিষ্যতে নিজ নিজ অবস্থান থেকে যেন একই ভুমিকা পালন করতে পারে! স্নেহময়ি মায়ের মমতার প্রতি অটুট থাক তাদের শ্রদ্ধা; আর সেটাই হোক তাদের পথ চলার নিরন্তর ক্ষমতার উৎস।
গবেষণাকর্মী