রাগকে প্রশ্রয় না দিয়ে বরং কারণটা খুঁজে নিন

কাশফী জামান শ্যামা:

বেশকিছু বছর আগে, ইয়েল ইউনিভার্সিটির সাইকোলজির টিচার ‘স্টানলি মিলগ্রাম’ Behavioural Psychology (আচরণগত সাইকোলজি) উপর সম্ভবত সবচেয়ে কুখ্যাত এবং পরবর্তিতে সব থেকে কার্যকরি পরীক্ষা করেছিলেন। এক্সপেরিমেন্টটাতে ৪০ জন ব্যক্তি অথবা সাবজেক্ট বেছে নেয়া হয়েছিল। তাদের উপর আদেশ ছিল, তারা তাদের প্রতিনিধির নির্দেশ পালন করবেন, তা সে নির্দেশ যতই খারাপ হোক, কিম্বা অদ্ভুত হোক। সাফল্যের সাথে সমাধানকারীরা বেনিফিটেড হবেন এই অঙ্গিকারও করা হয়।

এক্সপেরিমেন্টে প্রতি সাবজেক্টকে ১৫০ থেকে সর্বোচ্চ ৪৫০ ভোল্টের ১৫টা সুইচ বোর্ডের কন্ট্রোল দেয়া হয়। তাদের প্রত্যেককে আলাদাভাবে বলা হয় তাদের সামনে বসা ১০ ব্যক্তিকে পূর্বে প্রস্তুতকৃত প্রশ্ন করতে, এবং প্রতি ভুল উত্তরের জন্য একটা করে ইলেক্টিক শক দিতে, প্রতি ভুলের জন্য শকের মাত্রা বাড়বে।

এক্সপেরিমেন্ট এর একটা পর্যায় ভিক্টিমদের আকুতি, আর্তনাদে সাবজেক্টরা পরীক্ষা অব্যাহত রাখতে অসম্মতি জানাবে বলে আশংকা করা হলেও, শর্ত অনুযায়ী তাদের পরীক্ষা চালিয়ে যেতে হবে বলে ঠিক করা হয়।

৩৯ জনের একদল সাইকোলজিস্ট আগেই অনুমান করেছিলেন ৮০% সাবজেক্ট ১৫০-২০০ ভোল্টের বেশি শক দিতে পারবেন না, আর ৩০০ ভোল্টের বেশি শক দেয়া হবে না পুরো পরীক্ষায় সেটা ছিল অনুমিত।

কিন্তু তাদের একেবারে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে ৮৫% সাবজেক্ট ৪৫০ ভোল্টের শক দেয়।

মনোবিজ্ঞানীদের নিরিক্ষা মতে এখানে কয়েকটি ফ্যাক্টর কাজ করেছিলো,
# সাফল্য পাওয়ার মনোভাব -২০%
# আদেশ পালনের ইচ্ছাপোষণ- ২৮%
# স্বভাবজাত নিষ্ঠুরতা – ৪১%
# ট্রমার শিকার- ১০%

প্রশ্ন আসতেই পারে, আসলেই কি আমরা অন্যের কষ্টে আনন্দ পাই?
উত্তর হলো- না।
তবে, ন্যাচার (স্বভাব) এবং নার্চার (শিক্ষা গ্রহণ) দুটো জিনিসই আমাদের প্রতিকূলে যেতে পারে যদি না পারিপার্শ্বিকতা সুস্থতাপূর্ণ হয়।

সাধারণ মানুষও হঠাৎ করে ক্ষিপ্ত হয়ে যা তা করে ফেলতে পারেন। এভাবে গৃহনির্যাতনের মতো ঘটনা ঘটে যায়। কেউ অস্ত্র নিয়ে কারো ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। দিনরাত নিয়মের মধ্যে থাকা মানুষও হঠাৎ বেসামাল, বোহেমিয়ান, হিংস্র হয়ে উঠতে পারে। নিউরোলজিস্ট ডগলাস ফিল্ডস মস্তিষ্কের এ আচরণকে বলেন স্ন্যাপিং। কিন্তু এমনটা কেন এবং কীভাবে ঘটে?

এর গতানুগতিক বিশ্লেষণে বলা হয়, নৈতিকতা এবং মানসিক সমস্যার কারণে আকস্মিকভাবে আচরণে ছন্দপতন ঘটে। আমরা কেন এমন ক্ষিপ্ত হয়ে উঠি? কেন বেঠিক, ভুল জেনেও ঠিক সেই রাস্তায় হাঁটি? কেনই’বা মবে উম্মাদ হয়ে পড়ি? মস্তিষ্কের একটি অংশ এর সার্কিট হয়ে কাজ করে।

গবেষণায় বলা হয়, উগ্র আচরণ মূলত আধুনিক জীবন এবং মস্তিষ্কের হার্ডওয়্যারের বিবর্তনের সংঘর্ষের কারণেই ঘটে থাকে। এটা বিস্ফারিত হয়। এর ট্রিগার না খুঁজে পেলে নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়।

এ ধরনের আচরণের সঙ্গে জড়িত থাকে নয়টি ট্রিগার। এদের একযোগে বলে লাইফমোর্টস (LIFEMORTS- “LIFEMORTS,” which also refers to the first trigger: Life and Death (“morts” is the French word for death) situations.)

এখানে আদ্যক্ষের নানা অর্থ রয়েছে। যেমন-
L- লাইফ বা অঙ্গ যা আত্মরক্ষার প্রয়োজনে প্রতিক্রিয়াশীল হয়।
I- ইনসাল্ট বা অপমানজনক অবস্থা। সামাজিক অবস্থানে কেউ অবমাননাকর অবস্থানে পড়লে সম্মান বাঁচাতে আগ্রাসী হয়ে ওঠে।
একইভাবে,
F – Family: পারিবারিক কারণে
E – Environment : পারিপার্শ্বিকতা
M – Mate : সংগদোষে
O – Organization: প্রাতিষ্ঠানিক প্রভাবে
R – Resources: আর্থিক কারণে
T – Tribe/“Us and Them” Mentality, S – Stop – Being Trapped, Restrained or Cornered: কোণঠাসা হয়ে পড়লে।

খেয়াল করুন, T- ট্রাইব বা গোত্র বোঝায়। মানুষ মারাত্মকভাবে গোত্রভুক্ত প্রাণী। এটা মস্তিষ্কে ঢুকে গেলেই অন্য গোত্রকে হুমকি বলে মনে হয়। এ জন্যে নিজের গোত্রকে রক্ষা করতে মানুষ হিংস্র হয়ে ওঠে।

আধুনিক গবেষণা নিউরনের নানা নতুন তথ্য খুঁজে পেয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত পরিষ্কার নয় যে গোটা বিষয়টি কিভাবে পরিচালিত হয়। হিংস্রতা ফুটে ওঠার আগে মস্তিষ্কে কি কি এবং কতটুকু তথ্য ধারণ করলো তা বুঝতে পারলে বিষয়টি আরো পরিষ্কার হবে।

আধুনিক জীবনে পরিবেশ ও সমাজের কাঠামো বদলে গেছে। এদের সঙ্গে মানিয়ে মস্তিষ্ক ক্ষোভের সৃষ্টি করে। অথচ এক লাখ বছর আগে মানুষের যে মস্তিষ্ক ছিল, তেমনটা আজো আছে। শুধু পরিবেশ এবং পরিস্থিতিভেদে ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় মস্তিষ্কের বিশেষ অংশে হিংস্রতা সৃষ্টি হয়। আধুনিক যুগে নানা কারণে এ অবস্থার পরিমাণ বেড়েই চলছে।

ক্ষোভ এবং আক্রোশ মস্তিষ্কের ছোট অংশের নিউরনের খেলা, যেখানে চেতন মনের চিন্তা-ভাবনা নাক গলাতে পারে না। পৃথিবীর সব প্রাণীরই তার জীবনের হুমকি বোঝার ক্ষমতা রয়েছে মস্তিষ্কে। এই সার্কিট অনবরত আমাদের অভ্যন্তরীণ এবং বহির্মুখী হুমকি খোঁজার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এটা এতোটাই ধীর পদ্ধতি যে তা সহজে বোঝা যায় না। চেতনা তৈরি হয় মস্তিষ্কের গভীরের অংশে, যার নাম হাইপোথ্যালামেটিক অ্যাটাক রিজিয়ন। এই অংশটি আত্মরক্ষা বা আগ্রাসী মনোভাব নিয়ন্ত্রণে কাজ করে। এইজন্য ছাপোষা নিরীহ-আপাদমস্তক ভদ্রলোকও সামান্য কারণে দেখিয়ে দিতে পারেন ‘সুপারম্যান -সুপারহিরোর’ মতো ভেল্কি! আচমকা হয়ে উঠতে পারেন ছোট খাটো একজন র‌্যাম্বো।

আধুনিক পশ্চিমা শিক্ষিত ছেলে-মেয়েরা যখন আইএস-এর মতো জঙ্গিগোষ্ঠিতে যোগ দেয়, তখন নিউরন কিভাবে কাজ করে? এটা আসলে বর্তমান সমাজে খাপ খাইয়ে নিতে না পারার ক্ষোভ থেকে ঘটছে। তারা এমন এক সমাজ বা দলে চলে যাচ্ছেন যা তাদের মনমতো গ্রহণ করে নিচ্ছেন। এভাবনে নিউরোসায়েন্স এবং সন্ত্রাসবাদ এক হয়ে যেতে পারে।

এক্ষেত্রে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে শিশু এবং কিশোর সমাজ। কারণ লজিক, সায়েন্স এবং সাইকোলজির ভাষার বাইরে আজকাল আমাদের বাচ্চারা কিছু পারিপার্শ্বিক প্রভাবের শিকার হচ্ছে,

যেমন:

১. পড়ালেখার বাইরে অন্য কোনো জগৎ না থাকায় শিশু-কিশোররা আসক্ত হয়ে যাচ্ছে ইন্টারনেটে। তারা এখন দিনের বেশির ভাগ সময় কাটায় মোবাইল ফোন, ট্যাব ও কম্পিউটার নিয়ে। কিশোর বয়স অথচ ইন্টারনেট ব্যবহার করে না এমন কাউকে খুঁজে পাওয়াই কষ্টকর। তথ্যপ্রযুক্তির এই অবাধ সুযোগ নিয়ে কিশোরদের বেশির ভাগই বিপথে যাচ্ছে। অনেকেই আসক্ত হচ্ছে পর্নোগ্রাফিতে। অনেকেই মক্ত হয়ে পড়ছে ভায়োলেন্স আর রক্তারক্তি ভরা নিষ্ঠুর ভার্চুয়াল দুনিয়ায়।

২. শিশু-কিশোরদের খেলাধুলা ও সংস্কৃতিচর্চার সুযোগ তেমন একটা নেই এখন। অভিভাবকদের কাছ থেকেও অনেক সময় তারা বন্ধুসুলভ আচরণ পায় না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও এখন নৈতিক শিক্ষার বড় অভাব। ফলে বিপথে যাচ্ছে কিশোররা।

৩. অনিয়ন্ত্রিত চাহিদার কারণেই কিশোর বয়সীরা হিংস্র হয়ে উঠছে। অনেক ক্ষেত্রে হিংস্রতা এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে সন্তানরা মা-বাবাকেও হত্যা করতে দ্বিধা করছে না। বিশেষ করে পারিবারিক পরিবেশ যদি খারাপ হয়, পরিবারে মারামারি-হানাহানি, ডিভোর্সের মতো ঘটনা থাকে, তাহলে সেই পরিবারের বাচ্চারা বেশি ঝুঁকিতে থাকে। আর যারা মাদকাসক্ত তারাও ধ্বংসাত্মক প্রবৃত্তিতে লিপ্ত হয়। নিষ্ঠুর, নির্মম হয়ে ওঠে তারা। সাধারণ তুচ্ছ ঘটনায় তাদের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়।

সন্তানদের মধ্যে, এমনকি নিজের মধ্যে যখন এমন আগ্রাসী অবস্থার সৃষ্টি হবে তখন বুঝতে হবে, LIFEMORTS ট্রিগারগুলোর মধ্যে কোনটি বাচ্চাদের অথবা আপনার মধ্যে কাজ করছে। প্রথমত, আপনি হয়তো এমন এক অবস্থায় আছেন যেখানে আপনার মাঝে খুনে মানসিকতা সৃষ্টি হতে পারে। দ্বিতীয়ত, এটা ভুল হয়ে গেছে। নিজের ভুল বুঝে পিছে হটে আসুন।

ভাবুন রগরগে বিছানার কোন দৃশ্যপট, অথবা পর্দায় সাজানো নায়কের হিরোচিত ঢিশুম-ঢুশুম দেখে, মনটাকে বলেনা পায়ের কাছে পড়ে থাকা ইটের নুড়ি’টারে এক লাত্থিতে চাঁদে পাঠিয়ে দেই! এই অনুভূতি’টাই রাক্ষসের বাচ্চা বেলা, এর মাত্রাতীত প্রকোপের ফলাফল হতে পারে সাধারণের জীবনে হিংস্রতা!

অনেক ক্ষেত্রে হতাশা ও মানসিক চাপ স্ন্যাপিং-এর কারণ হতে পারে। তাই এর জন্যে প্রস্তুত থাকতে হবে। বুঝতে হবে, নিজেকে মোটিভেট করতে হবে এবং নিজেকে আলাদা পথে এগিয়ে নিতে হবে।

মনোবিজ্ঞানী ডঃ ডগলাস ফিল্ডের চমৎকার একটা উক্তি দিয়ে শেষ করছি,
“Once you can recognize why you are angry, rather than suppress it, suddenly it goes away. Suddenly it’s disarmed. It’s a misfire”

#সারকথা: রাগকে প্রশ্রয় না দিয়ে রাগের কারণ খুঁজে নিলে, রাগের আগুনে এক বালতি পানি ঢেলে দেয়া হয়; এতে জীবনের আনন্দধারা অব্যাহত থাকবে, এই কামনা করা খুব একটা ভুল হবে না।
সবাইকে ভালবাসা।

তথ্যসূত্র:
# Simply Psychology – The Milgram Experiment.
# Psychology Today
# Jan Dizon: Time Techs
# কালের কন্ঠ

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.