যখন সব প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়!

ফাহমিদা খানম:

সংসারে কেউ কেউ প্রয়োজন হয়ে থাকে, সময়ের সাথে প্রিয়জনের সংজ্ঞা বদলে যায়। হয়তো এটাই স্বাভাবিকতা। সময়ের কাছে সব মানুষ বড়বেশি অসহায়।

“মা তুমি ইরাকে কী বলেছো? জানো সংসার আর বাচ্চা নিয়ে সারাদিন দৌড়ের উপরে থাকে। কিছু খেতে মন চাইলে শরীফাকে বলতে পারো না?”
“বাবারে জ্বরের মুখে রুচি নাই বলে বাজার থেকে ছোটমাছ আনতে বলেছি, আর বলেছি ও যেন টক দিয়ে রান্না করে দেয়, শরীফার রান্না খেতে আর ভালো লাগে না। অন্যায় হয়েছে বুঝি?”
“আহ মা সবকিছু সহজ করে দেখতে শিখো। এসব মাছ ইরা খায় না, তাছাড়া বুয়ারাও বিরক্ত হয়”।

ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললাম —“ছোটবেলায় জ্বর হইলে তুইও কতো কী বায়না করতি! আমি তো একটুও বিরক্ত হইতাম না বাপ। সময়ে সব পালটেছে!”

“খালাম্মা কি খাইবেন কন? ভাইজান বলছে, আপনি যা খাবেন রানতে”।
“শরীফা তুমি ওদের জন্যই রান্না করো, আমার রুচি নাই”।
“গত দুইদিন কিছুই তো খান নাই, একটু লেবুর শরবত বানাইয়া দেই?”

আজকাল কী যে হয়েছে অকারণেই খালি চোখে পানি আসে!
“খালাম্মা আইজ কি জাউ রান্দুম? কালকের অনেকখানি রইয়া গেছে”।
“নাহ খিদে লাগলে আমি গরম করে সেটাই খেয়ে নিবো, তুমি রান্না করো না”।
“আম্মা, আমি রোজকে নিয়ে স্কুলে যাচ্ছি, ছুটি হলে একসাথেই ফিরবো। আপনার কিছু লাগলে বলেন”।
“নাহ মা, আমার কিছুই লাগবে না, তুমি যাও স্কুলে”।
“দাদু তোমার জন্য আমড়া আর আচার আনবো আজ”।

ভাইরাসজনিত জ্বর হলে নাতিনের এই রুমে ঢোকা বন্ধ, শুধু কথা শুনলাম। ভাইরাসের মতো চোখের জল বড্ড ছোঁয়াচে, যখন-তখন না বলে-কয়ে চলে আসে।

“খালাম্মা আপা তো এখনো আইলো না, আমি কতক্ষণ বইয়া থাকুম?”
“হয়তো জ্যামে পড়েছে, তুই দরজা লক করে চলে যা”
“আপনি উঠতে পারবেন? পোলাডা স্কুল থেকে এই সময় আসে। আমি না গেলে তো উপাস থাকবো”।
“শরীফা, আবারও বিকালবেলা তোরে আইতে হইবো, আমি পারবো”।

শরীফা যাবার পর বাথরুম থেকে ফিরতেই পেটে তীব্র খিদে টের পেলাম। টেবিলে খাবার ঢাকনা দেয়া, তুলে দেখি বয়লার মুরগি, ডাল আর বেগুনভাজা। জ্বরের মুখে রুচি নেই বলে বউকে ছোট মাছ রাঁধতে বলেছিলাম, অপরাধ হবে বুঝিইনি। মনে হলো ঝাল দিয়ে ডিম ভাজি করে ডাল মেখে একটু ভাত খাই। ডিম হাত থেকে পড়েই গেলো, পরিষ্কার করতে গিয়ে মাথাটা কেমন দুলে উঠলো, রুমে এসে শুয়ে পড়লাম। বহুকাল আগে হারিয়ে যাওয়া মায়ের মুখটা দিনেদিনে অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সামান্য জ্বর হলেই মাকে নড়তেই দিতাম না। ছোট মেয়ে বলে আবদার ছিলো বেশি। কতো যুগ আগের কথা সেসব! মা কেবল আমার নিজের ছিলো, অন্য ভাইবোনকে ভাগ দিতেও আমার আপত্তি ছিলো। মা যাবার পরে কেউ তো আর সেই স্নেহভরে হাত মাথায় রাখেনি। অসময়ে মাঝে মাঝে স্মৃতির দরজায় কড়া নাড়ে ঘূণপোকা –স্মৃতির।

“আম্মা, আপনি আজকেও দুপুরবেলা কিছু খান নাই?”
“মারে, মুখে রুচি নাই, খেতে গেলে বমি আসে”।
“কিছু না খেয়ে বিছানায় পড়লে আপনাকে দেখবে কে? ”

ঝাল করে ডিমভাজির কথা বউকে বলাই হলো না, অবাক হয়ে ভাবলাম, সত্যিই তো আমি বিছানায় পড়লে কে দেখবে আমাকে?

“আম্মা, তুমি কী খেতে চাও বলো আমি কিনে আনি, এভাবে না খেয়ে থাকলে তো তুমি দুর্বল হয়ে যাবে”।
“কাল খোঁটা শুনেই পেট ভরেছে বাপ”—–মনে মনে বলি। সব সত্যি মুখের উপরে বলতে নেই, তাতে সংসারে অশান্তি আরও বাড়ে। একটা সময় পরে ধাক্কা খেয়ে খেয়ে অনেককিছু শিখেছি।

“অফিস থেকে ফিরে মেয়েটার পড়া নিয়ে বসলে কী হয়? আমি আর একা কতোদিক একা সামাল দিবো? ”

ছেলে উঠে গেলো। আমি মনে মনে বললাম, একটা বাচ্চাকে স্কুলে আনা-নেয়া করতেই বউটা এতো ক্লান্ত হয়ে যায়!
বিয়ের সময় আমি ছিলাম সরকারি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষিকা। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি থেকে চাকুরি করতে বাধা আসেনি। রাতুলের বাবা ঢাকা ছোট চাকুরি করতো, বাবা-মায়ের জন্য আমাকে ঢাকায় আনেনি। নিজে মেসে কষ্ট করেছে। রাতুলের জন্মের পর চাকুরি ছেড়ে দিতে চেয়েছি কতবার! সরকারি চাকুরি, তাই ছাড়তেও পারিনি। শ্বশুর -শ্বাশুড়ি মারা যাবার পর সত্যিকার বিপদে পড়লাম। ছেলেকে কার কাছে রেখে যাবো? প্রতিবেশী এক চাচাতো ভাশুরের বাসায় রেখে যেতাম। একদিন স্কুল থেকে ফিরেই দেখি ছেলের উথালপাতাল জ্বর, অন্য বাচ্চাদের সাথে পানিতে ছিলো সারাদিন। জ্বরের ঘোরে ছেলের উলটাপালটা বকুনি আর খিঁচুনি শুরু হবার পর নিয়ে গেলাম সদর হাসপাতালে। মায়ের মন সেদিন বড় বেশি অপরাধে ভুগে চাকুরিটা ছেড়েই দিলাম। সবাই বলেছিল, সরকারি চাকুরি কেউ ছাড়ে —বেকুব কোথাকার! চাকুরির চেয়ে রাতুল আমার কাছে বড় ——-আমি যে মা।

রাতুলের বাবার সরকারি স্কুলে চাকুরি হবার পর আমাদের ঢাকায় নিয়ে এলো। অবসর বলে তার কিছুই ছিলো না। ব্যাচে বাচ্চা-কাচ্চা পড়াতো, সংসারে সময় দিতেই পারতো না। বাচ্চাদের স্কুলে নেয়া, বাজার করা সব একাই সামলেছি কখনওই অভিযোগ জানাইনি। সংসার আমাদের দুজনের আর রাতুলের বাবা তো আমাদের জন্যই এতো কষ্ট করে। রেস্ট কী জিনিস বুঝিনি। দুপুরবেলা ঘুমালে দুই ভাই অঘটন ঘটিয়ে বসতো, আর পাড়া প্রতিবেশীদের বিচার তো ছিলোই। সময়ে সবকিছুর ভাবনাই পালটেছে।

“রাতুল আমি কয়েকদিনের জন্য রাহুলের ওখানে ঘুরে আসি”।
“আচ্ছা আপনি বরং ওকেই বলুন আপনাকে এসে যেন নিয়ে যায়, ওরা দুজনেই সারাদিন অফিসে থাকে। ফেরার সময় নিয়ে গেলেই হবে”।

রাহুলকে ফোন দিয়ে জানলাম, ওরা বান্দরবন টুরে যাচ্ছে বেড়াতে, তাই এখন নিতে পারবে নাহ। আমার এক বউ বাচ্চা স্কুলে আনানেয়া করে ক্লান্ত, আরেকজন অফিস করে ক্লান্ত। ছুটির দিনে নিজেরাই রান্না করতে অন্তত পারে প্রিয় মানুষদের জন্যই। নাহ তাতেও প্রবল আপত্তি। একদিনের ছুটি তারা বাইরেই বেশি খায়, ছেলেদের সংসারে অশান্তি চাই না বলে শুধু দেখি। ছোট ছেলের বউ কিছুদিন গেলেই অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে, নিজেরা যা ইচ্ছে খায়, শাশুড়ি থাকলে মাথা ঘামাতে যে হয়! একটা বয়সের পর সংসারে প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়। ছোটবেলায় দুই ছেলেই মাকে ছাড়া চলতেই পারেনি।

এখন একবার বড় ছেলে, আরেকবার ছোট ছেলের বাসায় দিন পার করি। মাঝে-মধ্যে নিজেকে ফুটবল মনে হয়। দুই দল একে অপরের দিকে ছুঁড়ে মারে। খুব ইচ্ছে ছিলো দুই ছেলে বউ নাতিনাতনি নিয়ে ভরাট একটা সংসার হবে। দুই বউ মিলে চলতেই পারলো না, সবারই আলাদা প্রাইভেসি লাগে।

রাতুলের বাবা যাবার পর একদম একা হয়ে গেছি। দুই ছেলে ছোট থাকার সময় এতোটুকু অবসরের জন্য কতো ছটফটিয়েছি! ভেবেছি ওরা বড় হলে কতো কী করবো? ছেলেরা বড় হয়ে আলাদা জগত হয়েছে, আমারই এখন অফুরন্ত অবসর। মেয়ে নেই বলে আফসোস করলে রাতুলের বাবা বলতো ——“বিয়ে দিলে মেয়ে দূরে চলে যেতো, এখন দুই মেয়ে ঘরে আসবে।”

মানুষটা বদলে যাওয়া পৃথিবী দেখে যায়নি। বড় হিংসা হয় ওকে। আচ্ছা জগতে নিজের বলে কি সত্যি কিছু আছে? সময়ের পরিক্রমায় সবকিছুই তো বদলে যায়। একসময় সংসার, সন্তানের জন্য আমি প্রয়োজনীয় ছিলাম, আজ সে প্রয়োজন ফুরিয়েছে।

২৮/৭ /১৮

শেয়ার করুন: