আমেনা বেগম ছোটন:
আজ ইভিনিং শিফট এস আই তৌহিদের। ৬ মাস হলো এই মফস্বলে পোস্টিং। এক কাপ রঙ চা খেতে খেতে ফাইলগুলি দেখছিল সে।
এমন সময় কন্সটেবল দুলাল এক যুবককে নিয়ে প্রবেশ করলো, স্যালুট দিয়ে বললো, স্যার, এ সারেন্ডার করতে চায়, ডিগ্রী কলেজের রুপার হাজবেন্ড।
তৌহিদ আগ্রহ নিয়ে তাকালো। দুদিন আগে এখানে একটি আত্নহত্যার ঘটনা ঘটে। শ্বশুরবাড়িতে গৃহবধুর আত্মহত্যা। প্রাথমিক তদন্তে সুইসাইডের সত্যতা নিশ্চিত হয়েছে। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল। পাড়াপ্রতিবেশিরা মিলেই দরজা ভেংগে লাশ সিলিং এ ঝুলন্ত পায়। কোনো সাইন অফ স্ট্রাগল নেই। ক্লিয়ারকাট সুইসাইড, পোস্টমর্টেমেও ডেথ বাই হ্যাংগিং পাওয়া গেছে।
ঝামেলা শুরু হয়েছে মেয়েটির কলেজ থেকে। সোশ্যাল মিডিয়াতেও হৈ চৈ পড়ে গেছে। সবার ধারণা, শ্বশুরবাড়ির অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছে। প্রভোকড সুইসাইডের বিচার চায়। কলেজের ছেলেপুলে গিয়ে দুটো বাস ভেংগেছে আর একটা সিএনজি জ্বালিয়ে দিয়েছে। এমপির কল পেয়ে মেয়েটির শ্বশুর-শাশুড়ি আর ননদকেকে গ্রেপ্তার করে থানা হেফাজতে আনার পর পরিস্থিতি শান্ত হয়েছে। যদিও জিজ্ঞাসাবাদের পর তেমন কিছু পাওয়া যায়নি। রুপা একটু রাগী আর অভিমানী ধরনের মেয়ে ছিল, সংসারের খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে শাশুড়ি ননদের সাথে লাগালাগি হতো, বড় কোনো ব্যাপার না। সব সংসারের নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা।
— আপনার নাম কী? বয়স? স্থায়ী ঠিকানা? দুলাল, এগুলি ফাইলে লিখে রুপার ফাইলে রেখে দাও। তৌহিদ বলে।
— স্যার, আমি রায়হান, রুপার স্বামী। আমার বাবা, মা আর বোনকে ছেড়ে দেন। তারা নির্দোষ। আমি আত্মসমর্পণ করছি, শাস্তি যা হবার আমাকেই দিন।
তৌহিদ ভ্রু কুচকে রায়হানের দিকে তাকিয়ে রইলো। প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে সে ঘটনার দিন বাড়ি ছিল না, সকালেই বের হয়ে গেছিল। তাহলে দোষ স্বীকার করছে কেন? কথা বের করতে হবে। নারী নির্যাতনকারী লোকগুলিকে একেবারে সহ্য হয় না তার। চুরি, ডাকাতি না হয় মানুষ পেটের দায়ে করে। বউ পেটানোর মানে কী?
— আপনার কথায় তো আসামি ছাড়া যাবে না। তাছাড়া আপনার আচরণ সন্দেহজনক। এ দুইদিন পালিয়ে রইলেন কেন? আর ঠিক কী কারণে রুপা সুইসাইড করলো তার বিশদ ব্যাখ্যা দিন। সন্তোষজনক হলে আপনাদের উকিল জামিনের আবেদন করতে পারবে।
রায়হান ম্লান হাসে। উকিল কই পাবো স্যার? সত্যি বলতে কী, রুপা অভাব সহ্য না করতে পেরেই গলায় দড়ি দিয়েছে। আমার বাবা প্রেসারের রোগী, মাও দুর্বল মানুষ, বোনটার বিয়ে দিতে পারিনি এখনো – আমাদের পরিবারটা ধবংস হয়ে যাবে। একটু দয়া করুন স্যার।
— সিনেমার ডায়লগ দেয়া বন্ধ করুন। থানা দয়া-দাক্ষিণ্যের জায়গা না। বাড়ির বউয়ের উপর অত্যাচার করার আগে মনে ছিল না এসব? মেয়েটাকে মেরে তারপর সবাই মিলে ভালমানুষ সাজা হচ্ছে? কী করেছিলেন ঠিকঠাক বলুন আগে।
— আমি তো সারেন্ডার করলামই, তারপরও কেন আমার পরিবারকে আটকে রাখবেন? যদি টাকার আশায় এগুলো করেন, তাহলে আগেই বলে রাখি, টাকা দেবার মতো সামর্থ্য আমাদের নেই, মিছিমিছি সময় নষ্ট করবেন না। পরে আফসোস–
ঠাস করে এক থাপ্পড় পড়লো রায়হানের বাম গালে। ঘুষের কথায় মাথায় রক্ত চড়ে গেছে তৌহিদের। আরেক চড়ে চেয়ার থেকে পড়ে গেল রায়হান।
— আরেকবার বড় বড় কথা বললে জুতিয়ে চাপা ভাংবো তোর। মিনকা বদমাশ কোথাকার! কী ঘটনা ঠিকঠাক না বললে মাইর কাকে বলে সেটা আরো ভালো করে বুঝিয়ে দেব, রাগে ফুসতে থাকে তৌহিদ। কনস্টেবল দুলাল দৌড়ে আসে৷ এই নতুন অফিসারগুলির যে মাথা গরম, যাকে তাকে না বুঝে মেরে বসে, পরে দেখা যায় এরা লতায়-পাতায় এমপির আত্মীয়, থানাশুদ্ধ পুলিশ এর ফল ভোগ করে। ট্রান্সফার হম্বিতম্বি, পরের জেনুইন কেসে এর এডভান্টেজ নেয়া।
— স্যার, স্যার আপনি বসেন, আমি দেখছি। ওই মিয়া, মিছামিছি ঘাউরামি করেন কেন? যা জিজ্ঞেস করে সোজা উত্তর দিলেই তো হয়। রায়হানকে ফ্লোর থেকে উঠায় সে। তবে চেয়ারে বসায় না, মাটিতেই বসিয়ে রাখে। গোমড় না কমলে আরও ত্যাদরামি করে সময় নষ্ট করবে, এতে স্যারের রাগও কমে আসবে। ১৫ বছরের চাকরি, রুমের তিনজনের মধ্যে তার অভিজ্ঞতাই সবচেয়ে বেশি।
— এই, কথা বলস না কেন? আরো মাইর খাবার শখ আছে? স্টুপিড কোথাকার।
মুখের ভেতর নোনা সাধ টের পায় রায়হান, কেটে গেছে মনে হয়, রক্ত মাখা থুতু ঢোক গিলে সে। সে হতভম্ব হয়ে গেছে, রেগে যাবার মতো তো সে কিছু বলেনি। কী শুনতে চাইছে পুলিশ? তার আর রুপার সফল প্রেম আর ব্যর্থ দাম্পত্যর কাহিনী? বেশ তাই হোক।
আমার আর রুপার প্রেমের বিয়ে স্যার। এক বছর প্রেমের পর আমরা পালিয়ে বিয়ে করি।
বিরক্ত লাগছে তৌহিদের, শালা ফকিন্নির আবার প্রেমের বিয়া লাগাইছে, এহ। মুখে বলে, প্রেম হয়েছে কীভাবে?
— ফেসবুকে। আমি লিখালিখি করতাম, রুপা গল্প পড়তে ভালবাসতো। এভাবেই।
— তুই ফেসবুক সেলেব্রেটি? কী লেখস? ফলোয়ার কত?
— গালি দিচ্ছেন স্যার? আপনিও তো আমার ফ্রেন্ডলিস্টে আছেন, রুপাকে নিয়ে যে গল্পটা লিখেছিলাম তাতে কমেন্টে লিখেছিলেন, অসাধারণ লিখছেন বস।
— ফেসবুকে নাম কী?
— বাউন্ডুলে রায়হান।
থমকে যায় তৌহিদ, এ ছেলেটা বেশ সুন্দর সব গল্প লিখতো। সবার কমেন্টের সুন্দর সব উত্তর দিত। সেই লোক নারী নির্যাতনকারী, ভাবা যায়?
— পালিয়ে বিয়ে করতে হলো কেন?
— রুপার বাবার হঠাৎ খেয়াল চেপেছিল মেয়ে বিয়ে দিয়ে দেবে, পরের বছর হজ্বে যাবে তাই। অবস্থাপন্ন ঘরের সুন্দরী তরুণী, সম্বন্ধের লাইন লেগে গেল। প্রতি সপ্তাহে ওকে দেখতে আসতো। রুপা খুব নার্ভাস ধরনের মেয়ে ছিল, সে আমাকে বিয়ের জন্য চাপাচাপি করতে লাগলো। আমি বিয়ে করতে চাইনি, বুঝেছিলাম এর ফল ভালো হবে না। রুপা জেদ ধরলো, গাছতলায় থাকবে, একবেলা উপোস দিবে এরকম অদ্ভুত কথা বলতো।
— তাতেই রাজি হয়ে গেলেন?
— অত গাধা আমি না স্যার। ওকে বলেছিলাম কোর্ট ম্যারেজ করে যে যার মতো থাকি, চাকরি বাকরি হলে তখন সবাই কে জানাবো। ওর এক বান্ধবী ব্যাপারটা জানতো, সে রুপার মাকে বলে দিল, তারা ডিভোর্সের জন্য চাপাচাপি করতে লাগলো, ও সুযোগ বুঝে বাসা থেকে পালিয়ে আমাদের বাড়ি এসে উঠলো।
— তারপর?
— আমার মা, বাবা খুব রাগ করলেন। বাবা প্রাইমারি স্কুলের মাস্টার, এমনিতেই সংসার চলে না। এরপর আরেকজনের খোরাকি, খুব বেশি হয়ে যায়। উনারা রুপাকে ফিরে যেতে বললেন, আমাকেও বললেন ওকে ওর বাড়ি দিয়ে আসতে। রুপা রাজি হলো না।
কিন্তু, আমাদের বাড়ির অবস্থায় ও মানাতে পারছিল না। চেষ্টার ত্রুটি ছিল না, তবুও করবেটা কী? আমি থাকতাম বসার ঘরের চৌকিতে, সেটি সরিয়ে ফ্লোরে থাকতাম। মুরগী হতো মাসে একদিন, বাকি সময় মাছ, ডাল, ভর্তা কোনভাবে চালিয়ে নিত মা। দিনের পর দিন বেচারি কোন রকমে গিলতো।
এসব বড়লোকিপনা আমার মায়ের ভাল লাগতো না, প্রায়ই বকতেন আমাদের, বলতেন তুই তোর রাজরাণী নিয়ে ঘরজামাই হয়ে যা। আমাদের রেহাই দে।
— আপনার কোনো ইনকাম ছিল না?
— কী করে থাকবে? আমি স্থানীয় কলেজে কোন রকমে ফিলসফিতে অনার্স পড়েছি। চাকরি দূরে থাক, টিউশনি জোটাতে কষ্ট হতো। ছাত্রদের বাপ-মা বলতো আর্টসের ছাত্র কী পড়াবে আর? পরে দু’হাজার টাকার একটা টিউশনি পেলাম, ছাত্রী ক্লাস থ্রিতে পড়ে। যেতে আসতেই এক হাজার টাকা চলে যেত। উহ, কী দু:সহ জীবন!
— আর রুপা?
— ও কলেজে যাবার জন্য ছটফট করতো, পড়তে চাইতো। কিন্তু আমাদের কী সাধ্য তার পড়ার খরচ টানি। খিটখিটে হয়ে গেল খুব। সারাক্ষণ মুখভার করে বসে থাকতো। আমি বাড়ি ফিরতে চাইতাম না, ইচ্ছে হতো রিক্সা চালাই। কত ভাড়া বেড়েছে আজকাল। কিন্তু পরিচিত কেউ দেখলে কী বলবে সে ভয়ে চালাতে পারতাম না।
— চাকরির চেষ্টা করতেন না?
— সে করতেও টাকা লাগে। ছবি, বায়োডাটা প্রিন্ট কর, এদিক ওদিক যাও। তবু করতাম, কিন্তু একেকটা দিন আর পার হচ্ছিল না।
— ঘটনার দিন কী হয়েছিল?
— ৫ তারিখে? সেদিন কিছু হয়নি, আগের দিন কিছুটা ঝগড়া হয়েছিল।
— কী নিয়ে?
— দুপুরের রান্না নিয়ে। বাবা আধা কেজি শিং মাছ এনেছিল ৫০০ টাকা দিয়ে। মা সেগুলি চুলায় চড়িয়ে রুপাকে বলেছিল দেখতে, রুপা একবার দেখে ঘরে চলে এসেছিল, আমার সাথে গল্প করছিল। মা কতক্ষণ পর গিয়ে দেখে মাছ পুড়ে গেছে। তাড়াতাড়ি চুলা নিভিয়ে রুপাকে ডাকলো, রুপা কাছে যেতেই খুন্তি দিয়ে ওর হাতে এক বাড়ি দিয়ে দিয়েছে। রুপা খুবই রেগে গেছিল, মার হাত থেকে খুন্তি নিয়ে ছুঁড়ে ফেলেছিল, বললো এত্তোবড় সাহস আপনার, আপনি আমার গায়ে হাত তুলেন।
চেঁচামেচি শুনে আমি দৌড়ে আসি, মা আমাকে শাসাতে লাগলেন, এক্ষুণি এই বউ শাসন না করলে উনি আত্মঘাতি হবেন। আমার বোন এসে মায়ের পক্ষ নিল, বললো, হয় তোর বউ মার পায়ে ধরে ক্ষমা চাইবে, নয়তো তুই বউ নিয়ে বের হয়ে যাবি। আমি রুপাকে বললাম, মায়ের কাছে ক্ষমা চাও, দোষ তো তোমার। রুপা রাজি হলো না, আমার মা বিলাপ শুরু করলেন, আমার বোন সেই সাথে যোগ দিল – এরকম অবস্থায় আমি আর মাথা ঠিক রাখতে না পেরে রুপার গালে এক চড় বসিয়ে দিলাম। ম্লান হাসে রায়হান। এই আপনার চড়টা থেকেও আস্তে দিয়েছিলাম স্যার।
— তারপর?
— এরপর রুপা একদম চুপ হয়ে গেল। আমার মা তারপরও আশা করছিলেন চড় খেয়ে রুপা হয়তো ক্ষমা চাইবে, কিন্তু ও আর কিছুই বললো না। চুপ করে ঘরে গিয়ে বসে রইলো।
— আপনি আর কিছু বলেননি?
— বলেছিলাম, আমাদের একটু মানিয়ে চলতে হবে, কাজকর্ম জুটলে আমাদের অবস্থা এমন থাকবে না।
— ও কী বলেছিল?
— অন্যমনস্ক গলায় বলেছিল, তিনটা শিংমাছের মূল্যও তার জীবনের মুল্য থেকে বেশি। বিরক্ত লাগছিল আমার, বলেছিলাম, তোমাকে কাল তোমাদের বাড়ি রেখে আসবো। উনারা যা বলে তাই করো। প্রেম বিয়ে সবকিছুর শখ তো মিটেছে, এখন বাপের বাড়ি গিয়ে দুটো ভালমন্দ খেতে পেলেই তোমার চলবে। সংসারে মানিয়ে চলার মতো মানসিকতা তোমার নেই। আমি তোমাদের বউ শাশুড়ির মাঝখানের টানাটানিতে পড়তে চাই না।
— তারপর?
— সে রাতে আর কিছু খায়নি রুপা। আমি পরদিন সকালে বের হয়ে গেছিলাম, সাভারের একটা গার্মেন্টস এ ফ্লোর সুপার ভাইজারের ইন্টারভিউ ছিল, মা পাশের বাসায় গেছিলেন আমার বোনকে নিয়ে, বাবা স্কুলে। তখন রুপা গলায় ফাঁস নেয়। বাকিটা তো আপনারা জানেন।
— দুদিন পালিয়ে ছিলেন কেন?
— খবর শুনে নিজেকে আসামি মনে হয়েছিল তাই। আমিই তো দায়ী, তাই না, স্যার? মেয়েটা ভালবেসে আমার কাছে এলো, তাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারলাম না। রুপার মৃতদেহ দেখতে সাহসে দিচ্ছিল না। সহ্য হতো না।
আমার ফ্যামিলিকে ছেড়ে দিন, স্যার। আমি যা শাস্তি হয় মাথা পেতে নিব।
— আপনাকে হাজতে চালান করে দেব। কিছু ফাইল ওয়ার্ক আছে, সেগুলি করে আপনার ফ্যামিলিকেও ছেড়ে দিব। কিছু খাবেন? হাজতে অনেকদিন ভালো কিছু জুটবে না।
— একটু ভাত তরকারি হলেই হবে স্যার, দুদিন কিছু খাওয়া হয়নি।
দুলালকে খাবারের ব্যবস্থা করতে বলে রায়হানের বক্তব্য ফাইলে নোট করতে শুরু করে তৌহিদ, রুপার পরিবার, প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধব এদের স্টেটমেন্টও নিতে হবে।
ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তৌহিদ। বেকার অবস্থায় তৌহিদের গার্লফ্রেন্ড হঠাৎ এক ইতালি প্রবাসীকে বিয়ে করে ফেলেছিল। অনেক অভিমান হয়েছিল তৌহিদের, আজ হঠাৎ ওকে ক্ষমা করে দিল তৌহিদ। প্রেম আর সংসারে প্রায় ইহকাল পরকালের মতো পার্থক্য সেটা সে আজ বুঝতে পারলো।