বিজ্ঞানে নারীর পদচারণা: কণ্টকমুক্ত ছিল কি?

ফাহমি ইলা:

পৃথিবীতে পিতৃতন্ত্রের বয়স প্রায় ছয় হাজার বছর, যেখানে আধুনিক বিজ্ঞান এসেছে আঠারো শতকে। পিতৃতন্ত্রের এই দীর্ঘ সময়ে নারীর জীবন সহজ ফুল বিছানো কন্টকমুক্ত পথ ছিলো না কখনোই। বিজ্ঞান হোক আর সাহিত্য, মৌলিক অধিকার হোক আর স্বপ্ন, কিছুই কি নারীর জন্য সহজ ছিলো? ইতিহাসবেত্তারা স্বয়ং পুরুষ, আর সে কারণে নারীর অবদানকে খুব কমই ইতিহাসে ঠাঁই দেয়া হয়েছে। আজ আমি আমার স্বল্প জ্ঞানে কয়েকজন নারী বিজ্ঞানীর কথা উল্লেখ করতে চাই যারা বিজ্ঞানে রেখেছেন অসামান্য অবদান।

পৃথিবীতে যুগে যুগে পৃথক থেকে পৃথকতর করা হয়েছে নারী-পুরুষকে। নারীকে সামাজিক সাংস্কৃতিক শেকলে বাঁধা হয়েছে শত শত বছর ধরে। এই শেকল পায়েই বিভিন্ন সময় হাজার বাঁধা পেরিয়ে নারীরা বেরিয়ে এসেছেন কূপমণ্ডূকতা থেকে, প্রমাণ করেছেন নিজেদের জ্ঞান গরিমা। জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতিটি সেক্টরে নারী বীরদর্পে হেঁটেছেন। যদিও তাদের এ পদচারণা পাপড়িসমৃদ্ধ সুগম পথে ছিলো না, বরং ভোগ করতে হয়েছে নিদারুণ যন্ত্রণা।

শিশুকাল থেকে আমরা বিজ্ঞানী মানেই জেনে এসেছি বহু জ্ঞানী পুরুষের নাম। তার মানে কি নারীরা বিজ্ঞানে অবদান কম রেখেছেন? নারীদের কি বৈজ্ঞানিক গবেষণার মতো জ্ঞান, শক্তি নেই? বিজ্ঞানে নারীর অবদান নিয়ে পড়াশোনা করতে গিয়ে উপলব্ধি করলাম অনেক অনেক জ্ঞানী নারীর নাম বইয়ের পাতায় ঠাঁই পায়নি। আমাদের শুধু শেখানো হয় নারী মায়ের জাত, নারীর কাজ ‘গৃহস্থালী’ নামক ইনভার্টেড কমায় আটকে গেছে। আসুন কয়েকজন নারী বিজ্ঞানীর নাম জানি যারা সকল ইনভার্টেড কমাকে ভেঙ্গে বেরিয়ে আসেন আলোয়।

আমরা হাইপেশিয়ার কথা জানি। হাইপেশিয়া বিখ্যাত মিশরীয় নব্য প্লেটোবাদী দার্শনিক এবং গণিতজ্ঞ ছিলেন। নারীদের মধ্যে তিনিই প্রথম উল্লেখযোগ্য গণিতজ্ঞ। একাধারে তিনি ছিলেন গণিতবিদ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও দার্শনিক। তিনি ৪০০ সালের দিকে নব্য প্লেটোনিক ধারার স্কুলের প্রধান হয়েছিলেন এবং খ্রিস্টান ধর্মসহ তখনকার ধর্মগুলো সম্পর্কে অবগত ছিলেন। কিন্তু তা তাকে আকর্ষণ করতে পারেনি। তিনি বলেছিলেন- ‘পরিণত বুদ্ধির জাতির জন্য থাকা উচিত যুক্তিসহ জ্ঞানভিত্তিক ধর্ম, যা ছিল গ্রিকদের’। তৎকালীন সময়ে এ ধরনের শিক্ষাকে প্যাগান রীতিনীতি ও সংস্কৃতির সাথে একীভূত মনে করা হতো এবং এর ফলে জ্ঞানের বিকাশের পথে বাঁধার সৃষ্টি হয়। এ কারণে তাকে অনেক প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে হয়।

তার দুটি বিখ্যাত উক্তি থেকে তার দর্শনের অকাট্যতা বোঝা যায়: ‘তোমার চিন্তা করার অধিকার সংরক্ষণ করো। এমনকি ভুলভাবে চিন্তা করা একেবারে চিন্তা না করা থেকে উত্তম’। তিনি আরও বলেছিলেন- ‘কুসংস্কারকে সত্য হিসেবে শিক্ষা দেয়া একটি ভয়ংকরতম বিষয়’। ৪১৭ খৃস্টাব্দের কোনো এক দিনে খৃস্টান ধর্মান্ধরা এই মহীয়সী নারীকে হত্যা করে নির্মমভাবে। বর্ণনামতে, রথে করে ফেরার পথে উন্মত্ত জনতা তার উপর হামলা করে এবং হত্যার পর তার লাশ কেটে টুকরো টুকরো করে রাস্তায় ছড়িয়ে দেয়। তার দেহ যখন খ্রিস্টান ধর্মান্ধরা ছিন্নভিন্ন করছিল তখন একবারের জন্যও চেঁচিয়ে, কেঁদে মিনতি করে জীবন ভিক্ষা চেয়ে নিজের মর্যাদা ক্ষুন্ন করেননি। অনেক বিশেষজ্ঞই তার মৃত্যুকে প্রাচীন আন্তর্জাতিক শিক্ষাকেন্দ্র আলেক্সান্দ্রিয়ার পতন ও মধ্যযুগীয় অন্ধকারের সূচনাকাল হিসেবে চিহ্নিত করেছেন যাঁর মৃত্যুর সঙ্গে জড়িয়ে আছে মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া গ্রন্থাগারের হাতে লেখা পাঁচ লক্ষ বইয়ের ধ্বংসের কাহিনী।

মারি ক্যুরি বিজ্ঞানের আরেক নক্ষত্র। ১৮৯১ সালে ২৪ বছর বয়সে সে তার বড় বোন ব্রোনিস্লাভাকে অনুসরণ করে প্যারিসে পড়তে যান। পরবর্তীতে বিজ্ঞানী পিয়েরা কুরির সাথে তার সংযোগ হয় এবং তারা বিয়েও করেন। ১৯০৩ সালে মারি কুরি তার সঙ্গী পিয়েরে কুরি এবং পদার্থবিদ হেনরি বেকেরেলের সাথে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার জেতেন তেজষ্ক্রিয়তা নিয়ে কাজ করার জন্য এবং তিনি এককভাবে ১৯১১ সালে রসায়নেও নোবেল পুরস্কার জেতেন পিচব্লেন্ড থেকে রেডিয়াম পৃথক করার জন্য। মেরি কুরি প্রথম নারী এবং একইসাথে ইতিহাসে প্রথম ব্যক্তি, যিনি দুবার দুটি ভিন্ন ধারায় নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন। মেরি কুরি অবর্ধক রক্তশূন্যতায় আক্রান্ত হয়েছিলেন; ধারণা করা হয় দীর্ঘদিন দীর্ঘক্ষণ তেজস্ক্রিয়তার সংস্পর্শে থাকায় তিনি এই রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। তাঁকে সেকাউক্সের সমাধিস্থলে তাঁর সঙ্গী পিয়েরের পাশে সমাহিত করা হয়। ৬০ বছর পর, ১৯৯৫ সালে তাঁদের অবদানকে সম্মান জানানোর অংশ হিসেবে উভয়ের দেহাবশেষ প্যান্থিওনে স্থানান্তর করা হয়। তিনি প্রথম এবং এখন পর্যন্ত একমাত্র নারী যিনি নিজ যোগ্যতার ভিত্তিতে প্যান্থিওনে সমাহিত হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেন।

বিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞানমহলে সম্ভবত সবচেয়ে অবহেলিত নাম লিসা মাইটনার। গোটা জীবনটাই তাঁর কেটেছে চরম লিঙ্গবৈষম্য, অবিচার ও বিশ্বাসঘাতকতার বিরুদ্ধে লড়াই করে। সমস্ত প্রতিকূলতাকে পিছনে ফেলে রেখে তিনি নিজের যোগ্য জায়গা করে নিয়েছিলেন পুরুষপ্রধান বিজ্ঞান জগতে। পদার্থবিদ্যা নিয়ে তাঁর পড়াশুনা শুরু হয় ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং পরবর্তীকালে ১৯০৫ সালে পদার্থবিদ্যায় ডক্টরেট উপাধিও লাভ করেন ওই একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তিনি ছিলেন ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট অর্জন করা দ্বিতীয় নারী বিজ্ঞানী। লিসা মাইটনার ছিলেন অপরূপা। তার রূপের জন্য অন্য বিজ্ঞানীদের মনোযোগ নষ্ট হবে এ ব্যাখ্যা দিয়ে তাকে এমিল ফিশার ইন্সটিটিউটে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। প্রকট লিঙ্গ বৈষম্যের সেসময়কালের গোড়ার কয়েকটা বছর লিসা তাঁর পারিশ্রমিকই পেতেন না, পরে যাওবা পেতেন তা ছিল পুরুষবিজ্ঞানী অটো হানের পারিশ্রমিকের তুলনায় নিতান্তই সামান্য।

তবে তাঁদের যৌথ প্রয়াস বিজ্ঞানের জগতে এনে দেয় দারুণ কিছু ফলাফল। যেমন – ১৯১৮ এ প্রোট্যাক্টিনিয়াম নামে নতুন মৌলের আবিষ্কার। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অবদান হলো ১৯৩৮ সালে নিউক্লিয়ার ফিশনের আবিষ্কার। কিন্তু ১৯৪৪ সালে সহকর্মী অটো হানকে নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত করা হলেও অনুচ্চারিত থেকে যায় লিসার নাম। তাঁর নির্বাসন এবং বার্লিনে গবেষকদের দল থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার কারণে এই তত্ত্ব উদ্ভাবনে লিসার প্রধান ভূমিকার কথা বুঝতে পারেননি নোবেল পুরষ্কারদাতারা। নোবেল পুরষ্কারের ইতিহাসে এই বড় ভুলকে চিহ্নিত করা হয় “নোবেল মিসটেক” হিসেবে। লিসা পুরো জীবন কাটিয়েছেন যুদ্ধের বিপক্ষে সংগ্রাম আর বিজ্ঞান প্রচার করে। তিনি কেমব্রিজে গিয়ে অবশেষে অবসর নেন এবং সেখানেই ১৯৬৮ সালে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর সমাধিপ্রস্তরে তাঁর উদ্দেশ্যে ভাগ্নে অটো ফ্রিশের লেখা শব্দগুলি আজও পড়া যায়: “লিসা মাইটনার: এক পদার্থবিজ্ঞানী যিনি কখনো তাঁর মনুষ্যত্ব হারাননি।” ১৯৯৭ সালে তাঁকে সম্মান জানিয়ে তাঁর নামানুসারে মৌল ১০৯ এর নাম দেওয়া হয় মাইটনারিয়াম (Mt)।

রোজালিন ফ্রাঙ্কলিন ছিলেন একজন অণুজীববিজ্ঞানী এবং ভৌত রসায়নবিদ। তাকে সবচেয়ে ভালোভাবে স্মরণ করা হয় কয়লা, ডিএনএ এবং উদ্ভিদ ভাইরাস সংক্রান্ত গবেষণায় তাঁর বিশেষ অবদানের জন্য। তার মতো আর কোনো নারী-বিজ্ঞানীর জীবন এতোটা বিতর্কিত এবং কর্মমুখর ছিল না। ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৫০ সালের মধ্যে তিনি ফ্রান্সের প্যারিসে একটি গবেষণাগারে কাজ করেন। এখানেই কেলাসতত্ববিদ জ্যাকস মিরিং-এর সাথে ঘনিষ্ঠভাবে তিনি গবেষণা করেছিলেন এবং রঞ্জনরশ্মি বিচ্ছিন্নকরণ কৌশল শিখেছিলেন। খুব সাধারণ কিছু সরঞ্জাম নিয়ে ফ্রাঙ্কলিন ডিএনএ-এর একক তন্তুর উচ্চ বিশ্লেষণীয় ফটোগ্রাফ নেয়ার জন্য একটি ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। ১৯৫৩ সালে ডিএনএর গঠনকাঠামো আবিষ্কারের মাধ্যমে সারাবিশ্বে দারুণ আলোড়ন তোলেন। রোজালিন ফ্রাঙ্কলিন-এর এই কেলাস সম্পর্কিত কাজ ওয়াটসন, ক্রিক ও উইলকিনস কর্তৃক উপস্থাপিত ডাবল হেলিক্স মডেলের পরীক্ষামূলক সমর্থন যুগিয়েছিল। অথচ জেমস ওয়াটসন, ফ্রানসিস ক্রিক এবং মরিস উইলকিনসকে ডিএনএ-র ডাবল হেলিক্স গঠনের জন্য নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হলেও রোজালিন ফ্রাঙ্কলিনকে এই অমূল্য কাজের জন্য কোনো কৃতিত্বই দেয়া হয়নি।

অবশ্য এর আগে ১৯৫৬ সালের শরতে রোজালিন ফ্রাঙ্কলিন মাত্র ৩৭ বছর বয়সে জরায়ু ক্যান্সারে মৃত্যুবরণ করেন। তার সহকর্মী নোবেল বিজয়ী ওয়াটসন বলেন-‘ নোবেল পুরষ্কারে অলিখিত নিয়ম হলো একসঙ্গে তিনজন প্রাপকের বেশি বিবেচনা করা হয় না। ফ্রাঙ্কলিন বেঁচে থাকলে তাকে না উইলকিন্সকে নোবেল দেয়া হবে এ নিয়ে বিতর্ক হতই। তবে নোবেল কমিটি তাকে এবং উইলকিন্সকে যুগ্মভাবে রসায়নে নোবেল দিতে পারতেন। তার জায়গায় নোবেল গেলো একি ইন্সটিটিউটের ম্যাক্স পেরুজ ও জন কেন্ড্রুর কাছে মায়োগ্লোবিন ও হিমোগ্লোবিনের গঠনকাঠামো ব্যাখ্যা করবার জন্য। আর এই কাজের জন্য আমি এবং ফ্রান্সিস ক্রিক কাজ শুরু করেছিলাম।‘ সমালোচকদের মতে, রোজালিন ফ্রাঙ্কলিনের অবদানের জন্য তিনি চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পাবার উপযুক্ত ছিলেন। কিন্তু তিনি হয়েছেন বঞ্চিত। তাই ডিএনএ-র গঠন কাঠামো আবিষ্কারের গল্পকে এখনও বলা হয় একটি প্রতিযোগিতামূলক ষড়যন্ত্র্র।

আডা বায়রনকে কম্পিউটার প্রোগ্রামিং ধারণার একজন প্রবর্তক বলা হয়। তিনি কবি লর্ড বায়রন ও অ্যানে ইসাবেলে মিলব্যাংকের কন্যা। আডার জন্মের একমাসের মাথায় তার বাবা-মা পৃথক হয়ে যান। তিনি ১৮৪১ সাল পর্যন্ত জানতেন না লর্ড বায়রন তার বাবা। লেডি বায়রন কোনো ভাবে চাননি তার মেয়ে বাবার মতো কাব্যময় হোক। তিনি চেয়েছিলেন অ্যাডা গণিত ও সঙ্গীত শিক্ষার মধ্যদিয়ে বড়ো হোক। কিন্তু অ্যাডার উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত ঐতিহ্য ১৮২৮ সালের প্রথমদিকে প্রতীয়মান হয়েছিল, যখন তিনি ফ্লাইং মেশিনের নকশা প্রণয়ন করেছিলেন। আর গণিতশাস্ত্র তার জীবনকে দিয়েছিল উড়ে চলার গতি। স্যার চার্লস উইলিয়াম ব্যাবেজ যখন তার ডিফারেন্স মেশিন বা এনালিটিক্যাল এঞ্জিন নামক কম্পিউটার আবিষ্কারের নেশায় মত্ত, তখন অ্যাডা তার গণিতবিষয়ক বিশ্লেষণী ক্ষমতার দ্বারা বুঝতে পেরেছিলেন এই কম্পিউটারগুলোর নাম্বার ক্রাঞ্চিং এর অমিত সম্ভাবনা সম্পর্কে। অ্যাডা বায়রনকে এখন বিশ্বের প্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রামার ধরা হয়।

প্রথম ফসিল অনুসন্ধানী হিসেবে ধরা হয় ম্যারি এনিংকে। তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা খুব কম থাকালেও প্রত্নজীবাশ্মবিদ্যায় বিশাল অবদান রেখে গিয়েছেন। তাঁর নিজস্ব প্রকাশিত একটি প্রত্নজীবাশ্মবিদ্যা ভিত্তিক প্রকাশনাও ছিল। অ্যানিং বাবার কাছ থেকে ফসিল অনুসন্ধান শিক্ষা নিয়েছিলেন। ১১ বছর বয়সে একদিন তিনি সমতল পাথরের ঢাকা একটি স্থানকে সন্দেহ পোষণ করায় তাকে হ্যামার দিয়ে খনন শুরু করেন। কয়েক সপ্তাহ চেষ্টার পর ৪ ফুট লম্বা একটি মুখমণ্ডল বের হয়। তিনি উড়ন্ত সরিসৃপ (Plesiosaurus) জাতীয় প্রাণীর জীবাশ্ম আবিষ্কার করেছিলেন।

অষ্টাদশ শতাব্দীর এক অপ্রতিরোধ্য নারী ছিলেন গণিতবিদ সোফি জার্মেইন। রোমান সৈনিকের হাতে মহাগণিতজ্ঞ আর্কিমিডিসের মৃত্যুর কাহিনী পড়েই এ আগ্রহের সূচনা হয়। শুধুমাত্র একজন নারী হবার কারণে সংখ্যাতত্ত্ব এবং গাণিতিক পদার্থবিদ্যায় তার কোনো কৃতিত্বই তাকে দেয়া হয় নি। সোফিকে মূলতঃ স্মরণ করা হয় তাঁর সংখ্যাতত্ত্বের জন্য, কিন্তু স্থিতিস্থাপকতা সূত্রের ক্ষেত্রেও গণিতে তাঁর অবদান যথেষ্ট গুরুত্ববহ। ১৮৩১ সালে গণিতিবিদ গস এর সুপারিশের ফলে গোয়েটিংগেন বিশ্ববিদ্যালয় যখন তাকে প্রথম ডক্টরেট ডিগ্রি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তার আগেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

গণিতবিদ এমি নোয়েথার জার্মানির গোয়েটিংগেন বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্বের উপর তিনি যে কাজ করেন তা এখনও নোয়েথারের তত্ত্ব নামে পরিচিত। তিনি গোয়েটিংগেনে দীর্ঘদিন বিনা বেতনে নামমাত্র সহযোগী অধ্যাপনার কাজ করেন শুধুমাত্র একজন নারী ছিলেন বলে। এরপর ১৯০৭ সালে তিনি গণিতে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯১৮ সালে তিনি দুটো উপপাদ্য প্রমাণ করেন, যা সাধারণ আপেক্ষিকতা এবং মৌলিক কণা-পদার্থবিজ্ঞানের মূল বিষয় ছিল। যেগুলোর একটি এখনও নোয়েথারের উপপাদ্য নামে পরিচিত। প্রচণ্ড লিঙ্গ-বৈষম্যের কারণে গোয়েটিংগেন বিশ্ববিদ্যালয়ে নিযুক্ত হতে পারেননি। ১৯৩০ সালে ফ্রাঙ্কফুর্টে শিক্ষকতা করেন। ১৯৩২ সালে জুরিখে আন্তর্জাতিক গণিত কংগ্রেস একটি পূর্ণাঙ্গ বক্তৃতা দেন। একই বছর তাঁকে গণিতের উপর একটি সম্মানজনক পুরস্কার ‘একারম্যান-টিউনার মেমোরিয়াল পুরস্কার প্রদান করা হয়।

প্রথম আমেরিকান হিসেবে রজার আরলিনার ইয়ং প্রাণিবিদ্যায় ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেছিলেন। এই প্রাণীবিদকে সারাজীবনই সংগ্রাম করতে হয়েছে। হাওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণী বিজ্ঞান বিভাগের আর্নেস্ট এভারেট জাস্ট এবং তিনি সামুদ্রিক প্রাণীর প্রজনন প্রক্রিয়া এবং হাইড্রেশন, ডিহাইড্রেশনের উপরও গবেষণা করেন। এ ব্যাপারে এতোই দক্ষতা অর্জন করেছিলেন যে জাস্ট তাকে প্রাণী বিজ্ঞানের একজন সত্যিকারের প্রতিভা বলে চিহ্নিত করেন। পরবর্তীতে জাস্ট এর সঙ্গে তার সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তিনি মারা যান দরিদ্র ও নিঃসঙ্গ অবস্থায়।

এরকম আরো বহু নারীবিজ্ঞানী আছেন যারা বিজ্ঞানে অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছেন। কয়েকজনের নাম আমরা জানি, ইতিহাসবেত্তাদের কলমের খোঁচায় যে ইতিহাস রচিত হয় সেখানে বহু নারী রয়ে গেছে পাদপ্রদীপের আড়ালে। নারীকে প্রতিনিয়ত প্রমাণ করতে হয়েছে যে দুর্বল নয়, কোনভাবেই পুরুষের চেয়ে কম জ্ঞানী নয়। তবুও তা মেনে নিতে নারাজ এ পিতৃতান্ত্রিক সমাজ।

আমাদের দেশের বাবা-মায়ের কন্যাসন্তানের প্রতি প্রথম বক্তব্য থাকে- ‘কমার্স বা আর্টস নাও। সায়েন্স নিয়ে কুলাতে পারবে?’ ধরেই নেয়া হয় মেয়েরা বিজ্ঞান পড়ার জন্য উপযুক্ত নয়। অথচ আমরা কি কম্পিউটারবিজ্ঞানী তানজিমা হাশেমের কথা জানি যিনি ২০১৭ সালের ওডব্লিউএসডি-এলসেভিয়ার ফাউন্ডেশন পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন পেয়েছেন। বুয়েটের শিক্ষক তানজিমা হাশেম মানুষের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা সুরক্ষার কম্পিউটারনির্ভর একটি উপায় বের করেছেন। আমরা ডক্টর ফেরদৌসি কাদরির কথা কয়জন জানি? সংক্রামক রোগ ও ভ্যাকসিন নিয়ে গবেষণায় আন্তর্জাতিক খ্যাতি রয়েছে তার। ২০১২ সালে ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ডায়রিয়াল ডিজিজ রিসার্চ বাংলাদেশ বা আইসিডিডিআরবি’র শ্রেষ্ঠ নারী কর্মীর স্বীকৃতি পান তিনি।

পিতৃতন্ত্র গ্রাস করেছে এ সমাজকে যেখানে নারী হচ্ছে দুর্বল, কম জ্ঞানী কিংবা নারীর কাজ হচ্ছে সন্তান উৎপাদন, ঘরসংসার দেখাশোনা করা। নারী হচ্ছে প্রকৃতি যেখানে পুরুষকে ধরা হচ্ছে সংস্কৃতি। আর প্রকৃতিকে জয় করে বশে এনেই এ মানবসভ্যতা রচিত হয়েছে, তারমানে ধারণা করা হয় নারী পুরুষের ক্ষমতার অধীনে থাকবে। অথচ নারীরা ইতিমধ্যে প্রমাণ করেছে যে ‘নারী পুরুষের অধীন, নারী দুর্বল’ এটা ধ্রুবসত্য নয়, এটা এ সমাজের বানানো সত্য। নারীদের নিজেদের দক্ষতার প্রমাণ নিজেদের দিতে হবে। আর এজন্য যে কঠিন পথ পাড়ি দিতে হবে সে পথকে অসম্ভব মনে করবার কোন কারণ নেই, আমাদের পূর্বসুরীরা সে প্রমাণ দিয়ে গেছেন। এখন শুধু শক্ত পায়ের হাঁটার সময়, শক্ত হাতে মোকাবিলা করার সময়।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.