শাফিনেওয়াজ শিপু:
প্রবাসে বাসা ভাড়া নিয়ে কমবেশি সবাই সমস্যার সম্মুখীন হয়, বিশেষ করে স্টুডেন্টদের ক্ষেত্রে। এমনকি আমিও অনেক ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলাম, কিন্তু ধর্মের কারণেও যে সমস্যার সৃষ্টি হয় তা আমার জানা ছিলো না।
দেখা হলো আমার এক বান্ধবীর সাথে দীর্ঘ ১৪ বছর পর। চেহারা চিনতে ভুল হয়নি, কিন্তু নামটি আমার কাছে অচেনা মনে হচ্ছিলো।
সাথে সাথে বান্ধবীকে জিজ্ঞেস করলাম, “কী রে আমি তো জানি তোর নাম ‘বর্ণা’, কিন্তু তোকে তো সবাই “সুমি” নামে ডাকছে, যার কারণে আমিও কনফিউজড ছিলাম আদৌ তুই আমাদের সেই বর্ণা কি না!”
সে মৃদু হেসে উত্তর দিলো, “আরে বান্ধবী! অনেক কাহিনী আছে এই নাম পরিবর্তনের পেছনে। যখন আমি এই দেশে প্রথম আসি তখন আমার ধারণা ছিলো নিশ্চয় বাংলাদেশের মতো এই দেশে ধর্ম নিয়ে এতো বাড়াবাড়ি নেই, কিন্তু আসার পর যে এগুলো দেখতে হবে কখনো ভাবিনি। তবে কথা আছে, সেটা বাঙালী এলাকাগুলোতেই হয়, ইংরেজরা সাধারণত এমন নয়। যেহেতু নতুন দেশ তাই সবাই বুদ্ধি দিলো বাঙালী এলাকায় থাকতে, যাতে করে কোনো সমস্যায় না পড়ি। কিন্তু জানিস, হিতে আরো বিপরীত হলো হিন্দু ধর্মের হওয়াতে। ইস্ট লন্ডনে অনেক বাসা আছে যেখানে হিন্দু ধর্মের মানুষদের বাসা ভাড়া দেওয়া হয় না।”
আমি তখন বললাম, “কই আমি তো এখনও এমন দেখি নাই আর তাছাড়া বাসা ভাড়া দিতে পারলে তো বাড়িওয়ালাদেরই লাভ, তাই না!”
বর্ণা আবার বললো, “অবশেষে একটা বাসা পেয়েছিলাম, কিন্তু উঠার আগে ছিলো এক ব্যবহার আর উঠার পড়ে হলো আরেক ব্যবহার। রান্না-বান্না থেকে শুরু করে সবকিছুতে কেমন জানি একটা আচরণ করতো, যেটা মেনে নেওয়া যেতো না, শুধুমাত্র ভিন্ন ধর্মের হওয়াতে এতো সমস্যা। আরে বাবা! উঠার সময় বলে দিয়েছিলো, তোমার ধর্ম তুমি পালন করবা, আর আমরা আমাদের, সুতরাং কেউ কারও ব্যাপারে বাধা দিবে না। কিন্তু মাস যেতে না যেতেই শুরু হয়ে গেলো ভিন্ন চিত্র। তুই বল, আমরা হিন্দু ধর্মের হয়েছি বলে কি আমরা মানুষ না! প্রতি মুহূর্তে খালি ভুল ধরতো। কোনোদিন কাজ থেকে বাসায় আসার পর শান্তি পেতাম না। সারাক্ষণ একটা ভয় কাজ করতো। কারণ জানিস তো বাসা পাওয়া আর পরিবর্তন করা অনেক কষ্ট। এমনকি সবকিছুতে খুঁত খুঁজে বের করতো। তখন আমার সাথে তোদের ধর্মের এক মেয়ে থাকতো, কিন্তু তার কোনো দোষ তারা খুঁজে পেতো না। তখন বুঝলাম, যেইভাবেই হোক এই বাসা ছেড়ে দিতে হবে। শুধুমাত্র জবের কারণে ঐ বাসায় অনেকদিন থাকতে হয়েছিল বাসা থেকে কাজে যেতে মাত্র ৫ মিনিট লাগতো”।
“এই তো গেলো প্রথম বাসার কাহিনী। এরপর যখন দ্বিতীয় বাসাটিতে উঠলাম, তখন সব ঠিকঠাকই ছিলো কিন্তু একদিন একটা ঘটনার মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে গেলো আমি অন্য ধর্মের। তখন আমি একটা পাবে কাজ করতাম। যেহেতু পাবে কাজ করতাম, তাই বাসায় আসতে রাত হয়ে যেতো। একদিন বাসায় আসতে অনেক রাত হয়েছিলো বলে কথা শুনিয়ে দিলো এই ভাবে যে, আমাদের মুসলিম মেয়েরা এই সব জব করে না, আর এগুলো কোনো ভালো জব না, হারাম জব। দয়া করে এই ভাবে আর দেরি করো না। তোমাকে বলে কী লাভ, তুমি তো অন্য ধর্মের। আজকে হয়তো কনসিডার করেছি, কিন্তু পরিবর্তিতে আর করবো না। পারলে তুমি বাসা ছেড়ে দিও। জানিস, হাসি পেলো যখন বাডিওয়ালা বয়ান দেওয়া শুরু করলো হারাম ও হালাল কাজ নিয়ে”।
“ভূতের মুখে রাম রাম। খ্রিস্টান দেশে থাইক্যা আবার বাহাদুরি দেখায় হালাল ও হারাম নিয়ে। এরপর যখন তৃতীয় বাসায় উঠলাম, তখন ঐ বাসায় মোটামুটি তিন ধর্মেরই ভাড়াটিয়া ছিলো, কিন্তু যে খ্রিস্টান ধর্মের, সে খুব একটা বাসায় থাকতো না। একদিন জানিস কী হয়েছে, ভুল করে আমি অন্যের পাতিলে রান্না করেছিলাম, ওরে বাবা এরপর বিশাল কাণ্ড। আপাটা রাগের চোটে পাতিল বিন করে ফেললো। কারণ সে এটাই বুঝাইলো যে আমার ছোঁয়া সে কোনো জিনিস ধরবে না। সামান্য একটা জিনিস নিয়ে উনি যা করলো রে, আজকে হিন্দু ধর্মের হওয়াতেই এতো কিছু। তারপর একদিন আমার এক কলিগ বললো, নাম পরিবর্তন করে ফেলতে যাতে করে বোঝা না যায় আমি হিন্দু ধর্মের। সমস্ত কিছু চিন্তা করে আমি তাই করলাম”।
সবকিছু শোনার পর আমিও বললাম, “সভ্য দেশে আছি ঠিকই, কিন্তু আমরা এখনও অসভ্যের মতো আচরণ করি। কুসংস্কার থেকে বের হতে পারিনি এখনও। ঐ যে কথায় বলে না কয়লা ধুলেও ময়লা যায় না। আমাদের বাঙালিদের অবস্থা সেই রকমই। আরে বাবা এতোই যখন সবকিছুতে আপনাদের ধার্মিক ভাব, তাহলে এই দেশে আছেন কেনো, এরাবিয়ান দেশে যান। সেটা তো করবে না, উল্টো সব কিছুতে ধর্মকে টেনে আনবে।
যাই হোক তোর অনেক অভিজ্ঞতা হলো এই সব মানুষদের নিয়ে তাই না?? আচ্ছা শোন আমি যদি তোর এই কাহিনী নিয়ে একটা আর্টিকেল লিখি তোর কোনো সমস্যা আছে?? তখন বান্ধবী বললো, “লিখে ফেল, অন্তত মানুষ জানতে পারবে এই উন্নত ও সভ্য দেশেও এই ধরনের সমস্যায় পড়তে পারে মানুষ শুধুমাত্র ভিন্ন ধর্মের হওয়াতে। তবে এটা শুধুমাত্র বাঙালী এলাকায় হচ্ছে, মানে বাঙালী বাসাগুলোতেই।”