মানুষের ‘ঈশ্বর’ কেন এতোটাই অবিবেচক!

তানবীরা তালুকদার:

কিছুদিন আগে ফেসবুক জুড়ে একটি আহত শিশুর মুখ ঘুরে বেড়িয়েছে। আট বছরের নিতান্ত অবোধ যাকে বেঁচে থাকার জন্যে পরের বাড়িতে কাজ করতে হয়। আর সেই কাজ উপভোগ করা মানুষেরা তাকে কর্মে অপটুতার অভিযোগে নানা জায়গায় খুন্তি পুড়িয়ে ছ্যাঁকা দিয়েছে। নিজে মা হয়েছি পর থেকে শিশুদের কষ্ট বড্ড বুকে বাজে। প্রতিটি শিশুর মুখে নিজের সন্তানের প্রতিচ্ছবি দেখি। বাচ্চাটির আহত মুখ দেখে মন কিছু লিখতে চাইলেও হাত সরছিলো না। আজ সারা ফেসবুক জুড়ে ভাসছে কীর্তিকা পূর্ণা ত্রিপুরা’র মৃত মুখ। অবধারিতভাবে একদল যুদ্ধ করছে পাহাড় আর সমতলের সাদৃশ্য ও পার্থক্য নিয়ে। আর নিরালায় বসে আমি ভাবছি, মানুষ যে “ঈশ্বর” এর কল্পনা করে, তিনি কত পার্সেয়ালটি করতে পারে! তার অবিবেচনার কোন সীমা নেই।

আচ্ছা এই বাচ্চাগুলো যদি বাংলাদেশে না জন্মে নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, জার্মান, সুইডেন বা কানাডায় জন্মাতো, তাহলে তাদের জীবনটা কেমন হতো? এভাবেই কি মৃত্যু হতো তাদের? বাবা-মা না থাকলে কি এই বয়সে গৃহভৃত্য হতে হতো? না, হতো না, এমনকি সে দেশের নাগরিক না হলেও শরণার্থী শিশুদের সাথেও তারা এতো অমানবিক আচরণ করে না। শরণার্থী শিবিরেও শিশুদের জন্যে আলাদা ব্যবস্থা রাখা হয়।

যিনি “ঈশ্বর” হবেন তিনি কেন এতোটাই একচোখা হবেন! জন্মের ওপর তো মানুষের হাত নেই, যার জন্যে সে নিজে দায়ী নয় তার মূল্য কেন সে নিজের জীবন দিয়ে পরিশোধ করবে? বাংলাদেশেই যদি ওরা সাধারণ কলিম, ছলিম, মাংলু, প্রিয়াংশু’র ঘরে না জন্মে কোন আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের ঘরে জন্মাতো, তবে তো তাদের জীবন অন্য ধারায় বইতো। নিজের অজান্তে মানুষ জন্মায়, কিন্তু সেই অজানা জন্মই তার গোটা জীবন নিয়ন্ত্রণ করে ফেলে।

নেই নেই করেও পৃথিবীর বহু প্রান্তর ঘোরা হয়েছে। প্রায় প্রতিটি দেশেই দেখেছি মসজিদ, মন্দির, গীর্জা, প্যাগোডা নানাভাবে সুসজ্জিত, সুরক্ষিত এবং প্রতিদিন নানাভাবে তাদের যত্ন নেয়া হচ্ছে। আস্তিক বা নাস্তিক যে কোন দেশেই হোক না কেন এই ব্যাপারটিতে কেউই পিছিয়ে নেই। সেখানে দশর্নাথী ছাড়াও আছে স্থানীয় মানুষ, সংখ্যায় খুব অল্প হলেও আছে, প্রায় প্রতিটি স্থানেই মোম জ্বলছে কিংবা পুড়ছে আগরবাতি বা ধূপকাঠি। অথচ দেখা যাবে ঠিক বাইরেই নানা কায়দায় ভিক্ষে করছে কিছু লোক। বিরাট জায়গা নিয়ে উপাসনালয় বা কল্পিত ঈশ্বরের স্থান আর ঠিক তার পাশেই খুব ছোট ছোট ফ্ল্যাটে বসবাস করছে অসংখ্য জীবন্ত মানুষ তাদের বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে। কল্পনার ঈশ্বরের অস্তিত্ব মানুষের মন থেকে যে মায়া আদায় করতে পারে, বেঁচে থাকা জীবন্ত মানুষ তা টানতে ব্যর্থ হয়। জলজ্যান্ত মানুষের বেদনা ততটা অন্যকে স্পর্শ করে না যতটা অদেখা ঈশ্বরের প্রেম করে।

মানুষ ধর মানুষ ভজ শোন বলি রে পাগল মন
মানুষের ভিতরে মানুষ করিতেছে বিরাজন।

বাংলাদেশ থেকে ফেরার পথে প্লেনে আমার মেয়ে প্রায়ই জিজ্ঞেস করতো, অবাক হতো, বাংলাদেশ আর নেদারল্যান্ডস কি একই গ্রহে? ওর ধারণা এক গ্রহে দুটো দেশের মধ্যে এতো পার্থক্য কী করে হয় বা হবে! রানা প্লাজার দুর্ঘটনার পর অফিসের কলিগরা খুব কশাস গলায় জানতে চাইতো, আমার পরিবারের কেউ সেই দুর্ঘটনায় আহত বা নিহত হয়েছে কি না! আমার বাসা থেকে দুর্ঘটনাস্থল কত দূরে! তারপর আর থাকতে পারতো না, জিজ্ঞেস করেই ফেলতো, এসব দেখার পর আমরা এতো স্বাভাবিক কী করে থাকি? ওরাও তো মানুষ, আমরা কী করে আমাদের নিজের মানুষদের প্রতি এতো নির্দয় আচরণ করতে পারি? তারা কী করে জানবে এসব নৃংশসতা আমাদের কতটা প্রাত্যহিক ব্যাপার। আমরা কতো সাধারণভাবে এগুলোকে রোজকার জীবনের অংশ হিসেবে ধরি, তারপর নিজ নিজ জীবনে মনোনিবেশ করি। যার গেছে সে বুঝবে আমার/আমাদের কী? আমরা তো ভাল আছি, বৃষ্টি হচ্ছে তাই আজ একটু খিচুড়ির সাথে গরু ভুনা, ইলিশ ভাজা আর আচার। এরপর টিভিতে সিরিয়াল আর এসি চালিয়ে সুখের নিদ্রা। কোথায় কে খুন হচ্ছে, পাহাড়ে না সমতলে, সেই নিয়ে দুঃখ করার অবসর কোথা!

ধার্মিক মানুষেরা খুব সহজেই অন্য মানুষের প্রতি কঠোর ও নির্দয় আচরণ করতে পারে। তারা নির্দ্বিধায় তাদের কল্পনার
ঈশ্বরকে সন্তুষ্ট রাখতে জলজ্যান্ত মানুষের হৃদয় ভেঙে দিতে পারে, প্রাণ নিতে পারে। ধর্ম আনে বিরোধ, প্রেম ভেঙে যায়, ঘর পুড়ে যায়, দেশ ছাড়া হয় মানুষ আর কেউ কেউ হয় পৃথিবী ছাড়া। কী করা যাবে, কর্কশ বাস্তবতার থেকে কল্পনা সব সময়ই সুন্দর, মধুর।

কতটা পথ পেরোলে তবে পথিক বলা যায়
কতটা পথ পেরোলে পাখি জিরোবে তার দায়
কতটা অপচয়ের পর মানুষ চেনা যায়।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.