ছেঁড়াদ্বীপের ধূমকেতু ‘কমরেড’ মনীষা

সৈকত আমীন:

রুপম ইসলামের গানের একটা লাইন আছে – “ভাষণ মানেই শাসন নয়”।
বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের নানান সংকট নিয়ে আলোচনা করার সময় একবার ডা. মনীষা চক্রবর্ত্তী’কে বলতে শুনেছি “আমি যদি মেয়র নির্বাচিত হই, মেথর’রা বেতন না পাওয়া পর্যন্ত আমি বেতন গ্রহণ করবো না। সবচেয়ে কষ্টের কাজ যারা করে তারাই যদি পারিশ্রমিক না পায় তবে অথর্ব ভাবে মেয়রের পদে বসে থাকার কোনো মানে থাকে না”।

মজার বিষয়টা কি জানেন? ধরা যাক এমন কথা ডা. মনীষা চক্রবর্ত্তী বলেন’ই নাই,অথবা তিনি বোবা কিংবা ধরা যেতে পারে বরিশাল সিটি কর্পোরেশনে মেথরদের বেতন ভাতা নিয়ে কোনো সমস্যা নাই,তবু আস্থা রাখা যায়, যে মানুষ’টা পুলিশের এলোপাতারি লাঠিচার্জের মুখেও নিজের রিক্সা শ্রমিক সহযোদ্ধাদের ছেড়ে যাননি অথবা দিনের পর দিন বিনে পয়সায় চিকিৎসা দিয়ে গেছেন বস্তির পর বস্তি ভর্তি দরিদ্রতম মানুষদের মাঝে তিনি মেয়র হলে অন্তত মেথরদের পাওনা পরিশোধ না করে নিজের পারিশ্রমিক ভোগ করবেন না।

ডা. মনীষা চক্রবর্ত্তী

ডা. মনীষা চক্রবর্ত্তী, বরিশালের প্রখ্যাত আইনজীবী বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট তপন কুমার চক্রবর্তীর মেয়ে আর মনীষার দাদা মহান মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি রণাঙ্গনে শহীদ,আমাদের সকলের প্রিয় নিসর্গবিদ প্রয়াত দ্বিজেন শর্মা তার ফুপা। কিন্তু এগুলো আসলে মুখ্য নয় ,
জীবনানন্দ দাশ গল্প লিখেছেন,উপন্যাস লিখেছেন তবু তার নাম শুনলে সবার আগে আমাদের মগজে ভেসে ওঠেন একজন কবি,শরৎ বাবুর বেলায় একজন উপন্যাসিক অথবা কথা যদি হয় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় কে নিয়ে – আমাদের মনে ভেসে ওঠেন একজন সাহিত্যিক।

মনীষা কবি উপন্যাসিক সাহিত্যিক কোনটাই নন, মনীষার নাম শুনলে সবার আগে মাথায় আসে দুটো ছবি ,১) তাকে ঘিরে ভুখা মানুষের স্রোত আর ২) পুলিশের বেপর‍রোয়া মার থেকে তাকে বাঁচাতে নিম্নবিত্ত মানুষের হাড্ডিসার দেহের ব্যারিকেড।আমার কাছে এই হচ্ছেন ডা. মনীষা চক্রবর্ত্তী।

ডা. মনীষা চক্রবর্ত্তী ৩৪তম বিসিএস এ উত্তীর্ণ হয়ে স্বাস্থ্য ক্যাডারে সহকারী সার্জন হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন সরকারি হাসপাতালে,কিন্তু সরকারি কাজ করলে গরীব মেহনতি মানুষের জন্য আর রাজনীতি করা যায় না তাই আর যোগদান করেননি,মধ্যবিত্ত জীবনের সকল শিকল ভেঙে নেমে পড়েছেন মেহনতি মানুষের হয়ে লড়াই করতে রাজপথে,আর শুধু এই অপরাধেই তাকে যেতে হয়েছে জেলখানায়।

আর যতক্ষণে তিনি জেল থেকে বের হলেন তখন আর শুধুমাত্র সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক সম্পাদক কিংবা বাসদের বরিশাল জেলার সদস্য সচিব’ই তিনি নন,তিনি হয়ে গেছেন খেটে খাওয়া মানুষের চোখের আলো,বরিশালের মনীষা’দি।

স্থানীয় সরকার নির্বাচন আমার কোনো আগ্রহের বিষয় নয়,কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে স্থানীয় সরকার নির্বাচন একটা প্রেডিক্টেবল বিষয় মাত্র,কিন্তু নিজে সরজমিনে ছিলাম নির্বাচনি আমেজের মাঝে আর যার ফলে দিনকেদিন বরিশাল সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন আমার কাছে আর প্রেডিক্টেবল তো নয়’ই, বরং যতটা লিখে বোঝানো সম্ভব তার চেয়ে অধীক আনপ্রেডিক্টেবল লেগেছে শুধুমাত্র এই এক মনীষা চক্রবর্তী নামক রাজনীতির ধূমকেতুর জন্য।

সৈকত আমীন

বরিশাল থেকে ফেরার দিন রিক্সায় করে লঞ্চঘাটে আসছিলাম,রিক্সা থেকে নামার পর রিক্সাওয়ালা লোকটা কিছুতেই যেন ভাড়া নেবে না,কারণ হিসেবে জানালো মনীষা’দির সাথে আমাকে দেখেছে সুতরাং যেই লোক দূর থেকে শুধুমাত্র তাদের মতো দরিদ্র লোকের প্রার্থীর নির্বাচনে সাহাস্য করতে এসেছে তাকে তো বিশ টাকার পথ এমনিতেই পার করে দেওয়াই যায়।
আমার পরিচিত সকলেই জেনে থাকবেন আমি চা পান করি না, শুধুমাত্র ভাড়া দিতে না পারার দুঃখে তাকে একসাথে চা পান করার আর্জি করলাম, সেখানো মুখোমুখি হলাম আরেক পরিস্থিতির, চাওয়ালা এই রিক্সাওয়ালাকে দেখেছে মনীষা’দির হয়ে ক্যাম্পেইন করতে,সেই চাওয়ালা একজন বস্তিবাসী,তাদের যখন উচ্ছেদ আরম্ভ করা হয় মনীষা’দি নিজের দলের সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করেছেন তাদের পাশে দাঁড়ানোর,আর ফলশ্রুতিতে মনীষার পক্ষে যে রিক্সাওয়ালা ক্যম্পেইন করছে তার থেকে টাকা নেওয়া সে এক প্রকার পাপই মনে করে।

মনীষা’দি কিভাবে নির্বাচন করছেন,কেন করছেন আর কাদের টাকায় করছেন আর কি তার প্রতিশ্রুতি সে সকল তথ্য আপনারা ইতিমধ্যেই জানেন,নতুন করে সেগুলো বলা আমার উদ্দেশ্য নয়,শেষ দুটো কথা বলে চলে যাই,

মুক্তিযুদ্ধ গবেষক আরিফ রহমান ভাই লিখেছিলেন- “একটা মাত্র ভোট দিয়ে ইতিহাস গড়ার সুযোগ বারবার আসে না” মনীষা’দি বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের ইতিহাসে প্রথম নারী মেয়র প্রার্থী, আপনার একটা ভোটে বরিশালের ভবিষ্যৎ ইতিহাস হতে পারে অনেক বেশি নান্দনিক, অনেক বেশি নিষ্ঠা আর দরিদ্রবান্ধব।

ঐ যে রিক্সাওয়ালার কথা বলছিলাম! মনে আছে? আমি জানি আপনাদের স্মৃতিশক্তি গোল্ডফিশের মতো নয় –
ফেরার সময় পেছন থেকে সে আমাকে বলেছিল, “কমরেড, আবার আইবেন”-
বিশ্বাস করুন, চিতা থেকে ফিরে স্বয়ং নবারুণ যদি আমায় ‘কবি’ বলে সম্বোধন করে তার চেয়েও অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে একজন সর্বহারা মানুষের মুখে ‘সহযোদ্ধা’ ডাক। শুধুমাত্র ভোট দিয়ে শ্রমজীবী মানুষের সহযোদ্ধা হবার সুযোগও রোজ রোজ আসে না, আপনি কাকে ভোট দেবেন বা দিয়েছেন সেটা আপনার ব্যাপার, শুধু বলতে চাই শ্রমজীবী মানুষের মার্কা মই, হাতে হাত রেখে সাথী হোন তাদের লড়াইয়ের।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.