আসমা খুশবু:
চেনা সকাল, চেনা পথ। কফির ম ম গন্ধ চারদিকে। ব্যস্ত মানুষের কেউ কারও দিকে ফিরে তাকাবারও সময় নেই। একমাত্র আমিই বোধহয় ধীরে চলছি, কোনও তাড়া নেই। একদম গুণে গুণে সাড়ে চার বছর!
একদিনের জন্যও সকালটা ভিন্ন রূপ নিয়ে আসেনি। তাই আজ ট্রেনে একা যাবার সুযোগ আসলে টুপ করে সুযোগ নিয়ে নেওয়া। পরিচিত পথে চলতে গিয়ে কেমন অস্বস্তি। অনেক দিনের অনভ্যস্ততাই বোধহয় দায়ী। কিছুক্ষন পরেই সব স্বাভাবিক। ফ্রি ম্যাগাজিনের পাতা উল্টে চোখ আটকে গেল লন্ডনের মেয়রের একটি সাক্ষাৎকারে, ‘আমার ভালো লাগুক আর না লাগুক, আমি মনে রাখি আমি এ শহরের রোল মডেল’। খুব ছোট্ট কথা কিন্তু একজন রাজনীতিবিদের আইডিওলজি।
ট্রেন ছুটে চলে। আমি জানি আমি কোথায় নামবো। হঠাৎ মনে পড়ে চাবি রয়ে গেছে ভদ্রলোকের গাড়িতে। তা থাক, বাড়ি ফিরবো না আপাতত এটাই সিদ্ধান্ত। ট্রেন থেকে নেমে হেঁটে চলেছি আরেক ট্রেনের জন্য। কত চেনা পথ! কত স্মৃতি এই পথ জুড়ে। এস্কেলেটরের মাথায় এসে তিনজন ভারতীয় মেয়ে নজর কাড়ে। তারা পথ হারিয়েছে! ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজিতে পথের ডিরেকশান জানতে চাচ্ছে ইনফরমেশন ডেস্কে।
মুহূর্তে দশ বছর পেছনে চলে গেলাম।
এপথে হারাবার গল্প যে আমারও আছে!
ট্রেন ধরে জুত করে বসে মানুষ দেখি। ঠিক উল্টো পাশে বসে ছোট্ট রোমানিয়ান মেয়ে আর বাবা। নিজেদের মধ্যে কথা বলছে আর হাসছে। আমিও হাসি নিজের সমবয়সী কন্যাদের কথা ভেবে। বাবাটি কথা বলে ওঠে আমায় উদ্দেশ্য করে, ‘সময় পাই না জানো, আজ একটু সময় পেয়ে মেয়েকে নিয়ে ঘুরতে বেড়িয়েছি। দিস কান্ট্রি ইজ কিলিং মি। কাজ, কাজ আর কাজ। এ জীবন চাইনি। আই ওয়ান্ট টু গো ব্যাক’। মানুষটার চোখে পানি টলমল করে। ফোনটি আমার হাতে দিয়ে বলে, ‘একটি ছবি তুলে দাও, আগামী বছর মেয়েটা বড় হয়ে যাবে’। ছবি তুলে ফোনটি ফেরত দিয়ে শুধু এটুকুই বলি, ‘কেঁদো না, দিনশেষে তুমি তোমার পরিবারকে ভালোবেসে এ জীবন বেছে নিয়েছো। কাজেই এভাবেই ভালো থাকো’।
তাকে যা বলতে পারিনি, আমাদের সব ইমিগ্রান্টদের গল্পগুলো কমবেশি একই, হৃদয়ের ক্ষরণ কেউ টের পায় না!
বাতাসে শুধু নেই নেই গন্ধ। চড়া রোদে বুকের ভেতর বিশাল শূন্যতা। এ শহর আমার নয়, এ চেনা পথ আমায় আর টানে না, আমি আমার শহরে যাবো! যেখানে ধুলো মেখে ক্লান্ত হবো, বাতাসে ঘামের গন্ধ ভেসে বেড়াবে, মানুষে মানুষে গায়ে গা লাগিয়ে চলে যেখানে, বড্ড ভেদাভেদ সেখানে, তবুতো আমারই আপন শহর, আমি সেখানেই যাবো!!