আপনারা এখনও চুপ করেই থাকেন

সালমা লুনা:

জানুয়ারি ২০১৪ থেকে ডিসেম্বর ২০১৭ পর্যন্ত মোট ১৭ হাজার ২৮৯টি রেপ কেস রেকর্ড করা হয়েছে সারাদেশে।ভিকটিমদের মধ্যে নারী ১৩ হাজার ৮৬১ এবং শিশু ৩,৫২৮ জন।

জ্বি, স্রেফ এই সংখ্যাগুলো স্বয়ং মন্ত্রীই সংসদে এক প্রশ্নের জবাবে জানিয়েছেন। কালো কালো গুড়িগুড়ি এই সংখ্যাতে কখনো কারো মনে কোন ভাবনা আসে না। ক্রোধ জাগে না।

তাছাড়া এইসব বিষয়ে তাদের কারো কোন দায়-দায়িত্ব নেই। আমার আপনারও নেই। আমরা দেখবো শুনবো আর বড়জোর গালে এক হাত রেখে আঁতকে উঠার মতো ভঙ্গি করে পরবর্তী আলোচনায় চলে যাবো। কেননা আমার বা আপনার কেউ এখনো ওই সংখ্যায় পরিণত হয়নি। আমি বা আপনিও না। আমরা রাতবিরাতে বাসে, পথে একলা চলি না। আমাদের মেয়ে সন্তানরা রাত করে হেঁটে টিউশনি থেকে ফেরে না। চাকরির পরীক্ষা দিয়ে বা গার্মেন্টসের চাকরি শেষে একলা পথে হাঁটে না। আমাদের শিশুরা পাশের বাড়ি টিভি দেখতে যায় না, একলা বাড়িতে থাকে না। কেউ তাদের চকলেটের লোভ দেখাতে পারে না। আমাদের শিশু আর কন্যাদের আমরা প্রাণাধিক ভালোবাসি। তাই তাদের নিরাপদে রাখি। আমাদের চারপাশে কোন ধর্ষক নেই। লোভী হাত নেই।

তাহলে?

তাহলে আসুন আমরা নিশ্চিন্ত থাকি। আর উনাদেরও নিশ্চিন্তে থাকতে দেই। উনারা নিশ্চিন্তে ষোল বা সতেরো কোটি মানুষের ভালোমন্দ ভাবতে ভাবতে মাথার চুল ছিঁড়ুন, বক্তৃতা দিতে দিতে কেঁদে ফেলুন। কোটি কোটি জনতার সেবা করতে দামি গাড়ি দামি ফোন লেনদেন করুন, ফোনের বিল দিন না দিন। জনগণের সেবা করতে করতে উনাদের দিন কাটে না, রাত ভোর হয় না ভেবে আমরাও লজ্জিত হই আসুন।

সবিনয়ে আর একটা কথা বলতে চাই শুধু, এই যে সংখ্যাটি ১৭ হাজার ৩৮৯, এরা কি ষোল/সতেরো কোটির মধ্যেই পড়বে? নাকি এদের বাদ দিয়ে হিসেবটা করা হবে?

আচ্ছা, যেতে যেতে লেটেস্ট ঘটনাটা কি একটু শুনিয়ে যাবো?
সময় আছে?
শুনবেন?
পাহাড়ের ক্লাশ ফোরে পড়া একটা ত্রিপুরা মেয়ে। মেয়ে মানে শিশুই আরকি। আপনার ঘরের ক্লাশ ফোরে পড়া আহ্লাদি শিশুটির মতোই। তাকে ধর্ষণ করা হয়েছে। এরপরেও শেষ হয়নি, তার হাত কেটে ফেলা হয়েছে। না না, এখনই শোক দেখাবেন না। আরো একটু আছে, শুনুন। তার ক্ষতবিক্ষত নিম্নাঙ্গ দিয়ে নাকি গাছের গুঁড়িও ….

যাক গে।

উনারা ভালো থাকুন। জনসেবা করুন। নতুন নতুন কিছু আইন বানান। কাকে ধরা যাবে মারা যাবে কাটা যাবে জেলে পুরে রাখা কিংবা গুম করা যাবে।
আইন করে মুখ বন্ধ করার ব্যবস্থা করুন। এতোটুকু চ্যাঁ ভ্যাঁ যেন কেউ করতে না পারে- আইন দিয়ে তাই নিশ্চিত করুন। ভয় দেখান, ভয়! ভয়ে সব্বাই যেন মরা হয়ে থাকে যেমনটি আছে। ক্ষমতায় আমৃত্যু থাকা নিশ্চিত করুন, পারলে মৃত্যুর পরেও থেকে যান।
আমরা আছি না। আমরাই আপনাদের নামে জয়ধ্বনি দেবো। ভালোবাসবো। বাসতে বাসতে আকাশ বাতাস একাক্কার করে ফেলবো। ভাববেন না।

শুধু ধর্ষণ বন্ধ করতে টুঁ শব্দটিও যেন করবেন না। এইসব ধর্ষণ কেবলই সামান্য ঘটনামাত্র। এর বেশী তো কিছু নয়।

পাহাড়ে সদ্য ঘটা ঘটনাটি জানাতে গিয়ে আমাদেরই বন্ধু কুঙ্গ থাঙ লিখেছেন, “এইসব কড়া রাষ্ট্রীয় প্রহরা, দু’ফিট পরপর সেনাছাউনী, পুলিশ ফাঁড়ি, বিজিবি ক্যাম্প দিয়ে কী হবে যদি আপনারা সেখানকার মানুষগুলোর ন্যূনতম নিরাপত্তা বিধান করতে না পারেন৷ দু’দিন পর পর শিশুদের ধর্ষণ করে লাশ ফেলে রেখে যাচ্ছে, গৃহবধুকে ধর্ষণের পর গলা কেটে ফেলছে, জোড়ায় জোড়ায় ধর্ষণের পর বিষ খাইয়ে মারছে, ফাঁসিতে ঝুলিয়ে রাখছে৷ আপনাদের কেবল তখনই দেখা যায় যখন পাহাড়ি পল্লীতে ওরা আগুন দিতে আসে, দরিদ্র মানুষগুলোর ভিটেমাটি দখল করতে আসে, লুটপাট করতে আসে— আপনারা ছুটে আসেন সেই তস্করদেরকে সাহায্য করতে৷

কী অপরাধ ছিল ক্লাশ ফোরে পড়া ত্রিপুরা মেয়েটির ধর্ষণের পর যার হাতগুলি কেটে ফেলা হয়েছে, যৌনাঙ্গ ক্ষতবিক্ষত করে যার পায়ুপথে গাছের গুঁড়ি ঢুকিয়ে রাখা হয়েছে? এই নারকীয় বিভৎসতা আপনাদের দ্বারাই সম্ভব, রাষ্ট্রের সহযোগিতায় পাহাড় দখল করে রাখা তস্করেরা, যারা আপনাদেরই জাতভাই, তারা যুগের পর যুগ এইসব নারকীয় কান্ডগুলি ঘটিয়ে এসেছে৷

আপনাদের কি একটুও লজ্জা হয় না? কে বলেছে রেপিস্টের জাত হয় না? পাহাড়ে রেপিস্টের তো একটাই জাত— সেটলার, বাঙ্গাল৷

জবরদস্তি করে সংখ্যালঘু বানানোর আগে এই পাহাড়ে একদিন পাহাড়িরা সংখ্যাগুরু ছিল, তারা কি তখন সংখ্যালঘু বাঙ্গালী নারীদের উপর এভাবে ঝাঁপিয়ে পড়তো, শিশুদের উপর বিকৃত লালসা চরিতার্থ করতো, জোড়ায় জোড়ায় বাচ্চাদের খুন করতো?”

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.