গোধূলী খান:
প্রধানমন্ত্রী!
“আপনি চাকরি করেন, আপনার মাইনে দেয় ওই গরীব কৃষক, আপনার মাইনে দেয় ওই গরীব শ্রমিক, আপনার সংসার চলে ওই টাকায়, আমি গাড়ি চড়ি ওই টাকায়, আমরা দেশ চালাই ওই টাকায়, ওদের সম্মান করে কথা বলেন, ওদের ইজ্জত করে কথা বলেন, ওরাই মালিক, ওরাই চালায়।
ওই বেটা কইথিক্যা আসলি বলেন তাদের? সরকারি কর্মচারিদের বলবো, বলবো, মনে রেখো এ স্বাধীনদেশ, ব্রিটিশ কলোনি নয়, পাকিস্তানি কলোনি নয়। যে লোকটারে দেখবা তার চেহারা তোমার বাবার মতো, ভাইয়ের মতো, ওর পরিশ্রমের পয়সা, ওরাই সম্মান বেশি পাবে, কারণ ওরা নিজে কামাই করে খায়। আর তোমরা গাঁট হইয়া থাকো।
একটা কথা জিজ্ঞাসা করি তোমাদের-আপনাদের, মনে করবেন না কিছু। আপনাদেরই বা বলি কেন! আমাদেরই জিজ্ঞাসা করি, আমি তো আপনাদেরই একজন। আমাদের লেখাপড়া শিখাইছে কিডা? আমরা মনে করি বাপ-মা, আমাদের বাপ-মা। আমাদের লেখাপড়া শিখাইছে কে? আমাদের ডাক্তারি পাস করাইলো কে? ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করাইছে কে? সায়েন্স পাস করাইছে কে? বৈজ্ঞানিক পাস করাইছে কে? আইজ অফিসার করছে কে? কার টাকায়? বাংলার দুঃখী জনগণের টাকায়।
আপনাদের কাছে আমার জিজ্ঞাসা, শিক্ষিত ভাইরা আপনার লেখাপড়ার খরচ কেন দিয়েছে? শুধু আপনার সংসার দেখার জন্য নয়, আপনার ছেলেমেয়ে দেখার জন্য নয়, দিয়েছে তাদের জন্য আপনি কাজ করবেন, সেবা করবেন। তাদের আপনি কী দিয়েছেন? কী ফেরত দিচ্ছেন? কতটুকু দিচ্ছেন? কার টাকায় ইঞ্জিনিয়ার সাব? কার টাকায় ডাক্তার সাব? কার টাকায় অফিসার সাব? কার টাকায় রাজনীতিবিদ সাব? কার টাকায় মেম্বার সাব? কার টাকায় শোঅফ সাব?
এই সমাজ যেন ঘূণে ধরে গেছে, এই ঘূণে ধরা সমাজে আমি আঘাত করতে চাই। এই ঘূণে ধরা সমাজকে চরম আঘাত করতে চাই, যে আঘাত করেছিলাম পাকিস্তানিদের, সেই আঘাত করতে চাই এই ঘূণে ধরা সমাজ ব্যবস্থাকে”- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী, সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সমাবেশে (২৬শে মার্চ ১৯৭৫)।
“কোটা নিয়ে আন্দোলন। এটা কী আন্দোলন নাকি! এই আন্দোলনে তারা কী চায়? বার বার জিজ্ঞ্যেস করা হয়েছে, কিন্তু সঠিকভাবে তা বলতে পারে না। আমাদের মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রী গতকালই বলেছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের কোটা হাইকোর্টের রায়ে রয়ে গেছে। হাইকোর্টের রায় আছে যে মুক্তিযোদ্ধাদের কোটা ওইভাবে সংরক্ষণ থাকবে। আমরা হাইকোর্টের রায় কীভাবে লঙ্ঘন করবো! এটা করলে আদালত অবমাননা হয়ে যাবে। যেখানে কোটা পূরণ হবে না, কোটার যেটা খালি থাকবে, তা মেধা তালিকা থেকে নিয়োগ হবে। এটা আমরা করে দিয়েছি। গত কয়েক বছর থেকেই এই প্রক্রিয়া চালু রয়েছে।
আজকে আন্দোলন করছে; খুব ভালো কথা। বিরোধী দলীয় নেতা বলেছেন, ছেলেপুলে আন্দোলন করতেই পারে। কিন্তু ভিসির বাড়িতে আক্রমণ করে সেখানে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া, গাড়িতে আগুন দিয়ে পোড়ানো, বাড়ি ভাঙচুর করা, বেডরুম পর্যন্ত পৌঁছে ভাঙচুর এবং লুটপাট করা, স্টিলের আলমারি ভেঙে গহনা, টাকাপয়সা সব কিছু লুটপাট করেছে। ভিসির পরিবারের সদস্যরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে লুকিয়ে থেকে প্রাণ বাঁচিয়েছেন। এটা কি কোনও শিক্ষার্থীর কাজ? এটা কি কোনও শিক্ষার্থী করতে পারে?
কোটা আন্দোলনকারীদের মধ্যে যারা ভিসির বাড়িতে ভাঙচুর ও আক্রমণ করেছে কেবল তাদেরকেই গ্রেফতার করা হচ্ছে, বিশৃঙ্খলা আমরা কখনও বরদাস্ত করবো না। ভাঙচুরকারীরা ভিসির বাড়ির ক্যামেরার চিপস নিয়ে গেলেও আশেপাশে থাকা ক্যামেরা দেখে তাদের একটা একটা করে খুঁজে বের করা হচ্ছে। যারা ভাঙচুর অগ্নিসংযোগ ও আক্রমণ করেছে, তাদের তো ছাড়া হবে না। তাদেরকেই গ্রেফতার করা হচ্ছে। তদন্ত করা হচ্ছে। অনেকে স্বীকারও করছে। যত আন্দোলনই হোক না কেন, এদের ছাড়া হবে না। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেই হবে।
কথায় কথায় বলে ক্লাস করবে না। ক্লাসে তালা দেয়, ক্ষতিগ্রস্ত কারা হবে? আমরা সেশনজট দূর করেছি। এদের কারণে এখন আবারও সেই সেশনজট। ১৫ টাকা সিট ভাড়া আর ৩৮ টাকা খাবার, কোথায় আছে পৃথিবীর। আজ নতুন নতুন হল বানিয়েছি। ১৫ টাকা সিট ভাড়া আর ৩৮টায় খাবার খেয়ে তারা লাফালাফি করে। তাহলে সিটভাড়া আর খাবারে বাজারদর যা রয়েছে, তাদের তা দিতে হবে। সেটা তারা দিক।’
আন্দোলনের নামে তারা হলের গেট ভেঙে ফেলে দেবে। মধ্যরাতে হল থেকে ছাত্রীরা বেরিয়ে যাবে। আমার টেনশনে আমি বাঁচি না। আমি পুলিশকে, ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বলেছি- এই মেয়েদের যেন কোনও ক্ষতি না হয়। ভোর ছয়টা পর্যন্ত জেগে থেকে যার যার হলে পৌঁছে যাওয়ার পর আমি ঘুমাতে গিয়েছি।
আগেই বলেছি, কোটা সংস্কার আমরা করবো। আমি তো বলেছি টোটাল কোটা বাদ দিতে। আমরা তো কেবিনেট সেক্রেটারিকে দিয়ে একটি কমিটিও করে দিয়েছি। তারা সেটা দেখছে। তাহলে এদের অসুবিধাটা কোথায়? আসলে তারা কী চায়, সেটা তারা নিজেরাই জানে না” –
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ১২ জুলাই জাতীয় সংসদের ২১তম অধিবেশনের সমাপনী ভাষণকালে।
উপরের ভাষণ দুইটির সময়ের ফারাক ৪৩ বছরের। কিন্ত দুইজন প্রধানমন্ত্রীরই দল এক, আদর্শ এক, মনোভাব এক, কিন্তু প্রকাশে বোঝা যায় আন্তরিকতার ফারাক। মানুষের ভালো কাজ ও ভালো কথা সারাজীবন মানুষ মনে রাখে। তুলনা চলে। সবাই বঙ্গবন্ধু হতে পারে না, হতে পারে না এমন বিশাল হৃদয়। বঙ্গবন্ধুর ছিল সততা, সাহস আর মানুষের প্রতি ভালোবাসার রাজনীতিতে অবিচল। তিনি বড় রাজনীতি করতেন, যা ভাগাভাগির হিসাব করেনি কখনও, যা ছিল না কেবল ক্ষমতা দখলের কৌশল। সে রাজনীতিতে সমাজের নানা অংশের মধ্যে, এমনকি যারা প্রতিহিংসাপরায়ণ তাদের প্রতিও কখনো বিরূপ আচরণ করেননি। তাঁর রাজনীতি ছিল বিপরীত পথের মানুষকেও এক জায়গায় আনার, একসঙ্গে পথ চলানোর জাদুকরী মন্ত্র।
নির্বাচনের প্রাক্বালে সরকারের কেন এই একনায়কতন্ত্রী মনোভাব? তাদের এই ভাবমূর্তি কি জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করবে না? নাকি নির্বাচনে জনগণের অংশগ্রহণের প্রয়োজন নেই। নাকি জনগণের ভোট না দিলেও কোনকিছুর ফারাক পড়বে না? তবে কি গণতন্ত্রের মোড়কে একনায়কতন্ত্রই মূল চালিকা শক্তি হয়ে উঠেছে? জনগণের রায় ও ভালবাসা ছাড়া, জোর যার মুল্লুক তার হলে তো আর কিছু বলার বা লেখার অপেক্ষা থাকে না। তবু বলা, কোনকিছুই চিরস্থায়ী না, না ক্ষমতা, না সম্পদ। শুধু ভালো কাজটাই চিরস্থায়ী। তাই এতো বছর পরেও তুলনা করতে বারবার নাম আসে বঙ্গবন্ধুর।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর কথা বলতে হয় আহমেদ ছফার কাছ থেকে ধার করে, ‘আজ থেকে অনেকদিন পরে হয়তো কোনো পিতা তাঁর পুত্রকে বলবেন, জানো খোকা, আমাদের দেশে একজন মানুষ জন্ম নিয়েছিলেন, যাঁর দৃঢ়তা ছিল, তেজ ছিল আর ছিল অসংখ্য দুর্বলতা। কিন্তু মানুষটির হৃদয় ছিল, ভালোবাসতে জানতেন। দিবসের উজ্জ্বল সূর্যালোকে যে বস্তু চিকচিক করে জ্বলে, তা হলো মানুষটির সাহস। আর জ্যোৎস্না রাতে রুপালি কিরণ ধারায় মায়ের স্নেহের মতো যে বস্তু আমাদের অন্তরে শান্তি ও নিশ্চয়তার বোধ জাগিয়ে তোলে, তা হলো তাঁর ভালোবাসা। জানো খোকা, তাঁর নাম শেখ মুজিবুর রহমান।