সাজু বিশ্বাস:
কানাডার একটি স্কুল বাসের ভিডিও দেখাচ্ছিল একজন। গাড়িটির সামনে একটি অটো সিগন্যাল আছে। গাড়িটি থেমে যেতেই সামনে বা পাশ থেকে আসা গাড়িগুলোও যার যার জায়গায় দাঁড়িয়ে গেছে। বাচ্চারা নিরাপদে স্কুলবাস থেকে নেমে যাবার পর স্কুলবাসটি বেরিয়ে গেলে তারপর অন্য গাড়িগুলো স্টার্ট নিলো। এইরকম অতিভদ্রতা আমাদের দেশে আশা করা একরকম আকাশকুসুম কল্পনাই। কিন্তু তাই বলে ড্রাইভারের পেশাগত প্রয়োজনীয় শিক্ষাটুকু অন্ততঃ থাকবে—- এমন একটা আশা করা কি সত্যিই বড় অন্যায় আব্দার! এই কিছুক্ষণ আগেও একটি স্টাফ বাসের ড্রাইভার রাস্তার চওড়া জয়গা ফেলে গাড়ি নিয়ে সিনেমাহলের দিকে ধাওয়া করেছিলো!
গাড়ি কার, কে মালিক…… সেসব প্রশ্নের উত্তর পরে পাওয়া যাবে। ড্রাইভারদের লাইসেন্স কে দেয়? কে তাদের ওয়ার্ক পারমিট দেয় জনাব??
একটি ছোট্ট মেয়ে রাস্তা দিয়ে স্কুলের পথে যাচ্ছিলো। চারজন ট্রাক ড্রাইভার তাকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করে নারকীয় অত্যাচার করে মেরে ফেলে। আজব মানুষও আমাদের! একটি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ছোট্ট এট্টুখানি নাবালিকা মেয়েকে চারজন ড্রাইভার তাদের ব্যক্তিগত শত্রুতার মতো আক্রোশের পর্যায়ে নিয়ে গেছে। মেয়েটির হাতগুলো কেটে ফেলা হয়েছে। পায়ুপথে কাঠের গুড়ি ঢুকিয়ে মেয়েটিকে হত্যা করা হয়েছে। চলতি পথে হঠাৎ মেয়েটি কতকগুলো ড্রাইভার হায়েনার সামনে পড়ে গিয়েছিল মাত্র! এই-ই তার বড় দোষ ছিল। জনাব, ড্রাইভিং লাইসেন্স দেবার সময় এরপরে সংযম রক্ষার একটি পার্ট রাখিয়েন।
একজন টগবগে তরুণ ছেলে বাড়ি থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরছিলো। হয়তো সে বাবার কাছে ওয়াদা করে এসেছিলো, এবার ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে দেখাবে। পরের বার মায়ের জন্য ঢাকা থেকে হয়তো সে একটা নীল জামদানি নিয়ে যেতে চেয়েছে! প্রেমিকাকে হয়তো শেষমূহুর্তে আরেকবার হ্যালো বলার ইচ্ছে ছিল তার! জ্যাম কতদূর ছাড়ালো তাই দেখতে গিয়ে বাসের দরজায় ধাক্কা লেগে রাস্তায় পড়ে যায় ছেলেটি। বাসের কন্ডাকটর আর ড্রাইভার ঠিকই ঠাহর করেছিল, রাত বলে অন্য যাত্রীরা এই ঘটনা একদম নজর করেনি! তারা এই সুযোগে আহত ছেলেটিকে ব্রিজ থেকে পানিতে ফেলে দেয়! কতটা পরিস্কার ঠাণ্ডা মাথার কিলার! এদেরকে কী কী ট্রেনিং দিয়ে তৈরি করা হয়েছে জনাব! এরপরে কি বাসের সামনে লেখা থাকবে, —- ” আসো তোমাদের জাহান্নামের পথে পৌঁছে দিই”!
যে দৃশ্যের বর্ণনা করা সবচেয়ে কঠিন কাজ, তা হলো দুটি কলেজ পড়ুয়া ছেলেমেয়ের করুণ মৃত্যু। দলবেঁধে রাস্তার পাশে বাসের অপেক্ষায় ছিল তারা। ড্রাইভার নামক একটি জান্তব দানব একটি গাড়ি তুলে দিয়েছে তাদের গায়ের উপর। অনেকদিন ধরে ড্রাইভারদের শিক্ষা, ড্রাইভারদের শাস্তি…… কথাগুলো শুনে আসছি। মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েছে, কিন্তু সবকিছু যেন মোলায়েম হাসির পিঠে অদৃশ্য হয়ে গেছে!
হাসি ভাল। হাসি মানুষকে আত্মবিশ্বাসী করে তোলে। হাসি ক্রমশ ঘোলাটে হয়ে ফেনিয়ে ওঠা ক্ষোভ অনেকখানি হালকা করে দেয় হয়তো! কিন্তু হাসি যা করতে পারেনা, তা হল কারো শুন্যস্থান পূরণ। পৃথিবীতে এমন কোনও মধুরতম হাসি নেই যা দেখে মানুষেরা তাদের সদ্য খুন হয়ে যাওয়া সন্তানদের মুখ বিস্মৃত হয়! এমন কোনও কারিশমা নেই, —- এমন কোনও আশার কথা নেই যা শুনে এই সব ঘটনা দুই হাতে পাশে ঠেলে সামনে এগিয়ে চলা যায়!
হঠাৎ করেই বড় অসহিষ্ণু ভূমিকায় চলে এসেছে সময়। এমনকি ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের সঙ্গী হারানোর বিক্ষোভকে প্রতিপক্ষের হুংকার বলে ঠাহর হচ্ছে! মাথায় লাঠি মেরে বাচ্চাদের রক্তাক্ত করা, —- জোরে শার্টের আস্তিন ধরে তাদেরকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়ার মত কাজগুলো যেন বড় বেশি অপরিচিত করে তুলছে আমাদের জীবনবোধের জায়গাটা।
আমরা যে যেখানেই থাকি, সেই বৃত্তের বাইরে আমিও যে একজন সাধারণ মানুষ, — আমার প্রিয়জনের জন্যও এই নিয়তি কাম্য নয়,—- এই মর্মাঘাত আমাদের পীড়িত করেনা আর! আমরা তাই, আরো বেশি মৃত্যুর খবর সামনে খুঁজে পাবার চেষ্টা করি।
আমরা আমাদের আত্মবিশ্বাসী হাসি সামনে ধরে রেখে প্রাণপণে হাতড়াতে থাকি, একদা কোনও একদেশে এক অর্বাচীন ড্রাইভার যাত্রীভর্তি গাড়ি খাদে ফেলে দিয়েছিলো সেই মোক্ষম উদাহরণটি।