‘যাব বহুদূর’ অবশ্যই যাবে বহুদূর, যেতেই হবে

সুপ্রীতি ধর:

“এতো এতো মানুষ আমার বন্ধু তালিকায়। তাদের অনেকেই সাহায্যও করেছেন। কিন্তু যে পরিমাণ সাহায্য করলে একটা জায়গা পাওয়া যাবে, সেটুকু যদি করতেন, খুব উপকার হোতো। “যাব বহুদূর”-এর স্বপ্ন আমি দেখেছিলাম। কিন্তু এই স্বপ্ন এখন আর আমার একার নয়। আপনারা যারা ভালবেসেছেন এই কাজটাকে, পাশে থাকতে চেয়েছেন, পাশে থাকবেন বলে জানিয়েছেন, প্লিজ একটা জায়গার ব্যবস্থা করে দিন। একা একা আর পেরে উঠছি না। আপনাদের কারো কাছে স্কুটি কেনার টাকা চাচ্ছি না বা আর কোন ধরনের কোন সাপোর্ট চাচ্ছি না, শুধু একটা জায়গা চাচ্ছি। কেউ কি একটু ব্যবস্থা করে দেবেন প্লিজ?? প্লিজ?”

কথাগুলো আমার বন্ধু আতিকা রোমার। ওর এই আবেদন-অনুরোধটা দীর্ঘদিন ধরেই দেখছি, এমনকি আমাকে বার বার ফোন করেও জানতে চেয়েছে, কিছু করতে পারি কীনা! আমি চুপ করে গেছি। কারণ আমি জানি আমার ক্ষমতা সীমিত। তাছাড়া আমি দেশেও নেই। ফোনে ওর কণ্ঠটা শুনে আমার ভালো লাগেনি। স্বপ্নবাজ মানুষের স্বপ্ন পূরণ না হওয়ার কষ্টের সাথে আমি পরিচিত, আমি জানি স্বপ্ন পূরণ না হলে নিজের প্রতি কতোটা বিতৃষ্ণা আসে! আমি নিজেও একটা স্বপ্ন নিয়ে মাঠে নেমেছিলাম, শুধুমাত্র মানুষের অসহযোগিতাতেই সেই স্বপ্ন মুখ থুবড়ে পড়তে পড়তেও কোনরকমে হেঁটে চলেছে।

তাই আমি চাই না, আরেকটি স্বপ্ন, যা কিনা আমাদের মেয়েদের কয়েকশ গুণ এগিয়ে দেয় সামনের দিকে, সেটি এখানেই থেমে যাক। ঢাকার রাস্তায় যখন মেয়েগুলো স্কুটি নিয়ে দাপিয়ে বেড়ায়, আমি চেয়ে থাকি অপলক। কতোদিন স্বপ্ন দেখেছি, আমিও একদিন এভাবেই পথে নামবো। কিন্তু হয়নি আমার। আমার হয়নি বলে অন্যের হবে না? অবশ্যই হবে, হতেই হবে। আমাদের পরবর্তি প্রজন্ম শুধু স্কুটিই নয়, সবজায়গায় সাফল্যের ছাপ রেখে যাবে। কিন্তু সেইজন্য পথ তো তৈরি করতে হবে কাউকে না কাউকে। রোমার স্বপ্নটা এরকমই একটি পথ, যা শুধু মেয়েদের ওপরেই তুলতে সহায়তা করবে।

মেয়েরা যখন থেকে কর্মজীবী হয়ে উঠেছে, তখন থেকেই একটা নিরাপদ বাহনের অভাব সে অনুভব করেছে। ঢাকার রাস্তায় গণপরিবহনে চলাচলকারী প্রতিটি মেয়ে জানে কী দু:সহ পরিস্থিতি মোকাবিলা করে তাকে কাজে যেতে এবং ফিরতে হয়। এতো এতো বৈরিতা চারদিকে ছড়ানো থাকে মেয়েদের যে একটা একটা করে জঞ্জাল সরিয়ে পথটাকে এগিয়ে নেয়া কঠিন হয়ে যায়। একসময় মেয়েটি বাধ্যও হয় রণে ভঙ্গ দিতে।

আতিকা রোমা, যাকে আমরা রোমা বলে ডাকি, সে চেয়েছিল এই মেয়েগুলোর একটিও যেন আর বাদ না পড়ে জীবনযুদ্ধ থেকে। বেসামাল গণপরিবহনের ততোধিক পুরুষতান্ত্রিক কর্মিদের হ্যান্ডেল করতে গিয়ে ক্লান্ত মেয়েটি যখন নিজেই স্টিয়ারিং হাতে তুলে নেয়, সেটা যে কতো বড় অর্জন, নারীর অধিকার আদায়ের পথে কতোবড় সাফল্য, এটা রোমা দেখতে চেয়েছিল। কিছুটা এগিয়েও গেছে সে তার স্বপ্নপূরণের পথে। এরই মাঝে নিজের চড়া বেতনের চাকরি ছেড়ে দিয়ে শুধুমাত্র মেয়েদের চলার পথ কণ্টকমুক্ত করার অভিপ্রায়ে সে খুলেছে ‘যাব বহুদূর’ নামের একটি স্কুটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। অনেকগুলো ব্যাচ এরই মধ্যে প্রশিক্ষণ শেষে মাঠেও নেমে গেছে।

ঢাকার রাস্তায় এখন অনেক মেয়ে স্কুটি চালায়। দৃশ্যটা একবার ভাবুন তো! গাড়ির স্টিয়ারিং যখন নিজের হাতে, একসময় জীবনের স্টিয়ারিংও তার হাতেই উঠবে, এটাই চাওয়া। মেয়েরা এগিয়ে যাবে বীরদর্পে। এখন শুধু প্রয়োজন ঢাকার বুকে এক টুকরো নিরাপদ জায়গা, যেখানে প্রশিক্ষণটা চালিয়ে নেবে রোমা। যেখানে শুরু করেছিল, কিছু জটিলতায় সেটা আর সম্ভব হচ্ছে না। দরকার নতুন জায়গার।

আমারও বন্ধুলিস্ট বড়, বন্ধুভাগ্যটাও না হয় প্রমাণ হয়ে যাক। যাদের নিজেদের, বা জানামতে, বা ক্ষমতার বদৌলতে এক টুকরা জায়গা দেয়ার ক্ষমতা আছে মেয়েদের স্কুটি প্রশিক্ষণের জন্য, প্লিজ এগিয়ে আসুন। কিছু করতে চেয়েছিলেন তো মেয়েদের এগিয়ে যাবার লক্ষ্যে? এটাই কিন্তু মোক্ষম সুযোগ আপনার জন্য। জায়গাটা ঢাকার তেজগাঁও বা কেন্দ্রের দিকে হলে ভালো হয়, যেখানে সবার চলাচলের সুবিধা হয়। আর প্রয়োজন সিকিউরিটি। ভোরবেলায় অফিস যাওয়ার পথে এবং আসার পথে শিখে যাবে, কাজেই সিকিউরিটিটা জরুরি।

নেই কেউ এমন দেশে অথবা বিদেশে বসবাসকারী বন্ধু, যার এমন সুযোগ আছে দেয়ার মতোন? স্বপ্নটা ভেঙে যেতে দিয়েন না কেউ।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.