আপনি কি নিশ্চিত, আপনার কন্যা পরবর্তি ‘টার্গেট’ নয়?

মলি জেনান:

আতঙ্ক, গ্লানি আর লজ্জায় নুয়ে পড়ি যখন দেখি সেই মানুষখেকো দানবদের পরিচয় আমার নিজের পরিচয়ের সাথে মিলে যায়!!

বেশ কিছুদিন আগে লোগাং হত্যাকাণ্ড নিয়ে লিখেছিলাম। লিখেছিলাম-
এটাও শিহরণ জাগানিয়া গল্প। যা শুনে মানুষ হিসেবে আপনি শিহরিত হবেন, আপনার লোমকূপ দাঁড়িয়ে যাবে, মানুষ হিসেবে আপিনি লজ্জিত- অপমানিত বোধ করবেন, আপনার পরিচয় আপনার গ্লানির কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
আমি জানি না আমার সেই ‘সত্যি হলেও’ গল্পটি কজন পড়েছিলেন, কজন মানুষ হিসেবে আয়নার মুখোমুখি হয়েছিলেন। বাঙ্গালী হিসেবে কতটা আত্মগ্লানি আপনাকে গ্রাস করেছিল জানি না। তবে আমার পরিচয় আমার গ্লানির কারণ হয়ে উঠে আমি প্রতিনিয়ত লজ্জিত অপমানিত বোধ করি এই সব সেটেলার বীর-বাঙ্গালীদের জন্য।

পাহাড় আমার খুব প্রিয়, কিন্তু রাঙ্গামাটি, বান্দরবান খাগড়াছড়ির কথা মনে হলেই আমার মনে পড়ে যায় লোগাং এবং লোগাং এর মতো আরো অসংখ্য হত্যাকাণ্ড ও ধর্ষণের কথা, চোখের সামনে ভাসতে থাকে পুড়ে যাওয়া মানুষ ও শিশুদের কঙ্কাল! কারণে-অকারণে চোখের সামনে ভেসে উঠে জ্বলতে থাকা ঘর-বাড়ি, ধর্ষিত নারী-শিশুর সংখ্যা, হ্যাঁ সংখ্যা(!) ওরা তো শুধু সংখ্যাই, মানুষ নয়। অসহায় হয়ে পড়ি, গ্লানি আর লজ্জায় নুয়ে পড়ি যখন দেখি সেই মানুষখেকো দানবদের পরিচয় আমার নিজের পরিচয়ের সাথে মিলে যায়!!

মনের ভেতর প্রবল জাতিগত ঘৃণা না পুষলে, ভয়ঙ্কর লোভ-লালসা না থাকলে, ভয়ানক হায়েনা না হলে, কোন গোষ্ঠীকে নির্মূল করার চিন্তাভাবনা না থাকলে এইরকম নৃশংসতা করা যায় না।

আর এটাতো যুগ যুগ ধরে চলে আসছে কোন জাতি বা গোষ্ঠীকে উচ্ছেদ করতে হলে সবার আগে তাদের স্ত্রী-কন্যাকে ধর্ষণ করতে হবে। কারণ এ সমাজ সংসারের সম্মান নামক বায়বীয় বস্তুটির দায়ভার কাঁধে নিয়েই জন্মগ্রহণ করে প্রতিটি নারী সে যে গোত্রেরই হোক না কেন, আর তার সম্মান লেপ্টে থাকে তার শরীরে। আরও নির্দিষ্ট করে বললে যোনিতে! তাই কোন জাতি/গোত্রকে আতঙ্কিত, অসম্মানিত ও উচ্ছেদ করতে চাইলে প্রথমেই তাদের স্ত্রী-কন্যাদের ধর্ষণ ও তারপর ভয়ানক নারকীয়ভাবে খুন করতে হবে তাদের, তবেই না তারা ভীত-সন্ত্রস্ত হবে এবং নিজেদের ভিটে-মাটি ছেড়ে উদ্বাস্তু হতে বাধ্য হবে। এ ক্ষেত্রে বাঙ্গালী-পাকিস্তানি কোন তফাৎ নেই। বাঙালি পাকিস্তানিদের ঘৃণা করে, কিন্তু পাহাড়ে সে হয়ে উঠে পাকিস্তানি হায়েনাদের চাইতেও বর্বর। এক্ষেত্রে পাহাড়ে আদিবাসিদের উপর ধর্ষণ-হত্যা-নির্যাতন আর সমতলে সংখ্যালঘু হিন্দু ধর্ষণ-হত্যা-নির্যাতন একই সূত্রে গাথা।

মলি জেনান

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নামক যে বায়বীয়(!) বস্তুটির বাস্তবায়নের কথা আমরা হরহামেশাই ব্যবহার করি, প্রতিনিয়ত আমরাই তাকে একটু একটু গলাটিপে হত্যা করেছি সংখ্যলঘু নির্যাতন, নিপীড়ন আর জাতিগত নিধনের মাধ্যমে বাকি যেটুকু আছে, তা ফসিল মাত্র। তাকেও আমরা ব্যবসার পণ্য আর মসনদে টিকে থাকার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছি।

চলতি কোটা সংস্কার আন্দোলনে অনেক জ্ঞানী-গুনী-মহারথীকে দেখেছি মুক্তিযোদ্ধা/মুক্তিযুদ্ধকে অসম্মান করা হচ্ছে বলে প্রতিবাদে কান্নার ঝড় তুলেছিলেন, তাদেরকে বলছি, সংবিধানে যখন রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম করে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার পথ বন্ধ করে দেয়া হয়, যখন অন্য ধর্মাবলম্বীদের দ্বিতীয়/তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিক করে দেয়া হয়, তখন মুক্তিযুদ্ধ/মুক্তিযোদ্ধারা কতটা সম্মানিত হোন্?

যখন সকল জাতি-ধর্মের বাংলাদেশে একটা জাতিগত নিধনেরও বিচার হয় না বরং রাষ্ট্রিয় বাহিনীর যোগসাজশে জাতিগত নিপীড়ন চলে, তখন মুক্তিযুদ্ধ/মুক্তিযোদ্ধারা কতটা সম্মানিত হোন? চোখ কান খোলা রাখুন, মুক্তিযুদ্ধ/মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান ‘বেলুনের’ মতো কোটা সংস্কার আন্দোলনের ‘সুঁই’এর আগায় ঝুলছে না, এটা আরো অনেক দিকে অনেক ভাবেই ভূলুন্ঠিত হচ্ছে।

সংখ্যালঘু বা ‘নাক বোঁচা’, ‘চ্যাপ্টা চেহারার’ আদিবাসী বাদ দেন, একটা সংখ্যা গুরু নারী/শিশু ধর্ষণেরও কি বিচার হয়েছে আজ পর্যন্ত? হয়নি। কারণ আমরা বাঙ্গালী মুসলমান(!)। (যদিও আগে বাঙ্গালী, না আগে মুসলমান এসব নিয়েও যথেষ্ট তর্ক হয় আজকাল) এমনিতেই তো নারীরা ঊনমানুষ, আর অন্য ধর্মের হলে তো কথাই নেই, সেতো মানুষই নয়, ভোগ্য পণ্য।

তবে আমার বা সংখ্যালঘু বা পাহাড়ি শিশু কন্যা ধর্ষিত হয়ে বেঘোরে খুন হচ্ছে দেখে আপনি যখন ‘আহ্ এটা ঠিক না’ বলে পাশ ফিরে ঘুমাচ্ছেন, তখন জানবেন দানবের কোন জাত/ধর্ম হয় না। তার পরবর্তী লক্ষ্য আপনার কন্যা।

জয়তু বাংলাদেশ। জয়তু সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.