শুধুই নিজেকে ভালবাসি বলে …

শায়লা হক তানজু:

একটা সময় ভালোবাসতে চেয়েছিলাম ভীষণ করে, কী কাঙ্গালপনাই না ছিলো সেই চাওয়ার মাঝে, কত রাত তোমার একটু মনোযোগ পাওয়ার জন্যে সারারাত তোমার ল্যাপটপের অন্য প্রান্তে বসে থাকতাম, কত রাত আর সন্ধ্যা রাস্তার দিকে তাকিয়ে রাতের সাথে পাল্লা দিয়ে ভোরের প্রতিক্ষায় কাটিয়েছে, সে হিসাব শুধু কারেন্টের তারে বসা বাদুররা জানে।

কত সন্ধ্যা শাড়িতে, টিপে, ঠোঁটের রং এ নিজেকে সেই প্রথম তোমার চোখে দেখা মুগ্ধতায় মুগ্ধ আমি নিজেকে সাজাতাম, রিকশায় একটু ঘোরা, হাত ছুঁয়ে শহরময় হেঁটে বেড়ানো, বেলী বা কদম কেনা, ফুচকা বা চাওমিন খাওয়ার লোভ, এইতো ছিলো আমার সন্ধ্যাগুলোর চাওয়া।

গরম ভাত, মাছের ঝোল, পাট শাকের ভাজি, পরোটারাও জানতো কী ভালোবাসা আর মমতা ছিলো আমার তোমার জন্যে, সকালে ঘুম ভেঙ্গে তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতাম, কপালে আলতো চুমু খেতাম। কতদিন, কতরাত তুমি কখনই আমার ছিলে না জানার পরও আমি অবচেতন মনেও অন্য কাউকে চুমু খেতে পারিনি। তুমি যখন অন্য কারো শরীরে মত্ত, তখনো আমি তোমার কাপড়ের গন্ধ শুকতাম। কোন কারণ ছাড়াই আমি তোমার কাছে পৌঁছাতে চেয়েছিলাম, অর্থ, শরীর, মন, সমাজ সবভাবেই। আমি কোনদিনও রাস্তাই খুঁজে পাইনি।

আজ যখন কেউ ঠিক আমার সেই ছেলেমানুষী পাগলামো নিয়ে আমাকে ভালোবাসতে চায়, কেউ আমার মতো করে আমার হতে চায়, কেউ আমার জন্মদিনে কেক নিয়ে আসে দূর থেকে, আমার ঘর গুছিয়ে দিতে চায়, শুধু আমাকে দেখার জন্যে কাকুতি করে, আমার নির্লিপ্ততা, বিষন্নতা, বিরক্তি, রাগ, উপেক্ষা কে উপেক্ষা করে সে আমার কাছে আসতে চায়, কিন্তু কী আশ্চর্য শীতল এই আমি, কোন ছটফটানি নেই, কোলাহল টানে না।

আমার নৈঋত নৈ:শব্দ শূন্য আমিত্বকে বড্ড ভালোবাসি আমি। আমার আজ কিছু পাওয়ারও নেই, হারানোরও নেই। সব হারিয়ে আমি আজ ভীষণ রকম পূর্ণ, বাইরের পৃথিবী আমার দুঃখ বা সুখ কোনটারই উৎস না। আমি আমাতে মগ্ন নার্সিসিস্ট। আজ যখন কেউ আমার সাথে ভোর দেখতে চায়, পূর্ণিমা, সমুদ্র, বরফ আর মরুভূমি দেখতে চায়, আমার ভয় লাগে, আমি তোমাকে ছেড়ে এসেছিলাম তোমায় ভালোবাসতাম না বলে নয়, আমি নিজেকে ভালোবাসতাম বলে। আমি আমার নিজেকে আর হারাতে চাই না। কিন্তু বড্ড ভারী লাগে এ মৃত হৃদয়ের ভার, যে হৃদয় ভালোবাসায় শিহরিত হয় না, প্রেমে ওলট পালট হয় না, কামে আর্দ্র হয় না, সেতো মৃত।

আজ আর আমার কোনো অভিযোগ নেই কেন ভালোবাসলে না বলে, কেন অন্তঃসত্ত্বা আমাকে ঠকিয়েছিলে, কেন বর্ষাদেখা সন্ধ্যাগুলোকে বিষাক্ত করেছিলে বলে, আমি বরং কৃতজ্ঞ, যে আজন্ম বিদ্রোহী, নিয়ম ভাংগা মন আমার পোষ মানতে চেয়েছিলো, লাল সুতীর ঢাকাই শাড়িতে একটা আটপৌড়ে বৌ হতে চেয়েছিলো, আদুরে, সলজ্জ বৌ, সে আজ দিগন্ত ছুঁয়েছে। ছোট পাহাড়ের গ্রাম থেকে আসা গেঁয়ো মেয়েটা অত বড় ব্যস্ত শহরে একা একা রাস্তা পেরোতেও ভয় পেতো গাড়ি যেদিক থেকে আসতো সে পাশটায় দাঁড়িয়ে হাত ধরে রাস্তা পার করিয়ে দিতে। আজ সে বড় বড় লরি ঠেলে দৌড়ায়। অল্প অল্প টাকা জমিয়ে বাসন কোসন, হাঁড়ি পাতিল, পর্দা, বা বিছানার ছাদর, পছন্দের ডাইনিং কেনা ছিলো যার চূড়ান্ত শখ, আজ সে চাইলে মাসে ওরকম চার পাঁচটা ডাইনিং আর এক ঘর হাঁড়ি পাতিল কিনতে পারে, ওসব দেখলে তার হাসি পায়, জীবন থেকে নতুন করে পাওয়ার বা হারানোর কিছু নেই।

অভিযোগ শুধুই একটা, আমি আর কাউকে ভালোবাসতে পারি না, সেটা তোমায় ভালোবাসি বলে না, সেটা আমি নিজেকে ভালোবাসি বলে, নিজেকে শেয়ার করতে, নিজের স্পেস শেয়ার করতে ভয় পাই বলে, আমি কৃতঘ্ন প্রতারক কুৎসিত যৌনকাতর মনহীন পুরুষ দেখেছি বলে। এ জীবনে বাবা, মামা, চাচা, নানা, শিক্ষক রূপী পুরুষদের আমি যৌনকাতর আত্মাহীন নোংরা রূপ দেখে ফেলেছি। তুমিও বলতে তোমার নাম ছাড়া সমাজে ঠিকতে পারবো না। আমি দিব্যি টিকে আছি, মন্দ মেয়ের উপাধি নিয়ে কিন্তু বেঁচে বর্তে আছি। আমি আমারই নাম গাই আজ।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.