দেয়াল ও নিঃসঙ্গতম নাইজেল

প্রজ্ঞা মৌসুমী:

শেফালীর মা—শেফালী ফুলের মতো ঝরে গেছে যার নিজের নামটুকুন। নদীর ভাঙ্গনে যেমন গুড়িয়ে যায় পাড়ের ইতিহাস। বিয়েও যেনবা এক নদীর ভাঙ্গন যে ভাঙনে গুড়িয়ে যায় পেছনের কতো নাম, ঠিকানা, কতো পুরনো আয়না। বহতা সংসারের মুখরতায় খোলক আর খোলসের পার্থক্য উপচে হয়ে উঠে যারা শাহজালালের মা, খোকনের মা, ঊষা রাণীর ছোটমা, হুমায়ুনের বউ, ছোট বউ, বৌদি- শেফালীর মা ওদেরই একজন।

সেই কবে নোলক দুলানো একরত্তি বউকে নিয়ে পা দিয়েছিল বাড়ির উঠোনে রমিজ হালদারের ভালো করে যেন মনেও পড়ে না। স্মৃতিরা বুঝিবা ডুবেছে কচি হেমলকের ঘোরে। যে ঘ্রাণ বুকে নিয়ে কেটে গেছে বারো হাজার রাত, সেই চেনা অভ্যস্ত গন্ধটাই হারিয়ে গেছে কোন সময়ের দরজায়! বাড়ি ফেরার পথে দেওয়ান বাড়ির দেয়ালের ওপাশের গাছটাকে কোনদিন না দেখেই ও যেমন বুঝে নিত কামিনীর ঘ্রাণ। গাছটা কেটে ফেলার পরও কতো বিকেলের অভ্যস্ততা খুঁজে গেছে সেই ঘ্রাণ। তবু ঠিকঠাক আজও মনে করতে পারে না কেমন হয় কামিনীর গন্ধ। স্মৃতিকাতরতা নিয়ে কেবল ভেবেছে- এখানে একদিন কামিনীর গন্ধ ছিল।

সময় যাযাবর হয়, জানি। তবু তো কখনো সখনো ফেরে তার শ্বাস। উটপাখি না হোক, এক রত্তি দীর্ঘশ্বাসের মতো। হয়তো তাই হুহু করা বাতাসের মতো হঠাৎ হঠাৎ বয়ে যায় শেফালীর মা- একটা নাকছাবি হয়ে, শেফালীর ভ্রুতে, সেঝ ছেলের ঝর্ণার মতো কাটা দাগে, কোন পান খাওয়া ঠোঁটে, ছোট মেয়ে কুসুমের আধ খোপা, চাল ধোঁয়া হাতে… ডিম দেয়ার আগে মুরগী যেমন তড়পায়, অস্থির হয়। তেমনই উলোটপালট অস্থিরতায় রমিজ হালদার চিহ্ন খুঁজে। তোফারয়া বানুর সব সহ্য হয়, সহ্য হতে চায় না পুরনো চিহ্নের খোঁজ, শোক। সেখানে পুড়ে যাওয়া ছালুনের মতোই কাতরায় কৃতজ্ঞতাবোধ।

মাস খানেকের বিরহ রমিজ হালদারকে শিখিয়েছে- একেবারে ভেঙে পড়ার চেয়ে নড়বড়ে থাকাতেই স্বস্তি। তাই খুঁজে নেয় বধুয়ার ঘ্রাণ। আরও একবার। আর তোফারয়া বানু খুঁজে নেয় মাতৃত্বের স্বাদ না পাওয়ার সান্ত্বনা। বাঁজা বলেই না বড়ো অবেলায় পেয়েছে এমন ভরা সংসার। সারেং বাড়ির মেয়ে সে। ও জানে কী করে বয়ে যেতে হয় উজানে, ঝড়ে। সারেং বাড়ির মেয়ে বলেই ও বেপরোয়া নয়, বড়ো সাবধানী। হয়তো তাই দেয়ালে টাঙানো শেফালীর মায়ের একমাত্র ছবিটাকেও ওর এত ঈর্ষা, এতটা ভয়। উপড়ে নেয়া কামিনী গাছটার মতোই দেয়ালের ছবি হারিয়ে যায়। ছেড়ে যায় স্থান।

সত্যিই কী দেয়ালের কছে প্রতারিত আমরা? তবে কেন সেকান্দরের মনে পড়ে সেই বিভোর শুভ বিবাহের সন্ধ্যায়, নজর কাটাতে পাড়ার দেবররা থুথু ছিটানোটা ত্যাক্ততার পর্যায় নিয়ে গেলে, কনেবৌয়ের ভ্রু কুচকে বিরক্তি প্রকাশের দুঃসাহস! সেদিনই ও বলেছিল- বউটার বড়ো জেদ। এ বাড়িতে শেফালীর মায়ের কাটানো বারো হাজার রাতের পর এই কথাই কি ভাবিনি আমরা? দুটো দাঁত ভেঙে ফেলেও যে দুপুরে কিছুতেই শেফালীর মায়ের মুখ খুলানো যায়নি। হয়তো দেয়ালের কাছে সবটাই হেরে যায়নি শেফালীর মা।

তাই আমাদের আজও মনে পড়ে শিমুল গাছের চারপাশে কতো হৈচৈ -কোনদিন নামাজ কাজা করতে দেখি নাই বউটারে, বড়ো পরহেজগার ছিল, জানাজা পড়াইতে কোন মৌলানাই রাজি না, ফোরে পড়ে মেয়েরে দিয়া ইদুর মারার বিষ কিনি আনাইছে, আজমল দোকানীর কাছে ভাবীর হাতের লেখা চিরকুট আছে… ছোট ছেলে কাঁদে- আমারে ক্ষমা করো, আমি জিদ না করলে তোমাদের ঝগড়া হইতো না… রমিজ হালদার তড়পায়- আহারে আমি তো বলছিলাম ফিরা আসি যেন না দেখি তোরে, না দেখি।

কত অনুতাপে, জলের ভারে ভারী হয়েছিল সেদিনের মেঘবতী দুপুর। আর উঠোনে, আহা, পড়ে থাকা শেফালীর মা। যেন পৃথিবীর সেই নিঃসঙ্গতম পাখি নাইজেল, যাকে ঘিরে ছিল আশিটা পাথরের পাখি। পাড়া জুড়ে কতো মুর্তার পাতা তবু একটা পাটিও জুটেনি ওর। বত্রিশ বছরের নিবেদিত সংসার শেষে ঝড়ে পড়া কুসুম। চোখের কোণে পৃথিবীর শেষ জল নিয়ে বলেছিল- আমি আর পারি না, আর পারি না।

ঠিক এখানেই ত্রিশূলের মতো মনে পড়ে আমাদের হলসুপার সুমাইয়া আপাকে। কতোগুলো নাইট্রাজেপাম খেয়ে-টেয়ে সবাইকে অস্থির করে মিথুন যেদিন হাসপাতাল থেকে ফেরে, আপা ওর হাত ছুঁয়ে বলেছিল- ভালোবাসা ন্যাপথালিনের গুটির মতো। সম্পর্ককে যত্নে রাখে বটে। তবে হাওয়ায় উবে যাওয়ারও সম্ভাবনা থাকে।

শোনো মেয়ে, মরে গেলে তোমার বর কোনদিন বিয়েই করবে না এইটা যদি কনফিডেন্টলি বলতেই না পারো, তো সংসার সংসার করে না মরে, কখনো সখনো শুধু নিজের জন্যও বেঁচে থেকো। বেঁচে থেকো একান্ত কোন গোপন স্বপ্নের জন্য।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.